Home » ছোট গল্প » অন্যান্য » ব্যথার ওষুধ

ব্যথার ওষুধ

সিন্ধু উপত্যকায় হরপ্পা বা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা ঠিক কত সাল থেকে কত সাল অবধি জীবিত ছিল – এই নিয়ে যাদের উৎসাহ মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া পুরোহিতের মূর্তি ও সিলমোহরের উপর আঁকাগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করার চাইতে বেশী, তারা এই গল্প পরে উপভোগ করবে এমন বিশ্বাস আমার নেই। তবুও বলছি।

তখন ইউনিভারসিটিতে ইন্টার ডিপার্টমেন্ট ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছে। যদিও সবাই জানে শেষমেশ কোন ডিপার্টমেন্ট জিতবে বা কোন দুই ডিপার্টমেন্টের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইটা হবে, তাই বলে অন্য ডিপার্টমেন্টগুলো যে ওয়াক ওভার দিয়ে দেবে সেটা তো আর হয় না। কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে এমন অবস্থা যে, সেখানে দুই ইয়ার মিলে এগারো জন ছেলেই নেই, এগারো জন ছেলে-খেলোয়াড় তো দূরের কথা। সেইসব ডিপার্টমেন্টে মেয়েরাই বাকি জায়গাটা পূরণ করে। তা বলে সেটাকে হেলায় ফেলায় নিলে চলবে না। এটা ভারতবর্ষ! ঝাঁসির রানি! সেসব ভুললে চলবে? তবে ফাঁকটা হল, ঝাঁসির রানি যুদ্ধ শিখে যুদ্ধ করতে নেমেছিলেন, এরা কোনদিন ক্রিকেট না-খেলে শুধু ডিপার্টমেন্টের মান রক্ষার জন্য খেলতে নামে। তা হোক, লড়ে হারব, কিন্তু ওয়াক ওভার দিব না – তাই বা কম কিসের? এই খেলাগুলো দেখার মত হয়। কারণ, ব্যাটস-ঊওম্যানের বিরুদ্ধে ফার্স্ট বল করলে বোলারদের নামে বাজে সমালোচনা হয়, আবার আস্তে বল করলে মেয়ে-খেলোয়াড়দের তাচ্ছিল্য করা হয়। তা যাই হোক, সব মিলিয়ে সে এক মজার ব্যাপার।

এছাড়া এই ক্রিকেট খেলার সিজনে প্রায়শই আর একটা ঘটনা ঘটে। সেইটে হল, ক্যাচ লুফতে গিয়ে বা মাঝ মাঠে বল ধরতে গিয়ে মাঝের আঙ্গুলের ডগায় বল লেগে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। তখন একটা ডাক্তারের প্রয়োজন হয়ে পরে। আমার এই গল্পটা সেই নিয়ে।

আমার পাশের রুমের থাকে সুরজিত। একদিন খেলতে গিয়ে যথারীতি মাঝের আঙ্গুল ফুলিয়ে এল। তার থেকে বড় সমস্যা হল, সেদিনের খেলায় সুরজিতের ডিপার্টমেন্ট জিতে বসে আছে। একেই বলে গোঁদের উপর বিষফোড়া। কারণ কয়েকদিন পরে ওকে আবার পরের রাউন্ডে খেলতে হবে। সুরজিতের কয়েকজন সুহৃদ বন্ধু ওকে বলল, আল্টিমেটলি তো তোরা হেরেই যাবি, পরের রাউন্ডে তোর না-খেললেও চলবে। কি দরকার এত চাপ নেওয়ার? তাতে সুরজিতের জেদ আরও বাড়ল, আর সেই থেকে বাড়ল আমাদের বিড়ম্বনা।

ইউনিভারসিটি থেকে একটু দূরে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। বড়সড় কিছু হলে সবাই সেখানে যাই, কিন্তু ছোটখাট কিছু হলে ইউনিভারসিটির রেসিডেন্ট ডাক্তারই আমাদের ভরসা। তখনো অবধি আমরা তাকে কোনদিন স্বচক্ষে দেখি নি। কিন্তু  ইউনিভারসিটির ইস্তাহারে সেই ডাক্তারের একটা উল্লেখ আছে।

সে যা হোক, আসল কথায় আসি। পাশের রুমের ছেলে অসুবিধায় পড়েছে। সবসময় আড্ডা মারছি, আর বিপদের সময় দেখব না – সেইটে কি আর হয়? রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা কয়েকজন সুরজিতকে বললাম, পরেরদিন সকালে ইউনিভারসিটি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব প্রথমে। দেখি কিছু ওষুধ দিয়ে ব্যথা কিছুটা কমানো যায় কিনা।

মুশকিলে পড়লাম যে সেই ডাক্তারকে আমারা কেউ দেখি নি। আর তার বসার জায়গা, অর্থাৎ চেম্বার বা ডিসপেনসারি কোথায় তাও জানি না। এই শুনে সুবীর এর এক তুলনাহীন সমাধান দিল। বলল, বিকেল বেলায় দেখবি ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে একটা লোক হ্যাঙ্গার সহ কালো কোট পরে হেঁটে হেঁটে ফেরে। ওইটাই হল ইউনিভারসিটির রেসিডেন্ট ডাক্তার। চেহারার এই বর্ণনা পাওয়ার পরে আর কোন প্রশ্ন করা চলে না।

পরের দিন সুরজিতকে নিয়ে গেলাম সেই ডাক্তারের কাছে। রেজিস্টারে নাম লিখে ভিতরে যখন গেলাম, সুবীরের কথার যথার্থতা বুঝতে একটুও সময় লাগল না। চেহারা যাই হোক, বেশ গম্ভীরভাবে প্রথমে নাম, কোন হস্টেলে থাক, কোন ডিপার্টমেন্ট, কোন ইয়ারে পড়, সেসব শুনে ডাক্তারি কায়দায় খচাখচ লিখে, তারপর জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

সুরজিত হাতের সব আঙ্গুলগুলো মুঠ করে শুধু মাঝের আঙ্গুলটা লম্বা করে ডাক্তারকে দেখাল আর বলল, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বল লেগে গেছে। দুইদিন হল, ব্যথা একটুও কমছে না।

ডাক্তার প্রথমে স্টেথো দিয়ে সুরজিতের বুক-পিঠ দেখল, তারপরে জিব বের করতে বলল। সেটা দেখল। চোখ টেনে কিছু একটা দেখল। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করতে ভুলল না। কান পরীক্ষা করল। হ্যাঙ্গার সহ কোট পরুক আর যাই করুক, এইসব দেখে আমাদের মনে ডাক্তার সম্পর্কে তখন একটা ‘ভালো’ অনুভূতি হল।

তারপর তিনি নিজের চেয়ারে বসে সুরজিতের হাতটা টেবিলের উপরে টেনে ভাল করে দেখার পরে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিলেন Red Mixture দুই চামচ করে দিনে দুইবার – পাঁচ দিন। সুরজিত হাত দুটো ঝুলিয়ে তখনও ডাক্তারের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার সুরজিতের হাতে প্রেসক্রিপশনটা দিতে যাবে এমন সময় থমকে গেল। অকারণ গম্ভীর হয়ে বলল, একদম সোজা হয়ে দাঁড়াও তো দেখি। সুরজিত দাঁড়িয়েই ছিল। এই কথা শুনে রিফ্লেক্সে অনেকটা মিলিটারির অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ডাক্তার ভালো করে দেখল হাতের পুরো চেটোটা কোমরের বেশ অনেকটা নিচে রয়েছে। বলল, হাতটা অত উঁচু করে ধরেছিলে কেন? এই বলে উত্তরের কোন অপেক্ষা না-করে প্রেসক্রিপশনটাকে টেনে নিয়ে Red কেটে Blue লিখে সুরজিতকে প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে বলল, পাশের ঘরে দেখাও। ওখান থেকে ওষুধটা নিয়ে নাও।

তারপরে পাশের ঘরে সেই প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধ নিয়ে যে যার নিজের ক্লাসে চলে গেলাম।

সন্ধের আড্ডায় এই ঘটনাটা যখন বললাম, জানতে পারলাম, সেই ডাক্তারের কাছে ব্যথার দুই রকম মিক্সচার আছে – লাল এবং নিল। ব্যথা কোমরের উপরে হলে লাল মিক্সচার আর কোমরের নিচে হলে নিল মিক্সচার। বুঝলাম, ডাক্তারকে দেখানোর সময় সুরজিত হাতটা কোমরের উপরে ছিল আর প্রেসক্রিপশন নেওয়ার সময় ওর হাতটা ছিল কোমরের নিচে। তা ডাক্তারের কি দোষ? ব্যাথার আসল স্থান তো কোমরের নিচে।

আড্ডা দিয়ে ফেরার সময়, দোকান থেকে কিছু বরফ, একটা লোকাল-মেইড বাম, আর এক শিশি আরনিকা কিনে নিয়ে সুরজিতকে দিলাম। আর বললাম, দেখ যেটাতে কাজ হয়। কয়দিন পরে খেলতে হবে তো।

— শেষ —