বেফাঁস কথা বলে সারা জীবনে কখনো একবারও বিপাকে পড়েনি এইরকম লোকের উদাহরণ পাওয়া খুবই মুশকিল। আমিও এর কোন ব্যতিক্রম নই। তবে তার শাস্তি যে কি রকম ভয়ানক হতে পারে, তাই বলি।
স্কুল পাস করে একবার ছোটদের বিজ্ঞান গোছের এক মাসিক পত্রিকায় লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার জেরবার হয়ে গিয়েছিল। প্রথম কয়েকটা সংখ্যায় বেশ লিখলাম। তাই দেখে সম্পাদক আমাকে বেশ একটা নিষ্ঠাবান লেখন-দার ভেবে বসে ছিলেন। তখন পরীক্ষা এসে গেছে সামনে, এদিকে পাসের পড়া তৈরি হয়নি। তার মধ্যে প্রতিমাসেই সেই সম্পাদকের হানা। শুধু তাই না, তিনি নানা প্রতিযোগী পত্রিকা আমাকে দিয়ে যেতেন, যাতে আমার লেখা ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে সেই লেখাগুলোর কোন কপি না হয়ে যায়। এদিক সেদিক থেকে মূল বিষয়বস্তু নিয়ে যে ইনিয়ে বিনিয়ে চালিয়ে দেব – তার উপায় নেই। পাশের পড়া তৈরি করার পাশাপাশি এই নতুন লেখা মাথা খুঁড়ে বের করতে – তাও আবার ছোটোদের উপযোগী হওয়া চাই – আমার জেরবার হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক করেছিলাম, এই চক্করে আর ভুল করেও পরছি না। আর পাঁচজনের মতই কবিতা-গল্প-উপন্যাস ভালো লাগলে পড়ি, তা নিয়ে দু-চারটে কথাও বলি – তার বেশী আর কোন বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করতাম না।
আমার ঠিক পাশের ঘরে থাকত সঞ্জয় চাটার্জি। হোস্টেলে পাশের ঘরের ছেলেদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব না থাকলে প্রতি পদে পদে বিপদ। সেই কারণেই হোক বা, অন্য কোন কারণে হোক, ওর সাথে আমার সখ্যতাটা বেশ ভালো ছিল। যে কারণে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের গভীরতা বেড়েছিল সেটা হল, ও আমাকে ওর কবিতার একটা ভালো সমালোচক ভাবত – কেন যে ভাবত তা আজো আমার অজানা থেকে গেছে। রাতে শুতে যাব, সঞ্জয় এসে বলল, একটু অপেক্ষা কর। চলে এলো একটা কাগজ নিয়ে আট-বারো-ষোল লাইন শুনিয়ে চলে গেল। আমার মত আরও কয়েকজন ছেলে ছিল যাকে ও কবিতা শোনাত। ওর কবিতার মধ্যে আমার ভালো লাগত যে তাতে একটা ঝরঝরে বর্ণনা আর সর্পিল গতির একটা ছন্দ থাকত – এমন ছন্দ যেটা অনুভব করা যায়, বোঝা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। বর্ণনার সাথে এই ছন্দের লুকোচুরিটা ওর কবিতাগুলোকে একটা অন্য মাত্রা এনে দিত।
একদিন প্রচলিত তর্ক শুরু হল যে কোন আধুনিক কবিতাই নাকি বোঝা যায় না, ঠিক যেমন কোন আধুনিক চিত্রও বোঝার বাইরে। তাহলে এসব কাদের জন্যে বানানো? বেশিরভাগ লোক না-বুঝেই আহা কি ভালো কি ভালো করে, কারণ অনেক নামি লোক সেরকম বলে গেছে। সঞ্জয় ওদের সাথে লড়ে যাচ্ছে যে সবাইকে এক ঝুড়িতে ফেলা ঠিক না। অনেকে এই রকম করে, তবে আধুনিক কবিতা বা ছবি অনেক উন্নত, এটা একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপক্ষ দল খুব সস্তা উদাহরণ টেনে সঞ্জয়কে হেনস্থা করে যাচ্ছে। এদিকে সঞ্জয় প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে ওর অভিমত প্রমাণ করার জন্যে। পাশের ঘরের বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো আমার একটা নৈতিক কর্তব্য – শুধু এই জায়গা থেকে, আমি ওর পক্ষ নিলাম। বললাম, বেশ তোরা একটা পরিষ্কার উদাহরণ দে। ফস করে কোত্থেকে সুভাস মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই টেনে শেষ পাতা খুলে বলল, এটার সম্বন্ধে কি বলবি? চার পাতা জুড়ে এ যাচ্ছি, ও যাচ্ছি, সে যাচ্ছি বলে দুনিয়ার লিস্ট দিয়ে গেল আর শেষ দুই লাইন – ও মায়া আসছি, ও মিউ। এতো তোদের অনেকের গুরুদেব আধুনিক কবি, এলেবেলে কাউকে নিয়ে বলছি না। সঞ্জয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে আমি ফস করে দুটো বেফাঁস কথা বলে ফেলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছিলাম। বললাম, ভাব একটা লোক সবাইকে গুডবাই বলে চলে যাচ্ছে; কিন্তু একটা বেড়ালের কাছে এসে আর পারল না। তার কাছে আবার ফেরত আসার আকাঙ্ক্ষা রেখে গেল। শুধু ‘আসছি’ কথাটা একবার ব্যবহার করে বিষয়টাকে কিরকম একটা রহস্য করে তুলেছেন ভাব একবার। সবাই একটু চুপ, ততক্ষণে কবিতাটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। এর পরের যেটা বললাম সেটা আরও মারাত্মক। বললাম, দেখ কি সুন্দর ভাবে এর ছন্দটা বড় থেকে ছোট করে এনেছে। সঞ্জয় আমার কাছ থেকে বইটা নিয়ে কবিতাটা জোরে জোরে পড়তে লাগল – ‘যাচ্ছি’। সঞ্জয়ের পড়া শেষ হল, আর একে একে সবাই কেটে পড়ল।
সঞ্জয় আমাকে টেনে ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা বই প্রায় তখনই পড়িয়ে ছাড়বে। বইটা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা, ছন্দ কি?… ও চা খাওয়াল, সাথে চানাচুরও দিল। কিন্তু আমাকে তখনই বইটা পড়তে হবে। কি করে ওকে বোঝাই যে, আমার পড়ে বা শুনে ভালো লাগলে সেটা আমার কাছে ভালো, না হলে আমি সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাই। ছন্দকে ডিসেক্সন করে ছন্দ জেনে আমার কি হবে? বুঝতে পারলে আমার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডি এলো রায়, জীবনানন্দ, শক্তি, সুভাস এবং সঞ্জয় সবই ভালো লাগে, আর না বুঝতে পারলে, ও দিকে ভুলেও তাকাই না। পাঠক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করি, লেখক-কবি হিসেবে তারা যদি সেটা না পালন করেন তো দুজনেরই লস। আবার সব যে আমার বোধগম্য হবে তারও কোন মানে নেই। ওর আতিথেয়তা আর উৎসাহের দিকে পুরো নজর রেখে ইনিয়ে বিনিয়ে এই কথাটা বোঝনোর চেষ্টা করে যখন সফল হলাম না, তখন বইটা কয়েকদিনের জন্যে ধার নিয়ে প্রাণ নিয়ে তখনকার মত পালালাম।
ভেবেছিলাম, ওর তাৎক্ষণিক উৎসাহ কমে গেলে সাত-দশ দিন পরে বইটা ফেরত দিয়ে দেব। বেফাঁস কথা বলার যে এইরকম শাস্তি হতে পারে তা আমার ধারনা ছিল না। তারপরে সঞ্জয় রোজ আমাকে মোটামুটি পড়া ধরার মত করে জিজ্ঞেস করত কত পাতা অবধি আমার পড়া হল এবং তা নিয়ে বিশদ আলোচনা। কি করে ওকে বোঝাই যে, আমি মালদহের ছেলে – আমের জায়গায় বড় হয়েছি – পাকা আম মিষ্টি হলে, আর কাচা আম টক হলে ভালো লাগে, উল্টোটা হলে ভালো লাগে না – এইটুকুই আমার রসবোধ। আমের মধ্যে কতটা অ্যাসিড বা গ্লুকোজ বা অন্য কিছু থাকে তা জানার আমার কোন উৎসাহ নেই।
— শেষ —