Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। নয় ।।

এরপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে পাচু রুমির সাথে দেখা করে নি। এর মধ্যে পাচুর রেজাল্ট বের হয়েছে। পাচু যেসব জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছিল তাদের উত্তর চলে এসেছে। সেগুলো বাছাই করে পাচু একটা অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে পাচু সেখানে চলে যাবে। অনেক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে পাচু ঠিক করেছে, যাওয়ার আগে রুমির সাথে একবার দেখা করে যাবে।

এক সন্ধায় রাস্তায় পেছন থেকে এক চেনা গলার ডাক, ‘এই যে মশায়।’ পাচু দাঁড়িয়ে গেল। ‘সেই যে সেদিন চোরের মত কেটে পরলে। তারপর এতদিন হয়ে গেল। একবারও দেখা পাওয়া গেল না। কি নিয়ে এত মজে আছো? নতুন কিছুর সন্ধান পেয়েছ নাকি?’

রুমিকে দেখে পাচু একটু বেশী খুশী হয়ে বলল, ‘সন্ধানটি পূর্বেই পাইয়াছিলাম। প্রবেশাধিকারটি মাত্র কয়েকদিন পূর্বে পাইলাম। তাই কিঞ্চিত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম।’

রুমি চোখদুটো ছোট করে অন্ধকারে কিছু খোঁজার মত করে পাচুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে তপস্যার ফল সার্থক হয়েছে। অন্যের মুখে আগেই শুনেছিলাম। আজ তোমার মুখ থেকে শুনলাম।’

পাচু ভাবল, কে আবার রুমিকে ওর খবরাখবর দিয়েছে। হরি-নান্টুর তো জানার কথা না। রুমি কার কাছ থেকে জানলো? বলল, ‘তা একরকম সার্থক হয়েছে বলতে পারো। খবরটা নিজেই দিতে আসতাম কয়েকদিনের মধ্যে।’

‘কিসের খবর? আমি তোমার সাধু ভাষায় কথা বলার কথা বলছি।’ রুমি একটুক্ষণ কিছু একটা ভাবল। তারপরে ভারি গলায় বলল, ‘খবরটা এইবার বলেই ফেলো। তাহলে কষ্ট করে আর একবার আমার কাছে আসতে হবে না। আমার কথা যে তোমার মনে পরে না সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’

– ‘এইটে তোমার ভুল ধরনা।’

– ‘তাই বুঝি? এতদিনে একবারও এলে না কেন তাহলে?’

– ‘ওই যে বললাম, প্রবেশাধিকারটা কয়েকদিন আগে পেলাম। পেলেই তো সেখানে ঢোকা যায় না। তার অনেক আনুষ্ঠানিকতা থাকে। সেই সব করতে সময় লাগে।’

ততক্ষণে ওরা রুমির বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে। রুমি দরজা খুলে বলল, ‘তাড়া না-থাকলে ভিতরে এসো।’

আজ পাচু আয়েস করে সোফায় গিয়ে বসল। রুমি ব্যাগটা ঘরের কোনে একটা টেবিলের উপর রেখে ওর পাশে বসে বলল, ‘কতদিন আমি ওই জানালায় দাঁড়িয়ে থেকেছি তোমার জন্যে। মাঝে একবার ভেবেছিলাম, তোমার বাড়ি যাই খোঁজ নিতে। তারপরে ভাবলাম, কি জানি সেখানে গেলে যদি কোন বিপত্তি হয়। প্রায় দুই মাস পরে তোমার দেখা পেলাম। আমার এখানে তো তোমার প্রবেশাধিকার ছিল, আনুষ্ঠানিকতাগুলো ঠিক হয় নি বুঝি?’

পাচুর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবল, রুমি ওকে অনেকবার জব্দ করেছে। আজ সব পরিশোধ করবে। বলল, ‘সে তো তুমি তোমার রান্নাঘর অবধি প্রবেশাধিকার দিয়েছিলে। আমি নিজে যখন ভেতরের ঘরে ঢুকেছিলাম তখন যা করেছিলে, তারপরে কি আর আসা যায়?’

রুমির গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘সেদিন তোমাকে ওই ঘরে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভয়ে। তারপরে আমি কি করেছি বা বলেছি, ঠিক মনে নেই। তুমি কেন গিয়েছিলে আমার পিছন পিছন?’

– ‘যদি বলি, তোমাকে দেখতে।’

– ‘তাহলে ওইরকম ভাবে চলে গেলে কেন?’

– ‘তুমি কিছু বললে না। এখানে এসে চুপ করে বসে থাকলে, তাই।’

রুমির লাল হয়ে ওঠা মুখটা এবার ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রুমি ওর মুখের দিকে হা-করে তাকিয়ে থাকল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি চেয়েছিলে সেদিন?’ পাচু কোন উত্তর দিল না। শুধু রুমির মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল। দুইজনেই নিশ্চুপ। মৌনতা ভাঙল যখন রুমি বলল, ‘তোমাকে কিন্তু কোনদিনই আমার সেইরকম কিছু মনে হয় নি।’

– ‘এবার তো সব জানলে। এখন কি মনে হচ্ছে?’

– ‘জানি না।’ পাচু দেখল, রুমি বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। ওর বুকটা বেশ ওঠা-নামা করছে।

– ‘ঠিক আছে। তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।’

– ‘আমি কি তাই বলেছি? বসো আরেকটু।’ রুমি পাচুর হাতটা চেপে ধরল, কিন্তু তাকিয়ে থাকল দেওয়ালের দিকে।

কিছুক্ষণ দুজনে দুজনের উপস্থিতি অনুভব করে পার করল। তারপর পাচু রুমির দিকে ঘুরে বসে বলল, ‘সেই দিন হরির বিষয়ে যখন তোমাকে বলছিলাম, তুমি সেইরকম কোন গুরুত্ব দিচ্ছিলে না। তুমি ভিতরের ঘরে চলে গেলে। কিছুক্ষণ ধরে তুমি ফেরত না-আসায় আমি কিছু না-ভেবেই ভিতরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম হরির বিষয়টা ঠিকমত করে বোঝাতে। হয়ত আমি একটু অতিরিক্ত অনুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলাম তখন।’

রুমি শুনে কয়েক মুহূর্ত হা-করে তাকিয়ে থাকল পাচুর দিকে। তারপর পাচুর গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পরে পাচুর বুকে কিল মারতে মারতে পাচুর বুকের উপর মাথা রেখে পাচুকে জড়িয়ে বসে থাকল। পাচু আঙ্গুল দিয়ে রুমির চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে রুমির গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধের আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে একই ভাবে বসে থাকল।

বেশ অনেকক্ষণ এইভাবে থাকার পরে রুমি যখন সোজা হয়ে উঠে বসল, পাচু বলল, ‘এবার আর একটা কথা মন দিয়ে শোনো। এম-এ পরীক্ষা দেওয়ার পরে একটা প্রজেক্টে অ্যাপলাই করেছিলাম। কিছুদিন আগে সেইটের কনফার্মেশন এসেছে। তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এইবার বুঝলে?’

– ‘সে তো খুব ভালো কথা। এই সুখবরটা আমাকে জানাতে ইচ্ছে করল না। আজ দেখা না-হলে তুমি হয়ত বলতেও না। এমনিই চলে যেতে না-জানিয়ে একদিন।’

পাচু বুঝল, এই অভিযোগের হেতু যেমন আছে, অহেতুও তেমন। তাই এনিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পাচু বলল, ‘আমি উঠি আজ। সৈকত বাবু যে কোন সময়ে চলে আসবেন। তোমাকে এই চেহারায় আমার সাথে দেখলে তোমাকেই খারাপ ভাববেন।’

– ‘আমি বলেছি না, ওনিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ও আজ বাইরে গেছে। মাঝ-রাতের আগে ফিরবে না। তাছাড়া ও জানে যে তোমার সাথে আমার অনেকদিন দেখা হয় নি বলে আমি অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একদিন তো ওঁকে প্রায় তোমার বাড়ি পাঠাচ্ছিলাম তোমার খোঁজ নেওয়ার জন্যে।’

পাচু হতভম্ব হয়ে বসে থাকল। এর থেকে কি বুঝবে সেইটেই ঠিক করে উঠতে পারল না। রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি প্রজেক্ট? কি কাজ? কি করতে হবে? কতদিন লাগবে?’

পাচু যা যা জানে বলল, এক-দুই বার বিদেশে যেতে হতে পারে সে সম্ভাবনার কথাও জানালো। রুমি বলল, ‘আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, জানো।’ এই বলে আবার পাচুর দিকে গা এলিয়ে দিয়ে পাচুর বুকের উপর মাথা রেখে সোফার উপর অনেকটা শুয়েই পরল। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘তবে সত্যি কথা কি জানো? আমার দুঃখও হচ্ছে একইরকম। তোমার সাথে দেখা হবে না। তুমি কি ছুটিতে আসবে?’ ‘এ কাজে ছুটি নেই,’ পাচু উত্তর দিল, ‘বরং ছুটির সময় কাজ বেশী পরে।’

– ‘চিঠি লিখবে তো মাঝে মাঝে?’

– ‘খুব সম্ভবত, না। চিঠিতে গল্প হয় না। এক তরফা বকবক, অনেকটা নিজের সাথে নিজের কথা বলা। তবে ঠিকানা পাঠিয়ে দেব।’

গল্প করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। পাচু বলল, ‘এবার চলি। বাড়িতে সবাই বসে থাকবে।’ রুমি জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে পাচুকে যতদূর দেখা যায় দেখতে থাকল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10