Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। এক ।।

তখন সকালবেলা। দুটো ছেলে আর কয়েকটা মেয়ে কোন এক প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে পড়ে রাস্তা দিয়ে ফিরছে আর অন্য দিক থেকে নান্টু আসছে। পাচু রাস্তার ধারে একটা ফাঁকা বারান্দায় বসে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পড়ছে। ছেলেমেয়েদের দলটা যখন পাচুর পাশ দিয়ে যাচ্ছে, পাচু বলল, ‘এই যে একটু শুনুন।’ কয়েকজন পাচুর দিকে ঘুরে তাকাল। দুটো মেয়ে এমন ভাবে তাকাল যে ভাবখানা যেন, ছেলেটা ইভ টিজিঙটাও ঠিক করে করতে জানে না; একরকম মুখ ভেঙচিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করল। নান্টু সেই সময় এই দলটার একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে – সুতরাং পথ একরকম আটকানো। নান্টু একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাচু আপনাদের কাউকে ডাকছে না। ওনাকে ডাকছে।’ এই বলে নান্টু ওই দলের একটা ছেলের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে পাচুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি আমাকে ডাকছেন?’ পাচু বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

ছেলেটা পাচুর কাছে এগিয়ে এল, আর বাকি সবাই কয়েক পা এগিয়ে ছেলেটার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। পাচু ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি অদ্য প্রভাতে আপনার ব্যক্তিগত শিক্ষক মহাশয়ের নিকট কি পাঠ করিলেন? আপনাকে আহ্বান করিয়া আপনার প্রতি আমার এইরূপ ব্যক্তিগত কৌতূহল প্রকাশ করিবার ধৃষ্টতাকে আপনি অনুগ্রহ করিয়া মার্জনা করিবেন। কহিতে পারেন, ইহা আপনার বিষয়ে আমার একরূপ অনাবশ্যক কৌতূহল। তথাপি, ইহা সম্পর্কে সামান্য জ্ঞাত হইবার আমার একান্ত অভিলাষ। অনুগ্রহ করিয়া আপনি সংক্ষেপে বলিলেও আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং বাধিত হইব।’

একে তো এইরকম উদ্ভট প্রশ্ন, তার উপরে সাধু ভাষায়। ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তখন আমতা আমতা করছে, ‘না মানে, আপনার কি দরকার? আপনাকে কেন বলব?’

পাচু বলল, ‘আপনি না বলিলে, আমি যৎকিঞ্চিত দুঃখ পাইব মাত্র, আপনার প্রতি আমি কোনরূপ বিরূপ মনোভাব পোষণ করিব না। আপনি চাহিলে, না বলিয়া চলিয়া যাইতে পারেন।’

যেই না এই কথা বলা, ছেলেটি প্রাণ নিয়ে সেইখান থেকে পালাল। একটু দূরে গিয়ে ওই দলের সবাই হাসতে হাসতে চলে গেল, কেউ কেউ আবার পিছন ফিরে পাচু আর নান্টুকে আরেকবার দেখল।

পাচু আনন্দবাজারটা তুলে তাতে মন দিল আর নান্টুকে বলল, ‘আনন্দবাজারে সম্পাদকীয় সাধু ভাষায় লেখার কোন মানে হয়? চোখের সামনে তো দেখলি তার কি ফল।’

একদিন পাড়ার এক মহিলা বিকেল বেলায় মোড়ের মাথায় যে ঝালমুড়ি ওয়ালা বসে তার কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনতে এসেছে। এনি এই পাড়ায় সে নতুন এসেছেন। মহিলার অকারণ দেখনসইপনার জন্যে কেউই বিশেষ মেশে না তার সঙ্গে। শরতকালের বিকেলে পাড়ার মোড়ে ঝালমুড়ি কিনতে এসেছে – হাতে ভ্যানেটি ব্যাগ, পায়ে হাই হিল, চুলে টপ নট, চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, আর সর্বোপরি তার শাড়ি – তা শরীর ঢাকার জন্যে পরা, না বিশেষ কিছু অঙ্গকে হাইলাইট করার জন্যে অপ্রাসঙ্গিক অংশগুলোকে ঢেকে রাখা – তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হতে পারে। তবে তার বর্ণনার জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট। যা নিয়ে এই গল্প – সেই পাচু-নান্টুর প্রসঙ্গে আসা যাক।

মহিলাকে ঝালমুড়ি কিনতে দেখে পাচু আর নান্টু ঝালমুড়ি ওয়ালার স্ট্যান্ডের পাশে এসে দাঁড়াল – নান্টু মহিলার পাশে, আর পাচু মহিলার মুখোমুখি, ঝালমুড়ি স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে। মহিলাটি ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছ থেকে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে ঝালমুড়ি ওয়ালাকে পাঁচ টাকা দিয়ে, ঠোটের লিপস্টিক বাঁচিয়ে একটু ঝালমুড়ি মুখে পুড়লেন। পাচু মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি খান কি?’ শুনে তো মহিলার বিষম খাওয়ার জোগাড়। নান্টু মহিলার একদম পাশে দাঁড়িয়ে। নান্টু একটু নিচু স্বরে বলল, ‘আপনি যেটা কিনলেন ও হয়ত সেইটেই অর্ডার দেবে। তাই ও আপনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি খাচ্ছেন?’

উত্তরের অপেক্ষা না করে পাচু দশ টাকা ঝালমুড়ি ওয়ালাকে দিয়ে বলল, ‘ওনাকে যেটা দিলি সেইটে দুটো বানিয়ে দে, একটু বেশী ঝাল দিয়ে।’

শাড়ি এবং হাই-হিল – কোনটাই তাড়াতাড়ি হাঁটার অনুকূল নয়। তবু মহিলাটি তার ঝালমুড়ির ঠোঙা মুড়ে যখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যাচ্ছে, পাচু বলল, ‘আপনার শাড়িটা কিন্তু বেশ খানদানি।’ ঝালমুড়ি ওয়ালা এতক্ষণ মুখ নিচু করে ছিল – কি আর করতে পারে বেচারা? পাড়ার মোড়ে তাকে ঝালমুড়ি বেচে চলতে হয়। একটু মুখ তুলে দেখল, মহিলাটি যেন একটু ধীরে হাঁটছেন। নিজের মুচকি হাঁসি গামছা দিয়ে মুছে, সে আবার ঝালমুড়ির অর্ডার বানাতে লাগল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10