Home » ছোট গল্প » চতুর্দশী » সুপারের ধনে ফুল

সুপারের ধনে ফুল

সেদিন শনিবার রাত। হস্টেলে আমারা কয়েকজন বসে ব্রিজ খেলছিলাম। আমাদের বিপক্ষ দলে একজন ছিল যে খুব ভালো ব্রিজ খেলত, তবে সে এই খেলাতে কোন রকম ভুল সহ্য করতে পারত না। তাই কিছুক্ষণ পর পর ওর সাথে ওর পার্টনারের কল দেওয়া নিয়ে তর্ক বেঁধে যাচ্ছিল। এইরকম ভাবে কিছুক্ষণ খেলার পরে আমরা সে রাতের মত খেলা শেষ করলাম। তারপর যেকোনো কারণেই হোক সবাই তাড়াতাড়ি শুয়েও পরলাম।

পরের দিন রবিবার – বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার বয়স সেটা নয়। দেখলাম, বেশ অনেকেই উঠে গেছে ততক্ষণে – এরা বেশীর ভাগই সকাল সকাল ওঠে। আমি উঠে পরলাম। দুর্গা পূজা তখন দেড়ি আছে – তবে সকালের দিকে একটু একটু ঠাণ্ডা পরতে শুরু করেছে – এক-আধটু শিশিরও পরে ভোরের দিকে। ঘুম ভাঙতেই উঠে হাটতে হাটতে ডাইনিং হলের ছাদের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। এই ছাতের পাশেই সুপারের উঠোন – সেখানে দাঁড়ালে পুরো উঠোনটা একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। সেকারণে আমরা সচরাচর সেখানে যেতাম না – কে যেচে সুপারের পাল্লায় পরতে চায়? কি কারণে সেখানে গিয়েছিলাম তা এখনো জানি না। যাহোক, নজরে এলো সুপারের উঠানে এক ফালি বাগান – তাতে বেশ কিছু ধনে শাকের গাছ – তার মাথায় ছোটো ছোটো ধনে ফুল ফুটে আছে। এমনিতে সেটা চোখে পরার মত কোন বস্তু বা দৃশ্য নয়, কিন্তু সকালের রোদ, কিছুটা আলোছায়া এবং শিশির পরায় সেটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি – এমন সময় কতগুলো শব্দ মাথার মধ্যে বয়ে গেল – সুপার, ধনে, এবং ফুল।

আমার কাছাকাছি যারা ছিল, ডাকলাম – ওরে স্বপন দেখে যা, সুপারের ধনে ফুল ফুটেছে। অরূপ, সুজিত, টুটু – দ্যাখ দ্যাখ, স্যারের ধনে ফুল ফুটেছে। বলতে বলতেই বেশ কয়েকজন জুটে গেল সেখানে। তারপর বিশেষ কিছু করতে হয়নি আমাকে। সবার মুখে মখে এই কথা চলছে।

এই সোরগোলে সুপার বেরিয়ে এসেছেন। এইখানে সুপারের সম্পর্কে দুএক কথা বলা প্রয়োজন। যে যে কাজগুলো করা ওনার দায়িত্বের মধ্যে পরে, যেমন বাথরুমের ভেঙ্গে পরা দরজা মেরামত করানো, অকেজো টিউবওয়েলগুলো ঠিক করানো, রান্নাঘর-ডাইনিং হল এতই নোংরা যে আরশোলাও সেখান থেকে পালিয়েছিল তাদের স্বাস্থ্যের কারণে, বা গরীব ছাত্রের স্টাইপেন্ড পেপার সময়মত উপর তলায় পাঠানো – সেসবে কোন নজর ছিল না। ওনার কাজ ছিল খুনসুটি করা – যেমন কোন ছেলে কোন মেয়ের সাথে ভাব-ভালবাসা, কে সিগারেট খেতে গিয়ে জামার এক কোনা পুরিয়ে ফেলেছে, কে জোরে চিৎকার করে, কার বাবা বেশী হাত খরচা পাঠায় ইত্যাদি টিচার্স রুমে গিয়ে বলা এবং কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে সাপ্তাহিক রিপোর্ট দেওয়া। আর বোর্ডাররা কিছু বললেই সোজা প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ। অনেকটা বাড়ীর আদুরে ছেলে – বাবা বাড়ীতে এলেই কাছে গিয়ে নালিশ করা ও অন্যদের নামে লাগানোর মত ব্যাপার।

সুপার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি করছ ওখানে?

ছাতের উপর থেকে প্রথম উত্তরটা গেল – দেখুন স্যার, ধনে গাছে ফুল ফুটেছে। কি ভালো লাগছে!

– ঠিক বলেছো। বলে উনিও সেটা দেখতে থাকলেন।

ততক্ষণে ছাতে আরো কয়েকজন এসে গেছে। সুপারের মুখে একটা হাঁসি – যেন বিশাল কিছু একটা করেছেন। এদিকে ছাতের উপর একজন দুজন করে চলেই আসছে – এমন কি নিচের তলা থেকেও ছেলেপুলে আসছে – যেন এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় না কেউই – এমনই একটা ভাব সবার মধ্যে। যারা বুঝতে পেরেছিল, কি হতে চলেছে – তারা অপেক্ষা করছে শেষটা দেখার জন্যে। যারা বুঝতে পারছিল না – তাদের কৌতূহলের শেষ নেই – সুপারের ধনে ফুল ফুটেছে তো কি এমন ব্যাপার? তারাই বেশী করে বলছিল – স্যারের ধনে ফুল ফুটেছে তো কি হয়েছে? সবমিলিয়ে সেখানে বেশ ভিড়, আর সবাই দেখছে ওই একই জিনিস – সুপারের ধনে ফুল ফুটে আছে। যেই নতুন কেউ সেখানে আসে, সবাই তাকে জায়গা করে দেয় আর দুই ফুট বাই তিন ফুট বাগানের দিকে দেখিয়ে বলে – ওই দ্যাখ, স্যারের ধনে ফুল ফুটেছে।

এতক্ষণে সুপারের বুদ্ধির দরজার তালা খুলেছে – বলে মনে হল। আমি তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে পুরো দিনের সূর্যের গতিবিধি দেখেছিলাম সেদিন – শুরু হয়েছিল সূর্যোদয় দিয়ে – কি হাঁসি তাতে, নিজের ধনে ফুল দেখে; তারপরে মাঝ সকালের সূর্য – হাঁসির সেই স্নিগ্ধতা নেই আবার সে তেজোবানও নয়; তারপরে মাঝ দুপুরের সূর্য – প্রচণ্ড তেজে ফেটে পরছে, কিন্তু সে তেজ কাকে দেখাবে? এবার সেই সূর্য ঢলে পরার পালা – তাঁর তেজ কমে গেছে, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। উনি মুখ নিচু করে এটা সেটা করছেন – একেবারে অস্ত যাবার আগের কিছুটা সময় কাটাচ্ছেন। এদিকে ছাতের উপর একই কথা হয়ে যাচ্ছে – স্যারের ধনে ফুল ফুটেছে।

সূর্য অস্ত গেল যখন ভিতর থেকে ডাক এলো

– কি করছো ওখানে? ভিতরে এসো। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে।

সূর্যের উদাহরণে এইখানে একটা অমিল আছে যদিও। সূর্যোদয়ের সূর্য অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে আর সূর্যাস্তের সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পরে। আমাদের সুপার উদয় হয়েছিলেন এক পা এক পা করে ধীরে ধীরে, আর অস্ত গেলেন দুই লাফে একেবারে ঘরের ভিতর। লোকমুখে শুনেছি, সুপার যথারীতি প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করেছিলেন।

এর পরেরটা আমাদের কল্পনা।

সুপার বলছেন, এই বোর্ডারদের নিয়ে আর পারছি না, স্যার।

প্রিন্সিপাল – কেন? আবার কি হল?

সুপার – আমার ধনে ফুল ফুটেছে, কাল সকালে।

প্রিন্সিপাল – কি?!