Home » ছোট গল্প » চতুর্দশী » সিগারেটের ছাই

সিগারেটের ছাই

কালো রঙ বলতে ঠিক যা বোঝায় কৃষ্ণকান্তের গায়ের রঙ তাই ছিল। অন্ধকারে ওর মুখে টর্চের আলো ফেললে শুধু চোখ দুটো দেখা যেত – এতোটাই কালো। দেড়শ বছরের পুরানো কৃষ্ণনগর কলেজের প্রায় একশো বছরের পুরানো হোস্টেল – সেখানে টানা বারান্দার একপ্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত অবধি পরিষ্কার দেখা যায়। কৃষ্ণকান্ত তখন স্নান করে খালি গায়ে একটা লাল রঙের প্যান্ট পরে বারান্দায় গামছা মেলতে বেরিয়েছিল। অন্য প্রান্ত থেকে অরুণ-দা সেটা দেখে বেশ জোরেই বলল, ওরে দেখে যা, কয়লা খনিতে আগুন লেগেছে। কৃষ্ণকান্তকে কেউ আর কখনো লাল জামা বা প্যান্ট পরতে দেখে নি। অনেকে বলত, তারা নাকি দেখেছে কৃষ্ণকান্ত কলেজের লাল দেওয়াল লিখনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু বেশী তফাৎ রেখে হাঁটত এই ঘটনার পর থেকে।

হোস্টেলে আলোচনার বিষয়বস্তুর মাথামুণ্ডু কোনদিনই ছিল না। একদিন কি ভাবে যেন আলোচনা এসে আটকে গেল সিগারেটে। তার নানান তত্ত্ব এবং তথ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করার সাথে সাথে সবাই সিগারেট খেতে খেতেই মেনে নিলো সিগারেট খওয়া খুবই খারাপ – ভাবখানা এমন যেন এই প্রথম জানতে পারল। অরুণ-দা কদাচিৎ সিগারেট খেত। অরুণ-দা বলল, অনেক হল, তোমরা কেউ একটা পুরো সিগারেট খেতে পারবে একটুও ছাই না ফেলে?

তারপরে যা হবার তাই হল। প্রথমে, এই কথার মধ্যে কোন প্যাচ আছে কিনা? – তা নিয়ে যাচাই। তারপরে কিসের সাহায্য নেওয়া যাবে, বা যাবে না – তা নিয়ে বিশদ তর্ক। অরুণ-দার বক্তব্য পরিষ্কার – একটা সিগারেট ধরাও, সেটাকে টেনে শেষ করো, শেষে দেখাও যে পুরো তামাকটা ছাই হয়ে গেছে এবং সে ছাই একটুও পরে নি। এবার যেভাবে পারো – করো।

এই বিষয়টা সবার মনে পরিষ্কার হতে প্রায় পনের-কুড়ি মিনিট সময় লেগেছিল। তার ফল হয়েছিল দুটো – যারা প্রথমদিকে এনিয়ে নিঃস্পৃহ ছিল, তারও এতে অংশ নিয়েছিল এবং ঠিক হয়েছিল যে সবাই একটাকা করে জমা দেবে আর যে বা যারা এটা করতে পারবে তারা পুরো টাকাটা পাবে।

তখন কেউ পাইপ নিয়ে এলো, কেউ কাঁচের হুঁকা নিয়ে এলো। এরপরে ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ হল, ফ্যান অফ করা হল। অরুণ-দা সহ জনা দশেক বসে গেল সিগারেট নিয়ে। আমিও এই প্রচেষ্টায় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু, অরুণ-দা আমাকে চোখের ইশারায় মানা করে বলেছিল, তুমি এর জাজ হয়ে যাও। সবাই দু-তিন হাত দূরে দূরে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। সে তো সিগারেট টানা নয় – যেন প্রজাপতির ডানায় চুমু খওয়া যাতে সে ডানার পরাগ না খসে পরে।

ঘরের মধ্যে ধোয়ায় একাকার, আর টানটান উত্তেজনা। একমিনিটের মধ্যেই কয়েকজন আউট হয়ে গেল, তাদের কেউ কেউ আবার রি-এন্ট্রি নিলো অতিরিক্ত একটাকা দিয়ে। অরুণ-দা নিজের বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে ধীর গতিতে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই একে একে আউট হওয়ার পালা শুরু হল। দুজন প্রায় শেষ অবধি এসেছিল তবে শেষ রক্ষা করতে পারে নি। অরুণ-দা সিগারেটের পুরোটা শেষ করে ফিল্টারের উপর একটা ছাইয়ের স্তম্ভ আস্তে করে টেবিলের উপরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে বলল, এবার টাকাগুলো তুলে রাখো, আমি তোমার কাছ থেকে পরে নিয়ে নেব।

সবাই টেবিলের চারিদিকে গোল করে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছে। অরুণ-দা বলল, একটু সরে দাঁড়াও।

একজন তিন বার এন্ট্রি নিয়েও কিছু করতে পারে নি। সে বলল, ওটা নিশ্চয় সিগারেটের ছাই নয়।

অরুণ-দা বলল, দেখো – আমি তো সিগারেট খাই না। তোমাদের মধ্যেই কেউ আমাকে দিলে, তাকেই জিজ্ঞেস করো।

ঘরে প্রচণ্ড ধোয়া, সবার চোখ জ্বলছে। দরজা, জানালা খুলে দেওয়া হল। একে একে সবাই বিদায় নিলো সেখান থেকে। ফিল্টারের উপর ছাইয়ের স্তম্ভ তখনো ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে আছে।

অরুণ-দা আমাকে বলল, এবার দরজাটা লাগিয়ে দাও।

অরুণ-দার এই ধরনের গুণাবলির শেষ নেই। আমি এই মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম এতক্ষণ। দরজাটা বন্ধ করেই এক লাফে অরুণ-দার পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা যে সত্যি সিগারেট সেটা আমি জানি; কিন্তু করলে কি করে?

অরুণ-দা আরো রহস্য করে বলল, ওটাকে আস্তে করে তুলে কাত করো, দেখবে তাও পরবে না।

দেখলাম সত্যি তাই – এবার ব্যাপারটা আমার কাছে ম্যাজিকের মত মনে হতে লাগল। ভাবলাম, তাহলে এটা কি সত্যি সিগারেট? যে ছেলেটাকে হেঁসে উড়িয়ে দিলাম – ওই কি সত্যি ছিল। এইরকম ভাবতে ভাবতে আমি ছাইটাকে চেপে দেখতে যাব, এমন সময় অরুণ-দা বলল, সাবধানে, ভেতরের ছুঁচটা এখনো গরম থাকতে পারে।

এই ছিল অরুণ-দা। ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম যে অরুণ-দা ছয়-মাস কলকাতা মেডিকাল কলেজে পড়ে টাকার অভাবে তাকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। পরের বছর তার সখের বিষয় বাংলা নিয়ে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হয়েছিল। একদিন এনিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, অর্থ উপার্জনের বিষয় নিয়ে যখন পড়া হল না ঠিক করলাম সখের বিষয় নিয়েই পড়ি।

— শেষ —