Home » ছোট গল্প » চতুর্দশী » গালি শিক্ষা

গালি শিক্ষা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি সেদিন এসে বলতেন, দেবু তোমার জানা সবচেয়ে ঘৃণ্যতম একটা গালি বল, আমি তোমাকে রসায়নে পি-এইচ-ডি দিয়ে দেব – দেবু বড়জোর ‘শালা’ বললেও বলতে পারত। ওর কাছে, ছিঃ, দূর মড়া, খ্যাপা, পাগল – এগুলো হল গালি-গালাজ। ওই বয়েসের একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছেলে বলতে যা বোঝায় – দেবু ছিল তাই – শুধু ওই একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে। সে উন্নত রুচি বোধের জায়গা থেকে নিজের মুখে অশ্লীল বা অসভ্য সমাজে ব্যবহৃত বাজে শব্দ উচ্চারণ করবে না – সেইটে বুঝি। শালার ঊর্ধ্বে কোন অশ্লীল শব্দ জানে না সেইটা মানতে গেলে দেবুকে হয় গাণ্ডু বা হাফ-গাণ্ডু ভাবতে হয়। কিন্তু, সে আবার সেটাও নয়। দেবু বরং ভীষণ রসিক, বুদ্ধিমান সেটা বলাই বাহুল্য, এবং প্রায় সবরকম গোয়েন্দা গল্পই ওর পড়া।

কৃষ্ণনগর কলেজের হোস্টেলে অরুণ-দা, দেবু-দা, আর আমি তেরো নম্বর রুমে থাকতাম। অরুণ-দা আর আমি দেবু-দার অনুপস্থিতিতে এনিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। অরুণ-দা একবার সে নিয়ে পড়াশুনোও করে ফেলল। তার থকে জানতে পেরেছিলাম যে, কোন মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কোন কল্পনা করতে পারে না এমনকি স্বপ্নও দেখতে পারে না। পরে এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে অনেকের অনেক গোপন কথাও বের করেছিলাম। সেইটে অন্য প্রসঙ্গও। দেবু-দার উপর ওইসব তত্ত্বের অনেক প্রয়োগ করেও কিছুই আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায় নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এইটা জানা, যে ও সত্যিই জানে না, না কি ভান করে। সব পরীক্ষাতে একটাই ফল – ও সত্যি জানে না। আমার আজও বিশ্বাস হয় না, কিন্তু না মেনে কোন উপায়ও নেই।

অরুণ-দা সম্পর্কে দুটো কথা বলি। অরুণ-দা একবার পাশের ঘরের কারুর কাছ থেকে রুবিক কিউব দু-দিনের জন্যে ধার নিয়ে এসে কোন সলিউশন-কি ছাড়াই রুবিক কিউব পুরো সমাধান করে দেবু-দাকেও প্রায় শিখিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়টি, বাংলা সাহিত্য – সে কবিতা, পদ্য, ছড়া, ছোটো-মেজো-বড় গল্প, উপন্যাস, প্রাচীন বা আধুনিক – সবেতেই অনাবিল বিচরণ। বাংলা ওর শখের বিষয় এবং পাঠ্যও বটে।

একদিন ব্রিজ খেলায় বারবার একই ভুল করায় অরুণ-দা একজনকে একটা স্বরচিত গ্রাম্য গালি দিয়েছিল। অরুণ-দার বুদ্ধিমত্তা এবং অভিনবত্বর উদাহরণ ওর নিজের অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ত। সে যাহোক, তখন সেই ছেলেটি রেগেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক উঠে চলে গেল। আমরা সবাই সে কথার মানে বুঝলেও দেবু-দা জিজ্ঞেস করল, ওটা কি বললে? ওটার মানে কি অরুণ-দা?

অরুণ-দা বলল, ওটা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কথা, ওটার মানে গুডবাই।

দেবু-দা কি ভাবল কে জানে; মাথা চুলকাতে চুলকাতে আবার পরের খেলায় মন দিল। সেই কথাটার মধ্যে এমন একটা ছন্দ ছিল, যে তার মাদকতায় আমরা সবাই মাঝেমাঝে সেটা বলতাম। দেবু-দাও কখনো কখনো গুডবাই-এর জায়গায় সেইটা বলত।

একবার আমাদের রুমেরই এক পুরানো ছাত্র, শ্রীকান্ত-দার বাড়ীতে নেমন্তন্ন খেয়ে গিয়েছি কোন একটা সামান্য অনুষ্ঠানে। মাসিমা আমাদের অত্যন্ত যত্ন করে খাওয়াতে খাওয়াতে নানান কথার মাঝে তাঁদের বাড়ীর রান্নার স্বাদের বিষয়ে নিয়ে বলতে বলতে একবার বলেছিলেন যে বাপের বাড়ীর দিক থেকে তাঁরা হলেন চট্টগ্রামের লোক। খাওয়ার পরে বেশ কিছু গান-বাজনা হল। তারপর বিকেলের চা খেয়ে আমদের বিদায় নেওয়ার পালা।

গেটের বাইরে এসে মাসিমাকে ইমপ্রেস করার জন্যে দেবু-দা যেই না বলতে গেছে, মাসিমা গু…।

অরুণ-দা কপ করে ওর মুখ চেপে ধরে বলল, ওকথা গুরুজনদের বলতে নেই।

দেবু-দা থেমে গিয়ে বলল, মাসিমা আসি।

একটু দূরে এসে সে জিজ্ঞেস করল, অরুণ-দা তুমি ওরকম করলে কেন? মাসিমারা চট্টগ্রামের লোক, শুনলে কত ভালো লাগত ওনার।

কপাল আমার আজ খুব ভালো, অরুণ-দা বলল, দেবু তুমি আর কোন কোন চট্টগ্রামের লোককে এটা বলেছ?

দেবু-দা বলল, আমার চট্টগ্রামের তেমন কোন লোকের সাথে আলাপ নেই, তবে ছুটিতে বাড়ীতে আমার বোনকে অনেকবার বলেছি। বলেছি, অরুণ-দার কাছ থেকে শেখা।

অরুণ-দা একটা গোলার মত ছিটকে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে পরল। দেবু-দা আর আমিও ওর পাশে গিয়ে বসলাম। অরুণ-দা অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে বসে থাকল, কোন কথা নেই। দুই গ্লাস জল ও এক কাপ চা খেয়ে উঠে শুধু বলল, দেবু আমি কোনদিন তোমাদের বাড়ি যাব না।

— শেষ —