Home » ছোট গল্প » বিমল দাস » প্রধান সেনাপতির পদ

প্রধান সেনাপতির পদ

একদিন পার্টির একদল যুবক সদস্যরা বিমল দাসকে একদফা বলে গেল যে পার্টির উপরের তলায় যেসব বুড়োভামগুলো আছে তাঁরা না করে কোন কাজ, না আমাদের কিছু করতে দেয়, না ছাড়ে পদ। এইসদ আপদগুলো অবসর না নিলে পার্টির কিচ্ছু হবে না।

‘তোদের রাগের কারণটা বুঝি।’ বিমল দাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে ওনি পদ থেকে সরে গেলে, কে চালাবে সেটা?’

একজন বলল, ‘কেন? আমাদের মধ্যে কি কোন যোগ্য ক্যান্ডিডেট নেই?’

বিমল দাস বললেন, ‘তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল। পরের ভোটে সেরকম একজনকে দাড় করিয়ে দিস। আর অতদিন যদি অপেক্ষা না করতে চাস, তাহলে তারও ব্যবস্থা আছে। সবাই মিলে একটা পিটিশন কর।’

আরেকজন বলল, ‘সেটা তো করেই ফেলতাম। কিন্তু অত সিনিয়র লোকের বিরুদ্ধে… ।’

বিমল দাস বললেন, তা হলে শোন –

একদেশে এক ভয়ঙ্কর প্রভাব ও প্রতিপত্তিশীল রাজা ছিলেন। তাঁর প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রধান কারণ ছিল তাঁর বিরাট সেনা বাহিনী। এই সেনা বাহিনীর ভয়ে আসেপাশের রাজ্যের রাজারা তাঁকে বেশ সমীহ করে চলতেন। স্বাভাবিক কারণে রাজা তাঁর প্রধান সেনাপতিকে অন্যদের তুলনায় একটু বিশেষ খাতির করতেন। আর সেইকারণে রাজসভায় অন্যান্য মন্ত্রীদের থেকে প্রধান সেনাপতির দাপটটাও ছিল একটু বেশী।

প্রধান সেনাপতি নিজে সারা রাজ্য থেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ছেলেদের এনে যুদ্ধবিদ্যা শিখিয়ে এই সেনা বাহিনী তৈরি করেছিলেন। বলা যায়, এই সেনা বাহিনীর ছোট-বড় সব মাথাগুলো প্রধান সেনাপতির শিষ্য। রাজা জানতেন, প্রধান সেনাপতি তাঁর অত্যন্ত অনুগত, তাই সেদিক থেকে রাজার কোন দুশ্চিন্তা ছিল না।

দিন যায়, বছর কাটে – রাজ্যের সকলেই সুখে শান্তিতে বাস করে। এইভাবে চলতে চলতে একসময় রাজার বয়স বাড়ল। অনেক পুরানো মন্ত্রী মারা গেলেন, কেউ কেউ অবসর নিলেন। খালি পদে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ হল। কিন্তু প্রধান সেনাপতির কোন নড়ন-চড়ন নেই। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। আগের মত দ্রুত হাঁটতে পারেন না, বরং কিছুটা ঝুঁকেই হাঁটেন। প্রধান সেনাপতি অবসর নিলে যারা নিজেদের সেই পদের দাবিদার বলে মনে মনে ভাবে, তারা নিজের মনের মধ্যে গজগজ করলেও কেউ কিছু বলতেও পারে না। একে তো রাজামশাই প্রধান সেনাপতিকে একটু বেশী খাতির করেন এবং দ্বিতীয়ত এই প্রধান সেনাপতি হলেন তাদের গুরুদেব।

রাজ্যে তখন এই নিয়ে বেশ কানাঘুষো ও ফিসফাস চলছে। এমনকি রাজার কানেও সে কথা গেছে। যেহেতু রাজ দরবারে এই নিয়ে কেউ কোন প্রসঙ্গ তোলে নি তাই রাজসভাতে এই নিয়ে কোন আলোচনাও ওঠে নি। এইভাবে আরও কয়েক বছর পার হয়ে গেল। ওদিকে সেনা বাহিনীর উচ্চমহলে এই নিয়ে প্রতিদিন তুমুল আলোচনা চলে, কিন্তু কারুরই সাহসে কুলোয় না যে, রাজ দরবারে এই প্রসঙ্গ তুলবে।

একদিন এক সহ-সেনাপতি, সেনা বাহিনীতে যার অনেক নাম ডাক আছে, এবং যাকে প্রধান সেনাপতি নিজেও অনেক তারিফ করেছেন, সে রাজ দরবারে এসে বলল, ‘প্রণাম মহারাজ। প্রণাম গুরুদেব। আমি এবং সেনাদলের অন্য সেনাপতিরা আমাদের প্রধান সেনাপতির শিষ্য তা আপনারা সকলেই জানেন। গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি যে, গুরুদেবের বয়েসের কারণে ওনার প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অবসর নেওয়া উচিৎ এবং আমাদের মধ্যে থেকে উপযুক্ত একজনের প্রধান সেনাপতি হওয়া উচিৎ।’

রাজার কাছে এই কথাটা রাজার চর অনেকদিন আগেই বলে গিয়েছিল। রাজা তখন প্রধান সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেনাপতি মশাই, এই ব্যাপারে আপনার কি মতামত?’

প্রধান সেনাপতি তাঁর দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘মহারাজ, এই সহ-সেনাপতির সৎ সাহস দেখে আমি মুগ্ধ এবং এই ব্যক্তি সত্যি প্রধান সেনাপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে এত বড় রাজ্য রক্ষার ভার একটু যোগ্যতা বিচার না-করে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?’

রাজা বললেন, ‘তা ঠিক। তবে যোগ্যতা বিচার কি করে করা যায়?’

প্রধান সেনাপতি বললেন, ‘খুব সহজ। আমার সাথে মল্লযুদ্ধে যদি জিততে পারে তবেই বোঝা যাবে যে আমার থেকে সে বেশী যোগ্য। এখন সব সেনাপতিরা মিলে ঠিক করে নিক কে এই পদে বসতে চায়।’

রাজা এই শুনে উচ্চপদস্থ সেনাবাহিনীর লোকদের আগামী সপ্তাহে প্রধান সেনাপতি পদের দাবিদারের নাম জানাতে নির্দেশ দিলেন। রাজসভা সেইদিনের মত সেইখানেই মুলতুবি হল।

সারা রাজ্যে তখন টানটান উত্তেজনা। পরের সপ্তাহে যথা সময়ে রাজসভা বসল। সেইখানে সেই সহ-সেনাপতির নাম এল ভবিষ্যত প্রধান সেনাপতি পদের দাবিদার হিসেবে। রাজামশাই সকলের সাথে আলোচনা করে দিনক্ষণ দেখে মাস খানেক পরে মল্লযুদ্ধের দিন ও স্থান ঠিক দিলেন।

প্রধান সেনাপতি সকলের সামনেই বললেন, ‘মহারাজ,দয়া করে আপনি অস্ত্রাগারের প্রধান কামারকে আজ বিকেলে একটু আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। তাকে আমার একটু বিশেষ দরকার, এই মল্লযুদ্ধ প্রস্তুতির জন্যে।’

রাজামশাই বললেন, ‘সে নিশ্চয়ই যাবে।’ এই বলে তক্ষনি তিনি প্রধান কামারকে সেই মত নির্দেশ পাঠালেন। রাজসভা সেইদিন সেইখানেই শেষ হল।

রাজ্য সুদ্ধ সব লোকের মুখে একই কথা, একই আলোচনা। আলোচনা অন্য রাজ্যেও পৌঁছে গেল। সকলে আফসোস করল যে, প্রধান সেনাপতি বৃদ্ধ হয়েছেন, এখন কেন যে যুবকের সাথে মল্লযুদ্ধ লড়তে যেতে চান? কেউ কেউ বলল, ওনার মাথার ঠিক নেই। তা নাহলে কেউ যেচে এইরকম কাজ করতে যায়। চারিদিকে একই আলোচনা আর নানান কথাবার্তা।

সহ-সেনাপতি দুইদিন পরে চুপিচুপি প্রধান কামারের কাছে গেল। বলল, ‘দ্যাখো বাপু, এই মল্লযুদ্ধের পরে আমি হব প্রধান সেনাপতি। তাই, প্রাণে যদি বাঁচতে চাও তো এখনি বল প্রধান সেনাপতি তোমাকে কি বানাতে বলেছে।’ এই বলে, সহ-সেনাপতি কামারকে অনেক টাকা – এককথায় ঘুস – দিল।

অস্ত্রআগারের প্রধান কামার প্রথমে রাজি না হলেও পরে প্রাণ ভয়ে বলেই দিল। সে বলল, ‘প্রধান সেনাপতি তাকে একটা বারো হাত লম্বা তলোয়ারের খাপ বানাতে বলেছেন।’

সহ-সেনাপতি প্রধান সেনাপতির চালটা পরিষ্কার বুঝতে পারল। ভাবল, গুরুদেবের কাছে নিশ্চয়ই বারো হাত লম্বা তলোয়ার আছে, শুধু খাপটা নেই। মল্লযুদ্ধে ও ওনার কাছে আসার আগেই বারো হাত দূর থেকে ওর বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেবে। সহ-সেনাপতি তখন কামারকে ওর জন্যে পনের হাত লম্বা একটা তলোয়ার আর পনের হাত লম্বা তলোয়ারের খাপ বানাতে নির্দেশ দিল এবং প্রধান সেনাপতি যেন কিছুতেই এই খবর না পায় তাও বলে গেল।

বিরাট মাঠের মাঝখানে উঁচু একটা স্টেজ তৈরি হল যাতে বহুদূর থেকে এই মল্লযুদ্ধ দেখা যায়। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বসার বিশেষ ব্যবস্থা হল।

নিদিষ্ট দিনে সারা মাঠ লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে বাজি-পটকা ফাটছে, ভেঁপু বাজছে। রাস্তায় মেলা বসে গেছে। সবার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর উত্তেজনা। সকলে বসে যাওয়ার পরে মহারাজ এলেন। চারিদিক তখন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। মহারাজ সিংহাসনে বসলেন। স্টেজ তখনও ফাঁকা। মহারাজ ডান হাত তুলে নির্দেশ দিলেন। ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজল। স্টেজের দুই দিক থেকে দুই যোদ্ধা স্টেজের উপরে উঠে এলেন, একজন প্রধান সেনাপতি আর একজন সহ-সেনাপতি। প্রধান সেনাপতির কোমরে ঝুলন্ত বারো হাত লম্বা তলোয়ারের খাপের উপরে তলোয়ারের হাতলটা দেখা যাচ্ছে। আর সহ-সেনাপতির কোমরে ঝুলন্ত পনের হাত লম্বা তলোয়ারের খাপ তার থেকে তলোয়ারের চকচকে হাতলটা দেখা যাচ্ছে। দুজন দুজনকে কুর্নিস করে মল্লযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হল।

মহারাজ ডান হাত তুলে নির্দেশ দিলেন। ঢং করে আরেকটা ঘণ্টা বাজল। দুই যোদ্ধা দুজনের একটু কাছাকাছি এগিয়ে এল। তখন কারুর চোখের পলক পরছে না। দুজনেই একসাথে যে যার নিজের তলোয়ারের হাতলটা শক্ত করে ধরল। সবাই দেখল বৃদ্ধ প্রধান সেনাপতির তলোয়ার বের করতে সময় লাগছে। এদিকে সহ-সেনাপতি এক ঝটকায় প্রায় তিন হাত মত তলোয়ার বের করে নিয়েছে কিন্তু বাকিটা তখনও পনের হাত লম্বা তলোয়ারের খাপের মধ্যে আটকে আছে। বৃদ্ধ প্রধান সেনাপতি ধীরে ধীরে নিজের বারো হাত লম্বা তলোয়ারের খাপ থেকে আড়াই হাত লম্বা তলোয়ার বের করে সহ-সেনাপতির বুকে সোজাসুজি ঢুকিয়ে দিল। সহ-সেনাপতি তখনও পনের হাত লম্বা খাপের ভিতর থেকে পনের হাত লম্বা তলোয়ার বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বিস্ময়ে সহ-সেনাপতি জিজ্ঞেস করল, ‘গুরুদেব, আপনি তো বারো হাত লম্বা খাপের মধ্যে আড়াই হাত লম্বা তলোয়ার রাখার বিদ্যাটা আমাদের কখনো সেখান নি!’

এই বলে বিমল দাস থামলেন। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার বল, রাজা কাকে প্রধান সেনাপতির পদে বহাল রাখবেন এরপর?’

— শেষ —