সব রান্না হয়ে যাওয়ার পরে, বাকি পরে থাকা সবজির সাথে অল্প-স্বল্প এটা-ওটা-সেটা মিশিয়ে যে তরকারি হয় তার কোন কেতাবি নাম নেই – সব কিছু দিয়ে ঘেঁটে ঘুটে একটা কিছু বানানো হয় বলে হয়ত তাকে বলা হয় ঘণ্ট, বা পাঁচমিশালি। সে নাম যাই হোক না কেন, রাঁধুনি যতই ক্লান্তি নিয়ে সেটা রাঁধুক না কেন, দেখা যায় সেইটেই খেতে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু তাই বলে তো সেই পাঁচমিশালি ঘণ্ট দিয়ে অতিথি খাওয়ানো চলে না – গৃহকর্তার মান থাকে না তাতে। স্কুল কলেজের ঘটনা নিয়ে জয়দীপকে চোদ্দটা গল্প লিখে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার ঠিক সেই রকম অবস্থা হয়েছে। এদিক ওদিক থেকে ভাঙ্গা, টুকরো, কিছুটা ভুলে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আর বাকিটা বানিয়ে একটা পাঁচমিশালি লিখে ফেলা যায় – হয়ত পড়ে মজাও পাওয়া যাবে – কিন্তু তাতে জয়দীপের মান থাকে না। তাই কদিন আগে অরূপ (ঘটক)-এর শরণাপন্ন হলাম। অরূপ এক কথায় অনুমতি দিল বলে আজ এইটে পরিবেশন করতে পারছি।
অরূপ আমাদের দলে থাকলেও চুপচাপ গোছের ছেলে ছিল – বেশ একটা ভালো ছেলে ভালো ছেলে গোছের ভাব। আমাদের তাতে সুবিধে ছিল, রাতে নাইট-শো সিনেমা দেখে প্রাচীর টপকে হোস্টেলে ঢুকে তো যেতাম, কিন্তু কে খাবার তুলে রাখবে? অরূপকে বলে দাও – ও ঠিক ম্যানেজ করে খাবার তুলে রাখবে এবং আমরা না আসা পর্যন্ত সেটা পাহারা দেবে। অথবা, যখন আমাদের নামে কোন সুপারিশের দরকার হত অরূপকে পাঠানো হত সে কাজে। ও ভালো ছেলে, আমাদের নাম সুপারিশ করছে, তাতে রেসে একটু এগিয়ে থাকা যেত। বন্ধুদের জন্যে অরূপ এই ধরনের কাজ হাসি মুখে করত। অনেকটা একগোছা নচ্ছার পাণ্ডব দলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মত ভূমিকা ছিল অরূপের।
হোস্টেলে সেই সময়ে টান টান উত্তেজনা চলছে, কারণ জনা-পাঁচেক ছেলে সুপারের ঘরের সামনে পেচ্ছাপ করে কয়েক বালতি জল ঢেলে সেটা দরজার তলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুপার সেই নিয়ে সারা কলেজ তোলপাড় করে ছেড়েছেন। সর্বত্র ওই একই আলোচনা। এক-একটা গল্প তৈরি হচ্ছে; কিছুদিন চলছে তারপর যেই আরেকটা গল্প তৈরি হচ্ছে, পুরানো গল্পটা মরে যাচ্ছে। সুপার তখন পুরো হিটলার। জানা গেল, এই কলেজ হোস্টেলের নাকি একটা রুল বুক আছে, সেটা ফলো করলে আলিপুরের জেলখানাও অনেকটা খোলামেলা পরিবেশ মনে হবে। যেমন, সন্ধে সাতটায় মেইন গেটে তালা পরবে; রাত নটার মধ্যে ডাইনিং হলের আলো নিভে যাবে; সন্ধে সাতটা থেকে স্টাডি আওয়ার শুরু, সেই সময়ে কেউ অন্যের ঘরে যেতে পারবে না; গ্রুপ স্টাডি করতে হলে সুপারের কাছে আগে থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে; কোনরকম চিৎকার করা যাবে না; বিনা অনুমতিতে হস্টেলের বাইরে দুইদিনের বেশী থাকলে হোস্টেল থেকে নাম কাটা যাবে, সুপার যেকোনো সময়ে যে কারুর ঘরে ঢুকে খানা-তল্লাসি চালাতে পারে, ইত্যাদি নানা রকম রুলস।
তখন সুপার মনের আনন্দে সেই রুল বুক পড়ছেন আর তার যতটা মনে রাখতে পারছেন তা দিয়ে রোজ নতুন নতুন নিয়ম চালু করছেন। তার সাথে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছেন। একদিন আমাকেও লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে উনি যেই ঘুরেছেন, বৈদ্যা গলা মেয়েদের মত করে বলল, কবে ওর ফাইনাল বেলটা বাজবে, স্যার? সুপার যথারীতি ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে বলল ওই কথা? আমরা প্রায় সমস্বরে পালটা প্রশ্ন, কি কথা স্যার? উনি বললেন, ওই যে ওই কথা, ওই কথাটা। একজন বোকা বোকা মুখ করে জিজ্ঞেস করল, কোন কথাটা স্যার? আপনি যা বললেন তাছাড়া আমরা তো আর কিছুই শুনতে পাই নি, স্যার। ঘটনাটা এমন দাঁড়াল যে, সেটা কোন দৈববাণী হয়েছিল, যা কেবল উনি একাই শুনেছেন।
ওদিকে সবাই নিজের নিজের মত গোয়েন্দাগিরি করে যাচ্ছে – সব লিকলিকে শার্লক হোমস একেকটা – বিশেষ করে যেগুলো সারা দিন দরজা বন্ধ করে ভুল অঙ্ক মুখস্থ করে। একটা সময়ে সব মিলিয়ে দাঁড়াল যে, যেহেতু কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না, অতএব এটা নাকি আমারই কাজ, আর আমার সাথে আরও কেউ কেউ আছে। এই চাপটাকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্যে আমাকে বলা হল – দোষী দোষ স্বীকার করলেই সব আবার আগের মত নরমাল হয়ে যাবে। এই চাপে তখন আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত।
এই রকম সময়ে একদিন সন্ধের সময় আমি আমার ঘরে একাই বসে আছি। হঠাৎ অরূপ এলো আমার কাছে। একটু রহস্য করে জিজ্ঞেস করল, কিরে কিছু উদ্ধার করতে পারলি?
আমি তখন সত্যি ক্লান্ত এই ঝামেলায়। হোস্টেল ছাড়তে পারলে বাঁচি। কিন্তু ছাড়তে পারছি না শুধু একটাই কারণে যে ছাড়লেই সবাই ধরে নেবে এই কাজ আমি করেছিলাম। হোস্টেলে আমার থেকে অনেক বেশী সরেস লোক আছে – গল্প বানানোর জন্যে। ওকে বললাম, নারে, কিছুই জানিনা এর বিন্দু বিসর্গ। আসলে এর থেকে মুক্তি পেলেই আমি বাঁচি।
অরূপ বলল, আমি জানি কে করেছে।
আমি একটু ল্যাদ মেরে বসেছিলাম ওর সাথে কথা বলছিলাম এতক্ষণ। এইটা শুনে তো তড়াক করে উঠে বসে প্রথমেই জানলা দিয়ে দেখে নিলাম যে কোন টিকটিকি আসে পাশে ওত পেতে শুনছে কি না। তারপরে উত্তেজনায় হুড়মুড় করে কি কি প্রশ্ন করেছিলাম, আজ আর তা মনে নেই। তবে অরূপ বলেছিল, যে করেছে সে আমাদেরই মধ্যেই আছে।
আমি বললাম, এত বড় কাণ্ড আমাদেরই কেউ করল আর এখনো আমি জানতে পারলাম না! তারপরে একটু হতাস হয়ে বললাম, আমাদের নিজেদের মধ্যে কোন বিশ্বাস নেই তাহলে।
অরূপ তারপরে বলল, যে করেছে সে দুই-এক দিনের মধ্যেই দোষ স্বীকার করে নেবে। মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে।
আমি আর থাকতে পারলাম না। আমাদের মধ্যেই কেউ করেছে, সে আমাকে কিছুই জানায়নি – ভাবতে কষ্ট হলেও ঠিক ছিল। এখন সে এত বড় একটা ডিসিশন নিতে চলেছে, আর একবার আমার সাথে আলোচনা অবধি করল না! মনে মনে ভাবলাম, যে করেছে সে আমাকে বিশ্বাস যদি নাও বা করে, এটা জানালে আমি আর কি অতিরিক্ত ক্ষতি করতে পারতাম! না, এ আর হয় না। আমি অরূপকে খুব চেপে ধরলাম কমপক্ষে তুই আমাকে বল যে কে করেছে। তারপর দেখছি কি করা যায়। অরূপ বলল, আমি করেছি।
ওর হেঁয়ালিপনাতে আমি ততক্ষণে বেশ বিরক্ত। অন্য কেউ এতক্ষণ ধরে হেঁয়ালিপনা করলে কমসে সে কম একখানা লাথ তো খেতই। কিন্তু অরূপের সাথে সেটা করা চলে না। আমি বললাম, প্লিজ অরূপ বল না। বিশ্বাস কর আমি কাউকে বলব না, অন্তত তোকে জিজ্ঞেস না করে।
অরূপ গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যিই আমি করেছি।
আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। সেইটা বুঝতে পেরে অরূপ নিজেই ঘটনাটার যে বিবরণ দিল তা সংক্ষেপে এইরকম। (অরূপ কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিল) কারুর অনুরোধে একদিন অরূপ কলেজের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের এক টিচারের জন্যে রক্ত দিয়ে হস্টেলে ফিরেছে। তারপরে বেশ কয়েকজন টিচার এসে ওকে দেখে গেছে এবং অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে গেছে। কোন কোন টিচার সুপারের সাথেই হোস্টেলে ঢুকেছিলেন এবং সেখানে আসার কারণটা সুপারকে বলেও ছিলেন। সুপার কিন্তু একবারের জন্যেও আসেন নি অরূপকে দেখতে। একবার এসেছিলেন ওর ঘর অবধি, শুধু ওর রুমমেটকে অকারণ কিছু নিয়ে বকাঝকা করতে। সেই রাতে অরূপের ঘুম আসছিল না, হাতে প্রচণ্ড ব্যথা করছিল। রাত তিনটে নাগাদ রাগে, দুঃখে দুই বালতি জল সুপারের দরজার তল দিয়ে ঢেলে ও শুয়ে পরে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর ওই পেচ্ছাপগুলো? সেটা কারা?
অরূপ বলল, কোথায় পেচ্ছাপ?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুই করিস নি?
অরূপ বলল, না। আমাকে কি এতোটাই নোংরা মনে হয় তোর?
আমি ওর ঠেসটা হজম করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে পেচ্ছাপটা এলো কোথা থেকে?
অরূপ বলল, তুই সুপারকে চিনলি না এখনো। হয় উনি এখনো বিছানায় পেচ্ছাপ করেন নতুবা, জল দেখে নিজে দেওয়ালে পেচ্ছাপ করেছেন বিষয়টার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্যে।
তারপর বলল, আমার জন্যে তোদের এই হেনস্থা আমার খুবই খারাপ লাগছে, আর সহ্য করতে পারছি না। আমি ঠিক করেছি, দুই-এক দিনের মধ্যে সুপারের কাছে গিয়ে সব স্বীকার করে নেব।
আমি বললাম, পাগল হয়েছিস নাকি? ভাবতে পারিস এর ফলটা কি ভয়ানক হবে? তোকে হোস্টেল থেকে চলে যেতে হবে। হয়ত কলেজ থেকেও।
অরূপ বলল, খুব বেশী কিছু হলে পি-এস-সি পরীক্ষাগুলো তো আছেই।
আমি মোটামুটি ওর হাতে-পায়ে ধরে ওকে রাজি করালাম যাতে কোনমতেই এই ভুলটা না করে। আশ্বাস দিলাম যে আমার এইসব টেনশন নেওয়ার অভ্যাস আছে, আমি আর গুম মেরে থাকব না, আর বাকিদেরও আমি ম্যানেজ করে নেব। মনে মনে ভাবলাম, গুরু তুমি তো পাকা খেলুড়ি, তোমাকে ছাড়া আমাদের চলবে কি করে? তুমি আমাদের কপিল দেব – ১৭৫, নট আউট।
— শেষ —