Home » ছোট গল্প » অন্যান্য » পেছনে পায়ের শব্দ

পেছনে পায়ের শব্দ

সেদিন আমাদের ক্লাসের অঙ্কের টিচার স্কুলে আসেন নি। অঙ্কের ক্লাসে এলেন সুভাষবাবু, আমাদের ইংরাজি টিচার। সুভাষবাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, তোরা চুপ করে বসে অঙ্ক কর, আর তা না হলে, একজন কেউ এখানে এসে গল্প বল।

এ যেন – রাস্তায় বসে পাথর ভাঙ্গবি, না বিনে পয়সায় ফুচকা খাবি – প্রশ্নটা অনেকটা সেরকম হয়ে গেল। আমরা বললাম, অঙ্ক? না স্যার। আমরা গল্প শুনব।

সুভাষবাবু ক্লাসের ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চিকুকে ডাকলেন, চিকু এদিকে আয়।

চিকু ভয়ে ভয়ে উঠে সুভাষবাবুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি স্যার?

সুভাষবাবু বললেন, তুই একটা গল্প বল।

সুভাষবাবুর চিকুকে ডাকার পেছনে একটা কারণ ছিল। আগের সপ্তাহে চিকু সুভাষবাবুর ক্লাসে ইংরাজি বইয়ের মধ্যে একটা গল্পের বই ঢুকিয়ে পড়ছিল। সুভাষবাবু সেটা ধরে ফেলে চিকুর সেই গল্পের বই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। স্কুল ছুটি হওয়ার পরে চিকু ওনার কাছে অনেক রকম ভালো কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে সেটা ফেরত পায়। যাহোক, চিকু গল্প বলা শুরু করল –

একটা বাড়িতে একটা গাছ ছিল আর সেই গাছে একটা ভুত ছিল। ভুতটা মাঝে মাঝে বাড়ির ছোট মেয়েটাকে দেখা দিত। মেয়েটা একদিন ওর বাবা-মাকে বলল। তাঁরা কেউ ওর কথা বিশ্বাস করলেন না। তারপরে সেই ভুত একদিন গাছ থেকে নেমে মেয়েটার কাছে এল। তার কিছুদিন পরে ভুত ওর শোয়ার ঘরে এলো। রাতে ওকে ঘুম পারিয়ে দিত, ওর সাথে গল্প করত, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

গল্প শুনে আমরা বললাম, অ্যাঁ, ধ্যাৎ।

সুভাষবাবু চিকুকে বললেন, যা, নিজের সিটে গিয়ে বস।

চিকু জমিয়ে গল্প বলতে পারল না। আমরা ধ্যাৎ বললাম। সে সব হল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমরা ভুতের বিষয়ে একটা উস্কানি খেয়ে গেলাম। প্রণব তখন সুভাষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি ভুত বিশ্বাস করেন?

সুভাষবাবু বললেন, ভুত আছে – তা বিশ্বাস করি না, তবে ভুতের ভয়টাকে মানি।

আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সেই সমেয়ে যদি কেউ বলত সে ভুত বিশ্বাস করে, আমরা বুঝতাম হয় তার স্ক্রু ঢিলে আছে আর নাহলে তার ডাক্তার দেখানোর সময় হয়েছে। তবে, অস্তিত্ব টের পাই না বলে যাকে মানি না, আবার অস্তিত্ব টের পাই নি বলে তাকে উড়িয়েও দিতে পারি না। সব কিছু জানার, পরখ করে দেখার অদম্য কৌতুহল তখন আমাদের মধ্যে। কিন্তু সে হল গিয়ে আমাদের কথা। কিন্তু সুভাষবাবু? তিনি একজন মাঝ-বয়সী অবিবাহিত লোক। এ কি বলেন? ভুত আছে – বিশ্বাস করি না। তবে ভুতের ভয়টাকে মানি! যা নেই তাকে আবার ভয় কেন?

প্রণব আবার জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি কখনো ভুত দেখেছেন?

সুভাষবাবু বললেন, ভুত দেখা যায় না। ওটা বুঝতে পারা যায়।

পেছনের বেঞ্চ থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনি কখনো সেটা নিজে বুঝতে পেরেছেন?

সুভাষবাবু বললেন, আগে মানতাম না। একবার নৈনিতালে বেড়াতে গিয়ে টের পেয়েছি।

আমরা সবাই বললাম, স্যার, সেই গল্পটা শুনব।

সুভাষবাবু শুরু করলেন –

তিন বছর আগে, আমি বড়দিনের ছুটিতে নৈনিতাল বেড়াতে গেছিলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে ওখানকার একটা ছোট ডাকবাংলোর খবর দিয়েছিল। বলেছিল, পাহাড়ের ঢালে সেই বাংলো থেকে পাহাড়ের পুরো দৃশ্যটা দেখা যায়। নৈনিতালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্যে ওর থেকে ভালো কোন জায়গা হতে পারে না। আমি ওর কথা মত সেই ডাকবাংলোটা বুক করে নৈনিতাল বেড়াতে গেলাম।

সকাল বেলা সেখানে পৌঁছে দেখি এক উর্দি পরা লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার পরিচয় দেওয়া মাত্র সে বলল, আমার নাম বাহাদুর, আমি এই বাংলোর কেয়ার টেকার।

এই বলে বাহাদুর আমার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে আমাকে উপরের তলায় নিয়ে গেল। বাংলোখানা ভারী সুন্দর জায়গায়। আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কোন ঘরবাড়ি নেই। বাংলোর সামনে দাঁড়ালে চারিদিকে শুধু পাহাড়, মাথার উপরে নীল আকাশ, আর একদম নিচে নৈনিতাল লেক।

যাহোক, ঘরে ঢুকে ও সুটকেস নামিয়ে রেখে প্রথমেই দুটো জানালাগুলো খুলে দিল। একটু একটু ঠাণ্ডা হাওয়া আসতে শুরু করল। লম্বা জার্নির পরে ঠাণ্ডা হাওয়া তখন ভালোই লাগল। তারপর ও আমাকে শোয়ার ঘর, বসার ঘর, ডাইনিং, বাথরুম ইত্যাদি দেখিয়ে বলল, এই বাংলোটা আসলে এক সাহেবের তৈরি করা। এখন দেশী মালিক। তবে সে এখানে বেশী একটা আসে না। মাঝে মাঝে আপনার মত কেউ কেউ আসে। এখন শীতের সময়। এখানে লোক খুব কম। কেউ আসার আগে আমি সব পরিষ্কার করে রাখি। নাহলে অন্য দিন বাজারে টুকটাক কাজ করি।

আমি ওর কথা মন দিয়ে শুনছি না দেখে ও বলল, কোন দরকার হলে আমাকে ডাক দেবেন সাব। আমি নিচে আছি। এই বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

আমি বসার ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম চারিদিক থেকে পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে লেকে মিশেছে। সামনে পরিষ্কার আকাশে ছোট ছোট মেঘের টুকরো ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিচে এদিক-ওদিক বরফ পরে আছে, আর মাঝে মাঝে গাছের ডালে বাতাস লেগে সেখানে লেগে থাকা বরফ ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে।

কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে চারপাশটা দেখে আমি একটা চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসলাম। এমন সময়ে বাহাদুর এক কাপ চা নিয়ে এল। আমার টেবিলের উপরে চায়ের কাপ-প্লেট নামিয়ে রেখে বাহাদুর জিজ্ঞেস করল, আপনি কি এখন টোস্ট-ওমলেট কিছু খাবেন?

আমার একটু খিদে পেয়েছিল। বললাম, গরম গরম বানাতে পারলে দিয়ে যাও।

সে বলল, জল-খাবার আমি নিচের ঘরে বানাই। আর লাঞ্চ-ডিনার বাইরে থেকে এনে দেই। বাহাদুর চলে গেল। আমি চা খেতে খেতে চারিদিক দেখতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাহাদুর টোস্ট, ওমলেট, আর চা একটা ট্রেতে করে সাজিয়ে নিয়ে এল। আমি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, স্নানের জন্যে একটু গরম জল পাওয়া যাবে, বাহাদুর?

জি, সাব। তবে দশ-পনের মিনিট লাগবে। এই বলে সে বাথরুমে গিয়ে গিজার অন করে দিল। জল খাবার খেয়ে আমি স্নান করে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বাহাদুর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি দুপুরে এখানে খাবেন না বাইরে খেতে যাবেন?

রাতে লম্বা ট্রেন জার্নি করেছি, তার পরে ট্যাক্সির ধকল গেছে। সবমিলিয়ে খুব ক্লান্ত লাগছিল। স্নান করে এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে আমার তখন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে করল না। বললাম, দুপুরে এখানে কিছু আনিয়ে দাও। আর রাতেও আমি এখানে খাব। বাহাদুর দুপুরের খাবারের অর্ডার নিয়ে চলে গেল আর আমি জানালার পাশে একটা ইজি চেয়ারে কম্বল ঢাকা দিয়ে বসে থাকলাম।

সামনে পরিষ্কার নীল আকাশ। এক-আধটু বাতাসের সোঁ-সোঁ শব্দ আর মাঝে মাঝে গাছ থেকে বরফ ঝরে পরার শব্দ ছাড়া চারিদিক নিস্তব্ধ। দু-একবার নিচ থেকে বাহাদুরের কাজের ঠুক-ঠাক শব্দ পেলাম। কিছুক্ষণ পরে বাহাদুর বলল, সাব, আপনার লাঞ্চ আনতে যাচ্ছি এখন। এই বলে সে বের হয়ে গেল।

আমি দেখলাম ঘরটাতে বেশ কিছু পুরানো ছবি টাঙানো আছে। একবার উঠে সেগুলো দেখলাম। তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না। অযত্নে সেগুলোর এখন আর কোন মাধুর্য নেই। সুটকেস থেকে একখানা বই বের করে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার সেই ইজি চেয়ারে বসে গল্প বই পড়তে লাগলাম।

বেশ অনেকক্ষণ পরে বাহাদুর খাবার নিয়ে এল। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। দুপুরে খাওয়ার পরে একটু ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল বিকেল বেলায়। গরম জামা পরে বাংলো থেকে বের হয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে অনেকটা হাঁটলাম। সূর্য যত নিচের দিকে নামতে থাকল, ঠাণ্ডাও তার সাথে সাথে বাড়তে লাগল। একসময়ে লেকের ধার দিয়ে ল্যাম্প পোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠল। দেখে মনে হল জলের মধ্যে আলোগুলো নাচছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য ডুবে গেল। আর তার পরেই পাহাড়ের রঙ বদলে সব কালো হয়ে যেতে থাকল। আমি বাংলোয় ফিরে এলাম। বাইরে তখন ভীষণ ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছিল আমার জামা-কাপড়ের ফুটো দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি যে এত ঠাণ্ডা পড়তে পারে আমি এর আগে কখনো ভাবি নি। বাহাদুর বলল, সাব, মনে হচ্ছে আজ রাতে খুব বরফ পড়বে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাহাদুর এক কাপ চা হবে?

জি, সাব, এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি। এই বলে ও রান্না ঘরে ঢুকে গেল।

আমি উপরে এসে দেখি বাহাদুর আমার বিছানা ঝেড়ে টানটান করে পেতে রেখেছে, বসার ঘরের সব জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়েছে, মাথার পাশের টেবিলে একখানা টর্চ, একটা মোটা মোমবাতি আর একটা দেশলাই রেখে গেছে। ফায়ার প্লেসে কয়েকটা কাঠ জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঘরটা বেশ গরম লাগল। আমি সোয়েটার, মাফলার খুলে ফেললাম।

বাহাদুর কিছুক্ষণের মধ্যে চা নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, সাব, রাতের খানা নিয়ে আসি?

আমি বললাম, যাও, নিয়ে এসো।

বাহাদুর চলে গেল। আমি চা শেষ করে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার তখন। অনেক নিচে লেকের ধারের আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। আকাশের দিকে তাকালাম। এক ফোঁটা আলোর কোন চিহ্ন নেই। আমি ফায়ার প্লেসের কাঠগুলো একটু নেড়ে দিয়ে তার পাশের চেয়ারে বইটা নিয়ে বসলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বাহাদুর এলো। জিজ্ঞেস করল, সাব, খানা লাগিয়ে দেব এখন?

আমি বললাম, এত জলদি?

সে বলল, আমি তাহলে খাবার ঢেকে রাখছি। আমাকে এখন যেতে হবে। আপনি খেয়ে রেখে দেবেন। কাল সকালে আমি এসে পরিষ্কার করে দেব।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তুমি রাতে এখানে থাকবে না।

বাহাদুর বলল, না সাব। আমি এই বাড়িতে রাতে থাকি না। কেউ বেড়াতে এলেই রাতে এখানে ভুত আসে। আপনি চান তো আমার সাথে নিচে যেতে পারেন। এত আরাম হবে না, কিন্তু সেখানে ভুত নেই।

মনে পড়ল, আমার বন্ধু বলেছিল, তোর যখন ভুতের ভয় নেই তো সেখানে গিয়ে থাকতে পারিস। আমি ভেবেছিলাম, ও আমার সাথে মজা করেছে। যাহোক, আমি বাহাদুরকে বললাম, আমি এখানেই থাকব। তুমি যেতে পার। তবে যাওয়ার আগে আমাকে এক ফ্লাস্ক চা বানিয়ে দিয়ে যাবে?

জি সাব, বলে ও তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্লাস্কে করে চা এনে আমার খাবার বেড়ে, সব ঢেকে রেখে, বিছানার পাশের টেবিলের উপরে এক গ্লাস জল রেখে আবার বলল, আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। সেখানে একটা ভালো বিছানা করে দেব।

আমি বললাম, আমি এখানে থাকব। আমি ভুত বিশ্বাস করি না, ভয়ও পাই না।

তারপরে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বাহাদুর, ভুত কখন আসে? এসে কি করে?

কিছু বলার আগেই সারাদিন যে লোকটা একা সব কাজ করেছে এখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সে কেমন যেন অন্য মানুষ। বাহাদুর বলল, অতশত আমি জানি না। তবে এই বাড়িতে কেউ এলেই রাতে এখানে ভুত আসে। আমি চললাম।

আমি যত ভুতের কথা জিজ্ঞেস করি ও ততই ভয়ে কেঁপে ওঠে। আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি যাও। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।

বাহাদুর যাওয়ার সময় আরেকবার সব জিনিষ ঠিক করে আমাকে বুঝিয়ে দিল। আর বার বার করে সাবধান করে দিল, আমি যেন কোন কারণেই দরজা-জানালা না খুলি। বাহাদুর চলে গেল।

আমি ওর পিছন পিছন গিয়ে নিচের দরজা লাগিয়ে দিলাম। তারপর রান্না ঘর, দিনের বেলায় ওর থাকার ঘর সব দেখে নিচের সব লাইট অফ করে উপরে উঠে এলাম। উপরে এসে আরেকবার সব দিক ভালো করে দেখে, ফায়ার প্লেসের মধ্যে আরেকটা কাঠ গুঁজে দিয়ে বইটা নিয়ে পড়তে বসলাম।

বইটা শেষ করে আমি খেয়ে নিলাম। রাত তখনো খুব বেশী হয়নি। দুপুরে এতো ঘুমিয়েছি যে চোখে আর ঘুম নেই তখন। আরেকখানা বই খুলে বসলাম। ফায়ার প্লেসের সব কাঠ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কাঠ কয়লার অল্প আগুন আছে তবে ঘরটা একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগল। বসার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা গেল না। দূরে রাস্তার আলোগুলো হয় নিভে গেছে কিংবা মেঘের জন্য সেগুলো দেখা গেল না।

কিছুক্ষণ পরে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। হাতরে হাতরে প্রথমে টর্চটা খুঁজে বের করলাম। তারপর মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ার টেবিলের উপরে রাখলাম। ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ চা ঢেলে নিলাম। ফায়ার প্লেস তখন পুরো নিভে গেছে। ঘরে আর কোন কাঠ নেই যে জ্বালাব। বাইরে যে বেশ ভালো রকমের ঠাণ্ডা পড়েছে তা ঘরের ভিতর থেকেই বুঝতে পারছি। মনে হল, একটু বরফ পড়াও শুরু হয়েছে। বাতাসের সোঁ-সোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। লঙ-কোটটা গায়ে চাপিয়ে আবার বই পড়াতে মন দিলাম। চা খেতে খেতে বইয়ের বেশ অনেকটা পড়ে ফেললাম। ততক্ষণে ঘরটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। হাত ঘড়িতে দেখলাম তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।

শোয়ার জন্যে বিছানায় গেলাম। বিছানায় হাত দিয়ে দেখি বিছানাটা ঠাণ্ডা হিম হয়ে আছে। টর্চটা বিছানার পাশের টেবিলে রেখে আমি পাজামা-পাঞ্জাবীর উপরে লঙ-কোটটা পরেই কম্বল ঢাকা দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। মনে হল বাইরে তখন ভীষণ ঝড় বইছে। মনে মনে ভাবলাম, আমার আর ভুতের সাথে দেখা হল না এই রাতে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত তখন কত হবে জানি না। নিচের দরজায় কারুর ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল, কেউ যেন ডাকছে আর জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। একবার ভাবলাম, এত রাতে বাহাদুর এলো নাকি আমার খোঁজ নিতে। যাহোক, একটু হাতরেই বেড সুইচটা খুঁজে পেলাম। লাইট জ্বালানোর জন্যে সেটা টিপলাম। কিছু হল না। বুঝলাম, ইলেক্ট্রিসিটি নেই। মাথার পাশে টেবিল হাতড়ালাম টর্চটা খোঁজার জন্যে। টেবিলে চায়ের ফ্লাস্কটা ছাড়া কিছুই পেলাম না। মনে হল নিচ থেকে একটা গোঁঙানির শব্দ আসছে আর দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দটা একই রকম ভাবে হয়ে যাচ্ছে।

আমি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠলাম। আন্দাজ করে পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম যে সেখানে পৌঁছালে মোমবাতিটা জ্বালাতে পারব। টের পেলাম আমার ঠিক পেছনেই কেউ খস খস করে পা ঘষে ঘষে হাঁটছে। আমি থামলাম। সেও থামল। ভাবলাম, ঘুমের ঘোরে এটা আমার মনের ভুল। কান খাঁড়া করে দুই পা এগোলাম। সেও পা ঘষে ঘষে আমার মত দুই পা এগিয়ে এলো। এইভাবে দেওয়াল অবধি পৌঁছে গেলাম। সেখানে পড়ার টেবিল-চেয়ার কিছু নেই। দেওয়াল ধরে এগোতে থাকলাম। একবার মনে হল, আমার হাতের উপর কারুর শ্বাস পড়ল যেন। এইভাবে চলতে চলতে সিঁড়ির হদিস পেলাম। এদিকে আমার পেছনে সে আমাকে ফলো করে চলেছে। আর নিচে একই রকম ভাবে দরজা ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হয়ে চলেছে।

ঘরের ভিতরে চাপ ধরা অন্ধকার। এক হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সিঁড়ির কাছে গিয়ে মনে হল, এবার দরজা না-খুললে সেটা ভেঙ্গে দেবে। একবার মনে হল, এত রাতে কেউ নিশ্চয় বিপদে পড়েছে। একে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার উপর নতুন জায়গা। আমি যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে চেষ্টা করলাম। আমি এক ধাপ করে নামি, আর পেছনে শুনতে পাই পায়ের শব্দ – খস-স, ধুপ। পরিষ্কার বুঝলাম যে, আমার ঠিক এক ধাপ পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি সিঁড়ির রেলিংটা ধরে পিছন দিকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। আর এক ধাপ নামলাম। আবার সেই পায়ের শব্দ – খস-স, ধুপ। আরেক ধাপ নামলাম। সেই শব্দ – খস-স, ধুপ। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘুরে এক ধাপ উপরে উঠলাম। কাউকে পেলাম না। শব্দটা হল না। তবে মনে হল, কেউ যেন সরে গেল। এদিক ওদিক হাত বাড়ালাম। কাউকে পেলাম না। আবার দুই ধাপ নামলাম। একই শব্দ। খস-স, ধুপ। খস-স, ধুপ। এই করতে করতে নিচের দরজার কাছে পৌঁছালাম।

তখন মনে হল দরজা কেউ ভেঙ্গে ফেলল বলে। আমি দরজা খুললাম। হুমড়ি খেয়ে কিছুটা বরফ ঘরের মেঝের উপরে এসে পড়ল। এক ঝটকা হাওয়া এসে লাগল আমার মুখের উপরে। মনে হল আমি পরে যাব। ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা বাতাসে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। আমি তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে দিলাম।
তারপরে এক ধাপ, এক ধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। আর কোন শব্দ নেই। মনে হল সে পালিয়েছে। কান খাঁড়া করে সিঁড়ির রেলিং ধরে এক-পা, এক-পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম। চোখটা ততক্ষণে অন্ধকারে কিছুটা সয়ে গেছে। দেওয়াল ধরে ধরে আমি বিছানার পায়ের দিকটায় পৌঁছালাম। তারপরে বিছানার উপরে উঠে বসলাম।

বিছানায় বসে আমি টেবিলে হাত দিয়ে দেখি টর্চটা ঠিক জায়গাতেই আছে। আমি টর্চ জ্বালিয়ে প্রথমেই সিঁড়ির দিকে আলোটা ফেললাম। তারপর এদিক ওদিক ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলাম। দেখি টেবিল-চেয়ার যেমন ছিল সেইরকমই আছে। বিছানা থেকে উঠে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ভাবছি ঘরের মধ্যে কে ছিল যে আমার পিছন পিছন হাঁটছিল এতক্ষণ। আর সে গেলই বা কোথায়? টেবিল-চেয়ারটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো ঠিক জায়গায় ফিরে এলো কি করে? যেরকম দেখে শুতে গিয়েছিলাম ঠিক সেই রকমই আছে। টের পেলাম আমার হাতের তালু ভিজে গেছে। শরীর একটু একটু কাঁপছে। চেয়ারে বসে টর্চ দিয়ে আবার চারিদিক ভালো করে দেখলাম। কোন কিছুর আভাস পেলাম না। বাইরে তখন ভীষণ বরফ পড়ছে।

একটু সাহস করে বসার ঘরটা দেখার জন্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে যেই এই পা দিয়েছি, কেউ আমার কোট ধরে টান দিল। আমি তাড়াতাড়ি পিছনের দিকে টর্চের আলো ফেললাম। দেওয়ালের উপরে টর্চের আলো পড়ল। কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। তারপরে লঙ-কোটের টানের দিকে নজর করে দেখি আমার লঙ-কোটের বেল্টের একটা দিক চেয়ারের এক কোনে লেগে টান পড়েছে।

বেল্টটা চেয়ারের কোন থেকে ছাড়িয়ে বসার ঘরটা ঘুরে দেখতে গিয়ে রহস্যটা উদ্ধার করলাম।

বিছানা থেকে উঠে আমি যখন ঘরের মধ্যে হাঁটছিলাম আমার লঙ-কোটের বেল্টটা মেঝেতে লুটাচ্ছিল। সেটা মেঝের সাথে ঘষা খেয়ে খস-খস করে শব্দ হচ্ছিল আর তাই মনে হচ্ছিল কেউ আমার পেছনে পেছনে পা ঘষে ঘষে হাঁটছিল। যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম সেটা এক-ধাপ, এক-ধাপ করে পড়ছিল আর তাই খস-স ধুপ শব্দটা হচ্ছিল।

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফ্লাস্কের ঢাকনায় কিছুটা চা ঢেলে খেলাম। তারপর ফ্লাস্কের ঢাকনা লাগিয়ে ফ্লাস্কটা যেখানে ছিল সেখানে রাখতে গিয়ে দেখি জলের গ্লাসের ঢাকনাটা টেবিলের উপরে পরে আছে। মনে পড়ল, টর্চ খোঁজার সময় ওই রকম কিছু একটার ছোঁয়া লেগেছিল তখন। বুঝলাম হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আমার ডান আর বাঁ দিক উল্টো হয়ে গিয়েছিল। টর্চ যেদিকে রেখেছিলাম, আমি তার উল্টোদিকের টেবিলে সেটা খুঁজেছিলাম। তাই ওটা খুঁজে পাই নি। আর বিছানা থেকে নেমেছিলাম পড়ার টেবিলের উল্টো দিকে, তাই সেইটাকেও খুঁজে পাই নি। সেই দিকের দেওয়াল ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছিলাম।

বাইরে তখন ভীষণ ঝড় আর বরফ পড়ছে। বাতাসে মাঝে মাঝে নিচের দরজার কড়া নড়ছে। বুঝলাম, এই ঝড়-ঝঞ্ঝায় সে রাতে ইলেক্ট্রিসিটি আর আসবে না। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগল। মোমবাতি নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

পরের দিন সকালে বাহাদুর এলো। প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, সাব, রাতে ভুত আসে নি?

আমি বললাম, অনেক রাতে একবার এসেছিল।

ও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমার মাথা থেকে পা অবধি একবার দেখে কাঁপতে কাঁপতে রান্না ঘরে চলে গেল।

আমাদের সারা ক্লাস তখন যাকে বলে, পিন ড্রপ সাইলেন্স। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি তাহলে ভুত বিশ্বাস করেন না এখনো।

সুভাষবাবু বললেন, ভুতের ভয়টা মানি, তবে ভুত আছে বলে এখনো কোন প্রমাণ পাই নি।

 

— শেষ —