ঘরের মাঝখানে এক চামুচ চিনি রেখে দাও, দেখবে সারা পাড়ার পিঁপড়ে – দুনিয়ার পিঁপড়ে এক হও – স্লোগান দিতে দিতে খেয়েও যাচ্ছে আবার সাথে করে নিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু, ইঁদুর? এক-আধ বার চেখে দেখলেও দেখতে পারে, সে সারা বাড়ী পর্যবেক্ষণ করে পছন্দসই জিনিস পরিমাণ মত টেনেটুনে রান্নাঘরের কোনে সেটা নিয়ে জমিয়ে বসবে। যদিও শেষের দিকটা অনেকটা একরকম, কিন্তু পেটুকের সাথে ভোজন রসিকের এইটেই পার্থক্য। পেটুক যা পায় তাই গপাগপ খায়। ভোজন রসিকের খাওয়ার উপাখ্যান শুরু হয় বাজার পরিক্রমা থেকে – বেছে বেছে পরিমাণ মত উপাদান নিয়ে এসে, সেটা রান্না করে, ভালভাবে পরিবেষণ, তারপরে খাওয়া এবং খাওয়ার পরে সে নিয়ে বিশদ আলোচনা। আমার রায়গঞ্জ হোস্টেলের বন্ধু জাগা ছিল এই রকম ভোজন রসিক।
জাগার বাড়ি ছিল কোচবিহারে। এই রায়গঞ্জ-কোচবিহার বাস-রুটে কোন স্টপেজের কোন দোকানে কি কি ভালো খাবার পাওয়া যায় এবং সেটা দিনের কোন সময়ে পাওয়া যায় – ওর একেবারে মুখস্থ। হোস্টেল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় বাস ছাড়ার অনেক আগে বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে জাগা বাস কন্ডাকটরের ঠিক পাশের সিটটা বুক করত এবং সারাক্ষণ তাকে বলতে বলতে যেত যে কখন কোথায় কোথায় খাবারের ব্রেক দিতে হবে। তারপর বাসের কন্ডাকটর ও ড্রাইভারকে নিয়ে সঠিক দোকানে সঠিক খাবারের অর্ডার দিত এবং সেগুলোর বিশেষত্ব কি, কেন সেটা অন্য দোকানের থেকে ভালো, খেতে খেতে ও সেগুলো বুঝিয়ে বলত। এই লাইনে যে দোকানের সামনে বাস থামানো হয় সেই দোকানে বাসের কন্ডাকটর ও ড্রাইভারদের খাওয়া সাধারণত ফ্রি। ওদের সাথে বসে খাওয়ার জন্যে ওরটাও প্রায়শ ফ্রি হয়ে যেত।
আগের রাতে কাঁঠাল খওয়ার প্রতিযোগিতায় ষাট খানার কিছু বেশী কাঁঠালের কোয়া খেয়ে সকাল থেকে আমার সারা শরীর দিয়ে তখন কাঁঠালের গন্ধ বেরোচ্ছে, আর পেট ফুলে জয়ঢাক। এরপরে যা যা করার করার সব করেছি – গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি, দুপরে না খওয়া, ডনবৈঠক, পেটে চাপ, এক হাঁটু থুতনির সাথে লাগিয়ে অন্য পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, আরও কত কি। যে যা বলেছে তাই করেছি, কেবল একটি উপদেশ বাদ দিয়ে। একজন বলেছিল, গোটা দুয়েক কাঁঠালের বিচি চিবিয়ে খেয়ে নে, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। কাঁঠালের বিচি পোড়া খেতে ভালো লাগে – জানি, আগে খেয়েওছি। চোখের জলেও যখন কাঁঠালের গন্ধ পাওয়া যায় তখন আর যাই হোক, কাঁঠালের বিচি খাওয়া কেন? – সেটা দেখাও পাপ। কাঁঠালের সাথে আমার নামের প্রথম বর্ণের মিলটাও তখন অসহ্য মনে হচ্ছে।
সারা দুপুর আমি প্রাণ নয়, পেট হাতে করে কাটালাম। বিকেল বেলায় একজন এসে বলে গেল, আমরা আজ একটু দেরী করে বিকেলের টিফিন করতে যাব, তুই অন্য কারুর সাথে যাস না।
বিকেল তখন শেষ, সন্ধে হতে অল্প কিছু বাকি – জাগা আমার ঘরে এসে বলল, চল এবার টিফিন করে আসি। দেখি আরও জনা ছয়েক অপেক্ষা করছে গেটের কাছে। ভাবলাম, কিছু একটা হবে, হোস্টেলের বাইরে গিয়ে সব জানা যাবে। যা জানলাম তা মোটামুটি এইরকম – গতকাল জাগার বাড়ি থেকে যে চিঠি এসেছে তাতে জানা গেছে ওর ভাই কোন একটা পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছে। সেই খুশিতে জাগা যে ভুলটা করেছে সেইটে হল – গর্বিত দাদা হিসেবে এই খবরটা সে এমন এক জায়গায় বলে ফেলেছে যেখানে একজন ছিল যে কিছুদিন আগেই মোটামুটি একই রকম কারণে আমাদের খাইয়েছিল। ব্যাস, আর যায় কোথায়? জাগা, এবার খাওয়াও।
এখন ভোজন রসিক জাগা তো আর ‘উঠ ছুড়ি তোর বিহা লেগেছে’-র মত করে সবাইকে খাওয়াবে না। সে পুরো গোনাগুনতি করে ধীরুদার দোকানে গিয়ে আট খানা হাফ মুরগী কসা-রোস্ট, পরটা আর মিষ্টির অর্ডার দিয়ে এসেছে। শুনে তো আমার জিভে জল আর পেটে ব্যথা – দুটোই বেড়ে গেল। জাগা আরো বলল, ও হোস্টেলে আমার রাতের মিল অফ করে দিয়েছে। বুঝলাম, ব্যবস্থা পাকাপাকি – আমাকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজনীয়তাটুকু বোধ করে নি। কি করা যাবে? বন্ধুত্বের অধিকার। এরপরে আর বেশী কিছু বলা চলে না।
গতরাতের মূল ঘটনাটা কমবেশি এরা সবাই শুনেছে – তবে আমার যে সত্যি এই দুরবস্থা সেটা ওরা জানে না। অগত্যা, সব ভেঙ্গে বললাম। মুহূর্তের মধ্যে তার একটা সমাধান বের করে ফেলল। বলল, তোকে পা ধরে বাই বাই করে ঘুরিয়ে দিচ্ছি দেখবি হড়হড় করে বমি হয়ে পেট খালি। বললাম, আমার মাস (ভর) খুবই কম, সুতরাং অ্যানগুলার ভেলোসিটি একটু বেশী না হলে সেসব বের হবে না। পারবি তো তোরা? হঠাৎ পা ছেড়ে দিবি না তো? আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ইচ্ছে করে ছেড়ে দেব না। বললাম, তাতেই হবে। দুর্ঘটনার চাইতে হঠকারিতায় আমার বেশী ভয় – সেটা না হওয়ার আশ্বাস যখন পাওয়া গেছে, আমি সায় দিলাম। ঠিক হল, সামনের খেলার মাঠে যেখানে ঘাসটা একটু বেশী থকথকে সেখানে করা হবে যাতে পরে গেলেও বেশী না লাগে।
এরপরে যথাস্থানে আমার পা ধরে কয়েক পাক ঘোড়াতেই – ওয়াক ওয়াক। তাড়াতাড়ি মাঠের কোনায় গিয়ে কয়েক গামলা বমি – কাঁঠাল আর জল বেড়িয়ে গেল। কি শান্তি! কি আরাম! বললাম, তোরা সকাল বেলায় যদি এটা করে দিতিস, আমাকে এই কষ্টটা পেটে হত না। যেন দোষটা ওদেরই। এরপরে বেশ করে খেয়ে দেয়ে, আগের রাতের কাঁঠাল চুরির পুরো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে রাতে হোস্টেলে ফিরলাম।
গল্পটা এইখানে শেষ হলে অন্তত আমার জন্যে ভালো হত। এই মাঠের একপ্রান্তে ছেলেদের আর অন্য প্রান্তে মেয়েদের হোস্টেল – দুই হোস্টেল থেকেই পুরো মাঠটা দেখা যায়। এই বন বন করে ঘোরার আগে আমি টুক করে দেখে নিয়েছি যে মেয়েদের হোস্টেলের নির্দিষ্ট একটি জানালার পর্দা ফেলা আছে। না থাকলেও হয়ত একই কাজ করতাম, কারণ এছাড়া আর কোন উপায় নেই – বাকি সব চেষ্টা করা হয়ে গেছে তার আগে। তবে পরের দিনের জন্যে প্রস্তুত থাকতাম। এই অপ্রস্তুতিটাই আমাকে ডোবাল। কলেজের পরে ঘণ্টা খানিক প্রেমের সময় – তুই-তুকারির প্রেম। দেখা হওয়ার মুহূর্ত থেকেই গম্ভীর মুখ, কোন কথা নেই ধীরুদার দোকান অবধি। মেঘ জমেই যাচ্ছে, আর আমি অপেক্ষা করছি কখন বৃষ্টির প্রথম ফোটাটা পরবে। চায়ে এক চুমুক দিতেই বৃষ্টি এলো – কাল মাঠের মধ্যে কি করছিলি?
সহপাঠিনীর সাথে প্রেম করার সুবিধা-অসুবিধা দুইই আছে। অসুবিধা হল, ছেলে হিসেবে যেই একটু বেশী জান্তার ভঙ্গিতে কিছু বলার জন্যে ফণা তুলেছি, অমনি কবে কোন অঙ্ক পারিনি তার এক পুরিয়া অ্যান্টি-ভেনম বের করে সামনে রেখে দিল। ব্যাস, সাপ তখন ফণা গুটিয়ে শামুকের খোলায়। সুবিধা হল, এইসব কুকীর্তিতে নিজের মান যাওয়ার কোন আশঙ্কা থাকে না। তাই সবিস্তারে তাকে সব বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, তুই দেখলি কি করে? তোর জানালার পর্দা তো ফেলা ছিল।
ও জানালো, যখন এই সব কাণ্ডকারখানা চলছে ওর কোন বন্ধু দেখে ওকে বলেছে। ও তারপর জানালা থেকে সব দেখেছে। বললাম, কিন্তু তোর জানালার পর্দা তো আগাগোড়া ফেলা ছিল, আমি পরিষ্কার দেখেছি। ও বলল, সেই পর্দাতে চোখের মাপ বরাবর দুটো ফুটো করে তার উপরে ঢাকনা লাগিয়ে রাখি। দরকার মত সেগুলো সরিয়ে পর্দার ওপার থেকে সব দেখতে পাই। বুঝলাম, বুড়ো বয়েসে রক্তের আর যৌবনে হরমোনের – চাপ সব বয়েসেই থাকে।
— শেষ —