Home » ছোট গল্প » অন্যান্য » পরোপকারী

পরোপকারী

ছোট একটা রাস্তার ধারে অতি সাধারণ একটা বাড়ি। চোখে পরার মত কোন বিশেষত্ব নেই তাতে। সামনে গ্রিল দেওয়া একটা ছোট বারান্দা। একটু কাছে গেলে দেখা যায় কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা আছে। গ্রিলে একটা কাঠের ফলক ঝোলে। তাতে একদিকে লেখা – এখন খোলা আছে, আর অন্যদিকে লেখা – এখন বন্ধ। এছাড়া চোখে পরার মত আর কোন আকর্ষণ নেই এই বাড়িতে। এ হল মহেশ দত্তর বাড়ি।

মহেশ-বাবু কি কাজ করেন সেটা সকলের কাছে খুব পরিষ্কার নয়। মহেশ দত্তকে কেউ কেউ বলে মহান মহেশ দত্ত। কারো স্বরে শ্রদ্ধার সুর পাওয়া যায়, কারো কথা ব্যঙ্গ্যোক্তি বলে মনে হয়। এছাড়া আরো অনেক কিছু শোনা যায় তাঁর নামে। সে কথায় পরে আসছি।

গ্রিল দেওয়া বারান্দা দিয়ে ঢুকে দরজা পার হয়ে ভিতরের একটা ঘরে মহেশ বাবু বসেন। টেবিলে খান কয়েক ডায়েরি, কিছু বই আর দৈনিক খবরের কাগজ। প্রতিদিন না হলেও প্রায় রোজই সন্ধের সময় উনি সেখানে বসেন। যখন বসেন তখন বোর্ডটা ঘুরিয়ে দেন যেদিকে লেখা আছে “এখন খোলা আছে”। এ হল মহেশ বাবুর দপ্তর। নানান ধরেনের লোক আসে সেখানে। যে সময়ে – এখন বন্ধ – এই নোটিশ ঝোলে, তখন কিছুতেই এই বাড়ির কারুর সারা পাওয়া যায় না। এইরকম সময়ে কেউ এসে হাঁকডাক করলে সাধারণত আশেপাশের বাড়ির লোকজনই বলে দেয় – পরে আসবেন। এখন তাঁর দেখা পাবেন না।

আর যখন খোলা থাকে, কখনো এক-দু জনকে বারান্দা বসে থাকতে দেখা যায়, কখনো বা বারান্দা ফাঁকা। এরা হল মহেশ বাবুর মক্কেল। একজনের সাথে কথা শেষ হলে মহেশ-বাবু দরজা খুলে তাঁকে বিদায় জানিয়ে পরের জনকে নিয়ে ভিতরে চলে যান, আর দরজা বন্ধ করে দেন। দরজায় নোটিশ ঝোলে – এখানে অপেক্ষা করুন। রাস্তা থেকে তাকালে এটা চোখে পরে না।

মহেশ-বাবু ডাক্তার যে নন, সেটা বলাই বাহুল্য। তা নাহলে, বাড়ির বাইরে মানুষের লাইন, পিঁপড়ের লাইনকে হার মানাত। একসময়ে সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারের সামনে মানুষের লাইন পরত, এখন ডাক্তারের চেম্বারের সামনে পরে। ব্যতিক্রম শুধু ব্ল্যাকার দেখা যায় নি এখনো অবধি। তবে সেদিন মনে হয় আর খুব দূর নয়। সে যাই হোক, মহেশ-বাবু উকিল-মোক্তার নন, গোয়েন্দাও নন। উনি হলেন পরোপকারী। ওনার কাছে লোকে সাহায্য নিতে আসেন। কেউ আসেন পরামর্শ নিতে। তাই এই গোপনীয়তা খুব জরুরী। মহেশ-বাবু এটা শখে করেন। কোন মজুরি নেন না। এই নিয়েই লোকের নানানরকম জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। প্রথমদিকে লোকে ভাবত, এনার আসল মতলব, মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে দাঁড়ান। এখন লোকে বুঝে গেছে যে মহেশ-বাবু রাজনীতির ভিতরে যেতে চান না। কেউ বলে, উনি পুলিশের ইনফরমার। কেউ বলে, বিদেশের চর। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, মায় উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ফ্রান্স, জার্মান সব দেশের নামই শোনা যায়। যার যেরকম বুদ্ধির দৌড় সে তত দূর যায়।

লোকে বিপদে পরে মহেশ-বাবুর কাছে আসে। ওনার কাছে এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় বলে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার উপরে উনি কোন পারিশ্রমিক নেন না। তাই লোকে আসে। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সময়ে চোর, জোচ্চোর, খেচর, মানী, অমানী – সব লোকই সমান। সাহায্য করার নামে মহেশ-বাবু কারো ক্ষতি করেছে – এমনটা অন্তত শোনা যায় নি।

সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। একটা গল্প পড়তে পড়তে মহেশ-বাবুর মনে হয়েছিল, যদি একজন ডাক্তার, একজন উকিল, আর একজন পুলিশের সাথে ভালো খাতির থাকে, সমাজে মোটামুটি সবরকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মহেশ-বাবু একটা ডায়েরি বের করে চেনা পরিচিত লোকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, তিনি কি করেন এবং তাঁর সাথে ওনার কি সম্পর্ক, বিশেষ করে উনি যদি কোনদিন তাঁর কোন উপকার করে থাকেন, তার বিশদ বিবরণ লিখতে শুরু করলেন। কয়েক মাসের প্রচেষ্টায় ডায়েরি ভরে উঠল। মহেশ-বাবু বুঝলেন, কাজটা খুব শক্ত নয়।

একদিন মহেশ-বাবু একটা বাচ্চা ছেলেকে বাসের তলায় চাপা পরা থেকে বাঁচিয়ে তার বাড়ীতে দিয়ে এলেন। সেই ছেলেটার বাবা হলেন শহরের নাম করা এক ডাক্তার। সেখান থেকে সেই ডাক্তারের সাথে আলাপ এবং ডাক্তারের নাম উঠল মহেশ-বাবুর ডায়েরীতে। এই রকমভাবে টুকিটাকি ঘটনায় নানান লোককে সাহায্য করা, তাঁদের সাথে আলাপ করা এবং তাঁদের নাম ডায়েরীতে উঠতে উঠতে মহেশ-বাবুর বেশ কিছু ডায়েরী ভর্তি হয়ে গেল বছর দুয়েকের মধ্যে। শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম মহেশ-বাবুর ডায়েরীতে আছে। সারা শহর জুড়ে এখন মহেশ-বাবুর নাম।

এইরকম সময়ে একদিন এক রাজনৈতিক নেতা মহেশ-বাবুর বাড়ীতে এসে হাজির হলেন। মহেশ-বাবু তাঁকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গেলেন। ভদ্রলোক বললেন, মহেশ-বাবু আপনি নিশ্চয় খবরের কাগজে পড়েছেন যে, আমার ছেলে কি করেছে?

মহেশ-বাবু বললেন, পড়েছি। তবে খবরের কাগজের সব কথা যে সত্যি না, সে আপনিও জানেন, আমিও জানি। বলুন আপনার জন্যে আমি কি করতে পারি? আর সত্যি ঘটনাটা কি সেটা যদি বলেন, তাহলে আমি ভেবে দেখতে পারি আমি কি করতে পারি।

নেতা বললেন, কতগুলো ছেলে যে মেয়ে ঘটিত কেসে ফেঁসেছে সেই দলে আমার ছেলে ছিল। তবে ওইটুকুই। ও কিছু করে নি। আমাকে অপদস্থ করার জন্যে বিরোধী পক্ষের লোকেরা এটাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছে। যা নয় তাই গল্প বানাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে আমার নিজের দলের লোকেরও হাত আছে এর মধ্যে।

মহেশ-বাবু বললেন, আপনাদের তো অনেক লিঙ্ক, অনেক ক্ষমতা আছে। সেগুলো ব্যবহার করছেন না কেন?

নেতা বললেন, তা যেমন আছে, বিপক্ষও আছে। সেসব যে চেষ্টা করি নি তা নয়। বিষয়টা এখন অনেক জটিল। সবচেয়ে মুশকিল হল যে, মেয়েটি সুইসাইড নোটে যে যে ছেলের নাম লিখে গেছে তাতে আমার ছেলের নামও আছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপোর্টে প্রমাণ আছে যে আমার ছেলে সেখানে ছিল। মেয়েটির বডিতে আমার ছেলের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি বটে তবে তাতে খুব একটা সুবিধা হবে বলে মনে হয় না।

মহেশ-বাবু বললেন, যদি ধরেও নেই যে আপনি যা বলছেন তা পুরোপুরি সত্যি, আপনি আমার কাছ থেকে কি চান সেটা তো বুঝলাম না।

নেতা বললেন, উকিল-পুলিশ সব লাগিয়েও বুঝছি যে কোন উপায় নেই। খুব সম্ভবত আমার ছেলের ফাঁসি হয়ে যাবে। একমাত্র ছেলে। বুঝতেই পারছেন।

একটু থেমে নেতা বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি… যদি আপনি জজকে বলে ওর ফাঁসিটা আটকাতে পারেন। যাবত-জীবন হলেও চলবে। অন্তত প্রাণে তো বেঁচে থাকবে। এর থেকে বেশী আর কিছু আশা করি না এখন।

মহেশ-বাবু এবার ডায়েরী টেনে পাতা উলটাতে লাগলেন। এটা দেখলেন, ওটা দেখলেন। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপরে মুখ তুলে বললেন, আমি এই ধরনের কাজ করি না। তবে যেহেতু একজন বাবা তার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন, তাই নিলাম। দেখি কি করতে পারি।

নেতা ভদ্রলোক মহেশ-বাবুকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে গেলেন।

এরপর মহেশ-বাবুর কাজ শুরু হল। নানান মহলে ঘুরে, সে পুলিশ থেকে শুরু করে, উকিল, ডাক্তার, মোক্তার, এবং বিভিন্ন নেতাদের সাথে কথা বলে বুঝলেন যে নেতাটি যে আশঙ্কা করেছেন তা অবান্তর নয়। খুব সম্ভবত ছেলেটার ফাঁসি হয়ে যাবে। সবশেষে মহেশ-বাবু একদিন জজে-সাহেবর বাড়ীতে গিয়ে হাজীর হলেন। অনেকদিন আগে কোন এক বিষয়ে মহেশ-বাবু এই জজের এক উপকার করেছিলেন। সেই কাজের রেশ ধরে মহেশ-বাবু জজকে বললেন যে, স্যার আপনার হাতে একটু কোন ক্ষমতা থাকে ছেলেটিকে যেন যাবত-জীবন দেওয়া হয়। এইটুকুই আমার অনুরোধ।

মহেশ-বাবু জানতেন কাজ হলে এতেই হবে। বেশী কথা বলার প্রয়োজন নেই সেখানে। এই বলে মহেশ-বাবু সেখান থেকে বিদায় নিলেন।

কিছুদিন পরে খবরের কাগজে বের হল যে, অমুক মেয়ের মৃত্যুর দায়ে স্থানীয় নেতার ছেলের যাবত-জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেছে। মহেশ-বাবু জেনে খুব খুশী হলেন আবার অন্যদিকে দুঃখও হল যে ওনাকে এইরকম একটা কাজ করতে হল। এতে হয়ত দোষীর সঠিক শাস্তি হল না। একদিন সেই নেতা ভদ্রলোক এসে মহেশ-বাবুকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। মহেশ-বাবু ডায়েরীতে এই ঘটনার পুরো বৃত্তান্ত লিখে রেখে উনি অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

এরপর মাস ছয়েক কেটে গেছে। এক ছুটির দিনে জজে-সাহেবের সাথে মহেশ-বাবুর বাজারে দেখা। সামান্য কুশল বিনিময় পর্বের পরে মহেশ-বাবু বললেন, আমার নিজের খুব খারাপ লেগেছিল আপনাকে ওইরকম একটা অনুরোধ করতে। সেই কারণেই ওই কেসটার পরে আপনাকে ফোন করে আর বিরক্ত করি নি। তবে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার অনুরোধটা রাখার জন্যে।

জজ-সাহেব এতক্ষণ ভালোই কথা বলছিলেন। এই কথাটা শোনার পরেই ওনার জজচিত গাম্ভীর্য ফিরত এলো। উনি মহেশ-বাবুকে বললেন, আরে মশাই। এইরকম অনুরোধ আমাকে আর করবেন না দয়া করে। কেবল আমি আপনাকে জানি বলেই এই কাজটা আমাকে করতে হল। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছেলেটা তো বেকসুর ছাড়া পেয়ে যাচ্ছিল। কতরকম প্যাঁচ-ঘোট করে তাকে যাবত-জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল, আপনি ভাবতেও পারবেন না! শুধু আপনার অনুরোধে এটা আমাকে করতে হল। আপনি তো লোকজনের উপকার করেন বলে জানি। এটা আপনি করতে গেলেন কেন? রাজনৈতিক দলাদলির শোধ একটা যুবকের উপরে নেওয়া ঠিক না। আপনি বুঝছেন…

এই কথার পরে জজ-সাহেব আরো কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু মহেশ-বাবুর মাথা পর্যন্ত সে কথা আর পৌঁছোয় নি। ওনার কান বন্ধ হয়ে এলো। বাজার না করেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত এলেন। অনেকক্ষণ নিজের চেম্বারে একা একা বসে থাকলেন। ডায়েরীর পাতা ওলটাতে ওলটাতে অনেক পুরানো কেস পড়লেন। তারপরে সিদ্ধান্ত নিলেন সেই দিন থেকে উনি আর পরোপকারীর কাজ করবেন না। সব বোর্ড নামিয়ে দিয়ে গ্রিলে বড় একখানা তালা ঝুলিয়ে দিলেন। এখন কেউ ডাকলেও সারা দেন না মহেশ-বাবু।

— শেষ —