অনুগল্পঃ দৈনন্দিন

আমার ছোট শ্যালক ও তাঁর বউয়ের অনুরোধে (আসলে পুরকিতে) শুরু হয়েছিল – একশ’ শব্দের মধ্যে লেখা অনুগল্প। ওই যে হয় না? – I tag you for the challenge টাইপ। শ্বশুরবাড়ির চ্যালেঞ্জ! পুরকিটা খেয়ে ফেললাম। এদিকে তাঁরা কিন্তু মস্তি করে বেড়াচ্ছে। আর আমি লিখেই যাচ্ছি। পার্থ আসেপাশে যা দেখে, তাই নিয়ে প্রশ্ন তোলে মুরলির কাছে। আবার মুরলিও কুচুটেপনা করার জন্যে পার্থকেই বলে। দৈনন্দিন ঘটনা। ২০২০ সালের চালচিত্র।

– কল্লোল নন্দী

দৈনন্দিন – ১৫

পার্থ মুখ ব্যাজার করে মুরালির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে ঋষি অরবিন্দর উপরে কোন বই আছে?

মুরালি বলল, এত কিছু থাকতে, হঠাৎ ঋষি অরবিন্দ?

– জানতে ইচ্ছে করছে ওনার মত সক্রিয় বিপ্লবী কেন অনুশীলন সমিতি ছেড়ে আধ্যাত্মিক দিকে চলে গিয়েছিলেন। ভাবছি ওনার পন্থা নেব?

– সে কারণটা কেউ তেমন জানে না। কিন্তু হঠাৎ তুমি এই নিয়ে পরলে কেন?

পার্থ বলল, কি আর উপায়? তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ভুল চিহ্নে ভোট দিলে একটা গভীর অপরাধ বোধ হয়।

– তো ঠিক চিহ্নে দিলে না কেন?

– ছিল না তো একটাও যে!

দৈনন্দিন – ১৪

আচ্ছা জ্যামিতির ১০ নম্বর চ্যাপ্টারের কথা মনে আছে তোমার? মুরলি জিজ্ঞেস করল পার্থকে।

পার্থ বলল, না। ঠিক মনে নেই। কেন বলত?

মুরলি বলল, ওই চ্যাপ্টার থেকে সব শুরু হত এইভাবে। গোল মত একটা বৃত্ত আঁক। তার কেন্দ্রে O একটি বিন্দু বসাও। মনে পরে?

পার্থ “হ্যাঁ” বলতে বলতে দেখল মুরলির চোখ সোজা পার্থর ভুঁড়ির দিকে।

পার্থ জামাটা একটু সামনের দিকে টেনে নিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, নিজেরটা কি?

মুরলি বলল, স্নেহ যে আমায় বড়ই স্নেহ করে। তাকে বিদায় করি কি করে?

দৈনন্দিন – ১৩

“সুজাতাকে ভালবাসতাম আমি –
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে।”
– এই বলতে বলতে পার্থ এসে বসল মুরলির পাশে।

মুরলি বলল,
“এখন শেল্‌ফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভ্‌লভ্‌ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কিনা।”
এ তো “লোকেন বোসের জর্নাল।” তুমি তো গান গাওয়া শুরু করেছিলে।

একগাল হেসে পার্থ বলল, এটা সিজিনাল।

– মানে?

একটা হাঁচি সামলে পার্থ বলল, এই পলেন সিজিনে আমার খুব এলার্জি হয়। জানোই তো। এইসময়ে গানটা ঠিক …

একটা ন্যাপকিন পার্থর দিকে এগিয়ে দিয়ে মুরলি বলল, বুঝলাম। সেইজন্যে চারিদিকে এত কবিতা উৎসব।

তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।”
“সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি।”

— শেষ —

দৈনন্দিন – ১২

পার্থ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মুরলি একসময়ে চড়া দাগের বাজনাকে লোকে গেঁয়ো মনে করত। আজকাল তো দেখি সবই কান ঝালাপালা করা মিউজিক। তাহলে এখন সেইসব বাজনার পুনঃ-মুল্যায়ন করা উচিৎ না কি?

মুরলি উত্তর দিল, হরিপদর বউয়ের ঝগড়া শুনেছ? কেমন তারস্বরে চেঁচায় সে।

পার্থ একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, ঊফফ্‌! কিসের সাথে কিসের তুলনা?

মুরলি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওর ঝগড়া শুনে কোনদিন কিছু বুঝতে পেরেছ, কি নিয়ে ঝগড়া করে?

পার্থ কিছুটা বিভ্রান্তিতে পরল।

মুরলি বলল, বিষয়টা খুব সোজা। কথার মধ্যে যুক্তি কম থাকলে আওয়াজটা বাড়িয়ে দিতে হয়। তোমার মিউজিকের বিষয়টাও তাই।

— শেষ —

দৈনন্দিন – ১১

পার্থ বলল, মুরলি শুনলে তো? তোমার কথা শুনে সনাতন কি বলল?

– কি বলল?

– বলল,  গ্রাম্য এলাকায় এখনও গরুর গাড়ির চল আছে।

মুরলি একগাল হেসে বলল, খোঁজ নিয়ে দেখ সেখানে ভাষা দিবস পালন হয় কি? গরুর গাড়ি এবং বাংলা ভাষা দুইই সেখানে নিজের জোড়ে চলে। তাকে আলাদা করে পালন করতে হয় না। এসব হল শহুরে ব্যাপার।

— শেষ —

দৈনন্দিন – ১০

পার্থ কোনদিকে না-তাকিয়ে হনহন করে চলে যাচ্ছে দেখে মুরলি জিজ্ঞেস করল, কোথায় চললে হে ভায়া?

পার্থ বলল, আর বলো না। সরস্বতী পূজা ফেসবুক লাইভে ম্যানেজ করে দিলাম। এখন ভাষা দিবসের জন্যে কুড়ি-পঁচিশখানা মালা চাই। বোঝ ক্লাবের ঝামেলা!

মুরলি বলল, তা তো হবেই। যা নিজের জোড়ে চলে, তাকে আলাদা করে পালন করতে হয় না। “কেন কি”, যা গেছে – সেই সবের দিন পালন করতে হয়। ভাবছি, ক্লাবের জেনেরাল বডি মিটিং-এ গরুর গাড়ী ডে পালন করার প্রস্তাব দেব, সেও তো বিলুপ্তপ্রায়। একসময়ে সমাজে, বানিজ্যে, অর্থনীতি, মায় বাংলা গল্প-সিনেমায় এর ভুমিকা তো কম ছিল না।

— শেষ —

দৈনন্দিন – ৯

পার্থ একটা গান গেয়ে থামল। মুরলি বলল, বাহ! তোমার গানের গলা তো বেশ ভাল।

মুরলির কথায় উদ্দীপনা পেয়ে পার্থ বলল, আমিও ভাবছি এবার অন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে গানটাই করব।

মুরলি বলল, শোনো পার্থ, হেমন্ত একজনই হয়। “প্রায় হেমন্ত” সব গলিতে একজন করে থাকে। তাদের পেটে ভাতও জোটেনা। এইটা মনে রেখো।

— শেষ —

দৈনন্দিন – ৮

মুরলি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা পার্থ, তোমার বাড়ির সব তরকারিতে একটু ব্লিচিং-এর গন্ধ পাচ্ছি কেন বলতো?

পার্থ বলল, সব সবজি-পাতি থেকে করোনা ধুয়ে তবে রান্না করা হচ্ছে আজকাল। তাই।

– ও! এত তেল-মশলা দিয়ে কসিয়ে রান্না করলেও করোনা যায় না বুঝি?

— শেষ —

দৈনন্দিন – ৭

পার্থ উত্তেজিত হয়ে বলল, মুরালি দেখছ কি খবরটা? “কাঁচড়াপাডায় পালিত হল করোনা পূজা”।

মুরলি বলল, পার্থ তোমাকে আমি বলেছিলাম করোনা-তারিণী পূজাটা শুরু করে ফেল। ভাবলে মজা করছি তোমার সাথে। এখন নিজের চোখেই দেখ। আমি আর কি বলব?

— শেষ —

দৈনন্দিন – ৬

পার্থ বিরক্ত হয়ে বলল, মুরলি, সব জিনিষে ভেজাল – আর পারা যাচ্ছে না।

মুরলি মুচকি হেসে উত্তর দিল, খাঁটি জিনিষ কি সহ্য করতে পারবে? — যে মাথা গরম করছ।

– এটা কোন যুক্তি হল?

– আমি যা দেখছি, তাই বললাম।

– তার মানে?

– এই যে সবাই মিলে বাজে কোয়ালিটির চাইনিজ প্রোডাক্ট, বাজে কোয়ালিটির চাইনিজ প্রোডাক্ট বলে চিৎকার চেঁচামেচি কর। একটা গুড কোয়ালিটি প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়ল – তো সারা পৃথিবী হিমশিম খাচ্ছে। তাই বলছিলাম, খাঁটি জিনিষ চাওয়ার আগে একবার ভেবে দেখ।

— শেষ —