Home » ছোট গল্প » বিমল দাস » রেল স্টেশনের নাম

রেল স্টেশনের নাম

সে বছর পার্টির জাতীয় সম্মেলন ছিল উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে। পুরী-ভুবনেশ্বরের সাথে বাঙালীর চিরকালের একটা হার্দিক যোগাযোগ আছে। তাই জাতীয় সম্মেলন সফল করতে কলেজের ছাত্র ও বেকার যুবকেরা, কেউবা আবার সপরিবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রেন বোঝাই লোক গেল মালদা থেকে প্রথমে হাওড়া, তারপর সেখান থেকে ভুবনেশ্বর।

সেদিন হাওড়ায় ভুবনেশ্বরগামী যত ট্রেন ছিল সেগুলোর জেনারেল বগিগুলোতে পার্টির ঝাণ্ডা লাগিয়ে পার্টির সদস্যরা উঠে পড়ল। তারই একটাতে বিমল দাস উঠলেন তাঁর সতীর্থদের নিয়ে। একসময় ট্রেন চলা শুরু করল। প্রায় সব স্টেশনে থামতে থামতে সন্ধা রাতে ট্রেন মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল ভুবনেশ্বরের দিকে। ট্রেন যখনই কোন স্টেশনে থামে, সবাই মিলে জোর কদমে পার্টির স্লোগান দেয়। ট্রেনের ভিতরে বেশ উত্তেজনা তখন। এইভাবে বেশ অনেকক্ষণ চলল।

ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকল। তখন ছোট স্টেশনগুলোতে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। কাকেই-বা শোনাবে পার্টির স্লোগান? তাই স্লোগান দেওয়ার উত্তেজনা একটু একটু কমে এল। তারপর একে একে সকলে যে যার মত শুয়ে পড়ল। বিমল দাসও মাঝের একটা বাঙ্কে একটা চাদর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়ে শুয়ে পরলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে কারুরই ঘুম আস্তে তেমন দেরী হল না।

তখন রাত প্রায় তিনটে মত হবে। ট্রেনটা অনেকক্ষণ ধরে একটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন ঠেমে গেল ট্রেনের পাখাগুলো খুব ধীরে ধীরে ঘোড়ে। গরমে অনেকেরই ঘুম কিছুটা ভেঙ্গে গেছে, কেউ কেউ উসখুস করছে। সকলের মধ্যে একটা স্বাভাবিক কৌতূহল – ‘কি হয়েছে?’ এমন সময় উঠতি নেতা গোছের একজন উঠে কামরার ভিতরের লাইট জ্বেলে দিল – ভাবখানা এমন যেন তাতেই বাইরের সব কিছু পরিষ্কার বোঝা যাবে। এতে আরও কয়েকজনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবার সবাই মিলে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল যে, এইটা কোন স্টেশন? কামরার জানালা তোলা হল। সবাই উঁকি দিয়ে স্টেশনের নামটা খোঁজার চেষ্টা করল। একসময়ে বিমল দাসও মাথা থেকে চাদর নামিয়ে মাঝের বাঙ্কে জানালার যে অংশটুকু থাকে সেই ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন।

সেই সময়ে সেখানে ‘আমরা বাঙালী’র মত হয়ত ‘আমরা উড়িয়া’ গোছের কোন দল গজিয়ে উঠেছিল। তারা স্থানীয় উপকারী কাজ কি করেছিল তা জানা নেই। তবে তাদের উপস্থিতিটা প্রকটভাবে প্রকাশ করার জন্যে রেলস্টেশনের হলুদ রঙের বোর্ডগুলোতে উড়িয়া ছাড়া বাকি হিন্দি এবং ইংরাজি ভাষায় যা লেখা ছিল সেই লেখাগুলোর উপরে আলকাতরা লেপে কালো করে দিয়েছিল। উড়িয়া ভাষা না-জানা থাকায় কারুর পক্ষে সেখান থেকে কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হল না।

সেটা যে কোন স্টেশন তা না-জানলেও তখন কারুর কিছুই যায়-আসে না। স্টেশনটা যে ভুবনেশ্বর স্টেশন নয় তা সকলেই জানে। কিন্তু, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি – যেখানে যত বেশী বাধা সেইখানে তত বেশী কৌতূহল। সুতরাং সঙ্গত কারণেই সকলের জেদ বেড়ে চলল এবং তার সাথে উঁকি-ঝুঁকিও বাড়ল, অনেক নীতি কথা বেরিয়ে এলো, মাতৃ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানার কতখানি প্রয়োজন তা নিয়েও কথা হল। যেটা নিয়ে কেউ কোন কথা তুলল না, তা হল, হাওড়া স্টেশনে যে উড়েগুলোকে তাড়িয়ে এই কামরা দখল করেছিল তাদের কয়েকজনকে যদি কামরায় উঠতে দিত তাহলে তারা সহজেই এই সমস্যার সমাধান করে দিত। সে যাহোক, সব ডম্ফানি চলল ট্রেনের কামরার মধ্যে থেকে।

এমন সময় এক চা-ওয়ালা সেখান দিয়ে চা ফেরি করতে করতে যাচ্ছিল। জানালার ভিতর থেকে তাকে ডেকে বিমল দাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ভাই চা-ওয়ালা, এটা কোন স্টেশন হে?’ চা-ওয়ালা উত্তর দিল, ‘বালেসর’।

আলকাতরা দিয়ে হিন্দি ও ইংরাজি ভাষায় স্টেশনের নাম মুছে দেওয়ার মত আহাম্মকি কাজের জন্যে সকলেই অত্যন্ত বিরক্ত। চা-ওয়ালার উত্তর শুনে বিমল দাস একটা সগতোক্তি করলেন, ‘ওই জন্যেই লেখাগুলো ওইরকম কোঁকড়া কোঁকড়া দেখাচ্ছিল’। এই বলে, উনি চাদর টেনে আবার শুয়ে পড়লেন। সারা কামরার ছেলেপুলে তখন না-পারে হাসি চাপতে, না-পারে হাসতে। এমন সময় ট্রেনটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে শুরু করল।

— শেষ —