Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। দশ ।।

সেমিনারে মিস্টার পঞ্চম মিত্র তখন পুরো উদ্যমে বলে যাচ্ছেন। একটি মেয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে কোনার দিকে চুপ করে এসে বসল। কয়েকজন একটু বিরক্তির চোখে তাকাল, তবে কেউই বিশেষ নজর দিল না। একসময় সেমিনারের প্রেজেন্টেশন পর্ব শেষ হল। তারপর প্রশ্ন উত্তরের পর্ব। সব শেষে হলে একে একে অনেকেই বক্তার কাছে এসে নানান ভাবে অভিবাদন জানালেন। ‘Mr. Mitra, nice presentation.’ ‘Excellent works.’ ‘Superb findings.’ বেশ কিছু বিদেশী লোকও সেখানে আছে। হঠাৎ একটা মেয়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এসে বলল, ‘I have become a fan of you. Can I have an autograph of you?’ – বলে বা-হাতটা বাড়িয়ে দিল। সকলে হকচকিয়ে একটু সরে গেল – এই ধরনের ব্যাপার এন্টারটেইন্মেন্ট সেলিব্রিটিদের সাথে হয়, অ্যাকাডেমিকদের সাথে হয় না। বিদেশীরা রসিকতা করার সুযোগ কখনো নষ্ট করে না। একজন বিদেশী লোক বলে উঠল, ‘If I were you, young lady, I would have done the same thing. What a nice presentation!’ পাচু রুমিকে দেখে চমকে উঠল। ‘What are you doing here? দাও তোমার হাত।’ লিখে দিল, With Love, Pachu. আর একটু হেসে বলল, ‘She is my old friend.’ এই নাটুকেপনা দেখে দাঁড়িয়ে যাওয়া সবাই তাদের আটকে থাকা নিশ্বাস একসাথে ফেলল – তারপরে একে একে সবাই বের হয়ে গেল।

পাচু জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কিভাবে এখানে এলে? জানলে কি করে যে আমি এখানে আছি?’

– ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। আর পারলাম না তোমাকে ছেড়ে থাকতে। তোমার টানে খোঁজ নিতে নিতে চলে এলাম।’

শুনে পাচুর মাথাটা যেন ঘুরে উঠল। কোন রকমে নিজেকে সামলে বলল, ‘চল, আমার ঘরে। সেখানে বসে শুনবো।’

পাচু রুমিকে নিয়ে গেল নিজের স্টাডি রুমে। রুমি দেখল, চারিদিকে বই পুথি ছড়ানো, এক দিকে ফাইলের ডাই, কিছু ছবি – এক কথায় একটা অগোছালো পড়ার ঘর। রুমিকে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে পাচু নিজের চেয়ারে বসল। রুমি বলল, ‘কি দুর্দশা করে রেখেছ এই ঘরটার। এই বুঝি তোমার পড়ার নমুনা।’ পাচু একটু হেসে বলল, ‘সে তুমি যেভাবে ভাবো। একটু আগে তো সবার সামনে বলল তুমি আমার ফ্যান হয়ে গেছো। নেশা কেটে গেল এরই মধ্যে।’ রুমি বলল, ‘আমি গুছিয়ে দেবো?’ ‘রক্ষে করো। নিজেকে গুছিয়ে রাখো, তাহলেই হবে’, এই বলে পাচু একজনকে ডেকে কিছু একটা ইশারা করল। তারপর দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ। একটা ছেলে এক প্লেট খাবার নিয়ে এলো। সাথে কফি। ছেলেটা চলে যাওয়ার পরে পাচু বলল, ‘আজ ভালো দিনে এসেছ। ইন্টার-ন্যাশনাল সেমিনার চলছে। না হলে, শুধু চা ছাড়া আর কিছু জুটত না। নাও, ঠাণ্ডা হওয়ার আগে খেয়ে ফেল এবার।’

রুমি বলল, ‘কোনদিন দেখেছ কোন মেয়ে একজন ছেলের সামনে বসে একা একা খাচ্ছে?’ একটু থেমে বলল, ‘কোন প্রেম যে করছো না সেটা তোমার কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে, আমি খুব বেশী দেরি করি নি। কি বলো?’ এই বলে প্লেটটা একটু ঠেলে দিয়ে বলল, ‘নাও, তুমিও খাও।’

পাচু একটা প্যাটিস তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার একটু খুলে বলবে?’

রুমি বলল, ‘অনেকদিন ধরে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম তোমার কাছে আসব। তাই চলে এলাম। এখন আমার ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সৈকতকে সব বলে দিয়েছি।’

এই শুনে পাচুর গলায় প্যাটিস আটকে বিষম খেয়ে একাকার কাণ্ড। রুমি বলল, ‘তোমাকে কি খুব বিপদের মধ্যে ফেললাম? আমি সব ঠিক করেই এসেছি।’

এক গ্লাস জল খেয়ে দম নিয়ে পাচু জিজ্ঞেস করল, ‘এতই যদি আমাকে ভালোবাসো তো এতদিন বলো নি কেন?’

রুমি বলল, ‘বললে নতুন কি করতে? বলার জন্যেই আজ এসেছি। আর, এসেই তো বলে দিলাম। এখন যা করার করো।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাচু বলল, ‘এই দুই দিন তোমার থাকার একটা ব্যবস্থা করতে পারব। তারপর ভেবে দেখতে হবে। তবে এটা তুমি ঠিক করো নি।’

পাচু রুমিকে কিছু না বলে ঘড় থেকে বের হয়ে গেল। খানিক পরে ফিরে এসে বলল, ‘চলো আমার সাথে। তোমার জিনিসপত্র কোথায়?’ রুমি বলল, ‘আমি এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছি। সাথে অল্প কিছু টাকা ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই নেই।’

– ‘তোমাকে নিয়ে যে কি করব? এখন চলো।’

পাচুর পিছন পিছন রুমি চলল। ডিপার্টমেন্টের বাইরে এসে একটা সাদা অ্যাম্বাসেডরে করে রুমিকে নিয়ে গেল গেস্ট হাউসে। যেতে যেতে পাচু বলল, ‘এই সেমিনারে একজন রুম বুক করেও আসে নি। তাই এটাতে আপাতত তোমার জায়গা করে দিতে পারলাম আজ। ওখানে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সব বোলো আমাকে।’

রুমি দেখল ইন্টার-ন্যাশনাল সেমিনারের জন্যে গেস্ট হাউসটাকে আরও ভালোভাবে পরিষ্কার করে সাজিয়েছে। রুমে ঢুকে পাচু রুমিকে বিছানায় বসাল। তারপরে একটা চেয়ার টেনে রুমির সামনে এসে বলল, ‘এবার ঠাণ্ডা মাথায় বলো তো। কি ব্যাপার?’

রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কতদিন থাকা যাবে?’

– ‘দুই দিন।’

– ‘তারপরে?’

– ‘তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তার আগে কি হয়েছে বলো। না হলে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ এতদিন পরে রুমিকে এইরকম ভাবে পেয়ে পাচুর একবার মনে হচ্ছে রুমিকে জড়িয়ে ধরে, চুমুতে-আদরে ভরিয়ে তোলে। এইভাবে রুমিকে পাওয়ার জন্যে পাচুর মনে এইরকম কল্পনা যে উঁকি মারেনি তা তো নয়। আজ যখন রুমি নিজেই চলে এসেছে তখন অতশত ভেবে কি লাভ। রুমির চোখের দিকে তাকিয়ে পাচুর মনে হল ও রুমির চোখের ভাষা পরিষ্কার পড়তে পারছে। সে চাহনির যে আকুতি তা পাচুর কল্পনার থেকে অনেক বেশী; হয়ত আসলে তাই হয়। পাচুর মনে হল রুমি যেন চাইছে পাচু ওকে জড়িয়ে ধরে। পাচু ডান হাত দিয়ে রুমির চোখের উপর থেকে কিছু চুল সরিয়ে দিল। পাচু বুঝতে পারছে তার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বচ্ছন্দতা হারিয়েছে; তার উষ্মা ও ক্ষিপ্ততা একদম অন্য ধরনের; পাচু এর আগে কোনদিনই এইরকম অনুভব করে নি। তখন রুমি ধীরে ধীরে বলল, ‘তোমাকে খুব অসুবিধার মধ্যে ফেললাম দেখছি। আজ বিকেলে চলে যাব।’

– ‘না না। সে নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেব।’

– ‘অত চিন্তা করার কিছু নেই। বিকেল বেলায় সৈকত আসবে।’

– ‘তার মানে? আমাকে তো বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’

পাচুর যে হাতটা ধীরে ধীরে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল এক ঝটকায় পিছনে চলে এল। রুমি সেইটাকে টেনে নিজের কোমরের উপর দিয়ে বলল, ‘তোমার ভয় পাওয়ার কোন লক্ষণ আমি দেখলাম না। বরং যা দেখলাম, তাতে আমারই ভয় পাওয়ার কথা।’ তারপর বলল, ‘সৈকত বলল ওকে অফিসের কাজে শিলিগুড়িতে আসতে হবে। আমিও পিছু নিলাম। বললাম, চলো পঞ্চমের সাথে দেখা করে আসি। আজ সকাল থেকে ওর কাজে ও ব্যস্ত। বিকেলে আসবে এখানে।’

– ‘আমার সাথে দেখা করবে না?’

– ‘দেখা না করলে এই দস্যুর কাছ থেকে আমাকে কি করে উদ্ধার করবে?’

– ‘তা হলে তোমাদের আজ আর যাওয়া হবে না। ভালোই হল। আজ বিকেলের পরে আর কোন সেশন নেই। কাল সবাই ঘুরতে যাবে। এই সেমিনারের জন্যে আমারও বেশ পরিশ্রম গেছে। ভালোই হবে তোমাদের সাথে দুটো দিন কাটানো যাবে।’

– ‘এইভাবেই কি আমাকে ধরে বসে থাকবে এখন? না কি আর কিছু পরিকল্পনা আছে তোমার?’ সম্বিত ফিরে পেয়ে পাচু হাত টেনে নিয়ে বলল, ‘চলো লাঞ্চ করে নেই এইখানে।’

– ‘চলো’, বলে রুমি উঠে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এল। দুইজনে গেল ডাইনিঙে। লাঞ্চ খেতে খেতে পাচুর মনে হল, ভাগ্যিস আর বেশী কিছু ভেবে বসে নি। লাঞ্চ খেয়ে পাচু বলল, ‘আমার এখন সেমিনারে যাওয়া উচিৎ।’

বিকেল অবধি রুমি পাচুর পিছন পিছন সেমিনারে ঘুরল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সৈকত এল। পাচুর চাপাচাপিতে অবশেষে সৈকতকে রাজি হতে হল ওর হোটেল ছেড়ে এখানে আসতে।

তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে সৈকত আর রুমিকে নিয়ে পাচু বের হল ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাস ঘোরাতে। তখন লোডশেডিং শুরু হল। পাচু সৈকতকে বলল, ‘দেখবেন এখুনি চারিদিক থেকে জোনাকি উঠে আসবে রাস্তার দুই ধারে। দুইপাশের জোনাকির আলোয় আপনি রাস্তাটা বেশ দেখতে পারবেন। চোখটাকে একটু সময় দিন।’ বলতে বলতে রাস্তার দুই ধারে হাজার হাজার জোনাকি দেখা গেল আর তাদের আলোয় রাস্তার অবয়বটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকল। তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়াল মাগুরমাড়ি নদীর ব্রিজের উপর। পাচু বলল, ‘জানেন, বর্ষাকালে এলে বুঝতে পারতেন যে এইখানে যত ড্রেন আছে, সবই এই মাগুরমাড়ি নদীর ধারা, ইংরাজিতে যাকে বলে, Stream.

সৈকত বলল, ‘ভারি মজার ব্যাপার তো।’

পাচু পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে দূরে দেখতে পাচ্ছেন এক সারি আলো, এক পাহাড় থেকে নেমে অন্য পাহাড়ে উঠে গেছে, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন সেটা একটা নেকলেসের মত। ওটার নাম Necklace of Kurseong. সেটার ঠিক মাঝখানে pendant-টাও বুঝতে পারবেন। আর তার ভিতর দিয়ে যখন মোটর গাড়ি পাকদণ্ডি রাস্তায় বাঁক নেয়, তারার মত আলোর একটা হালকা ঝিলিক দেখা যায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন পাকদণ্ডি রাস্তাগুলো কিভাবে উঠেছে বা নেমেছে এবং গাড়িটা উপরে উঠছে, না নিচে নামছে।’

রুমি কিছুক্ষণ দেখার পরে যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারল, তারপর বলা সুরু করল এইবার আলোটা এই জায়গায় দেখা যাবে, তারপর সেই জায়গায় দেখা যাবে। আলো আবিষ্কারের খেলায় মেতে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই খেলার পরে একটা আলো দুইবার দেখতে পাওয়ার পরে যে যে জায়গায় দেখা যাওয়ার কথা আর দেখা গেল না। রুমি প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, ‘হয়ত গাড়িটার কোন অ্যাকসিডেন্ট হল।’ পাচু অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘না, এইরকম অনেক দেখা যায়; হয়ত ওই পথের মধ্যেই ওই ড্রাইভারের বাড়ি বা সেইখানে কুয়াশা ঘন হয়ে গেছে – তাই দেখা গেল না। পাহাড়ে এইরকম হামেশাই হয়।’ রুমি বলল, ‘আমি এ আর দেখতে চাই না। চলো গেস্ট হাউসে ফিরে যাই।’

গেস্ট হাউসের লাউঞ্জে বসে অনেকেই তখন গল্প করছে। ওরা এক কোনার একটা টেবিলে বসে তিনটে কফির অর্ডার দিল। সৈকত বলল, ‘এই ইউনিভারসিটির বাইরের রাস্তা দিয়ে আমি অনেকবার গিয়েছি। কোনদিন ভাবি নি যে ভিতরটা এত সুন্দর হতে পারে। এত ন্যাচারাল। আপনি না-থাকলে কোনদিন হয়ত জানাই হত না।’ রুমি বলল, ‘সেটা আমার জন্যেই হল, বলো।’ সৈকতকে চুপ করে থাকতে দেখে পাচু বলল, ‘আপনার স্ত্রীর কথা বুঝতে পারা খুব শক্ত।’ সৈকত হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার আর বুঝে কাজ নেই। আপনি বুঝলেই চলবে।’ আলোচনা আর বেশী বে-লাইনে যাওয়ার আগেই পাচু বলল, ‘আজ উঠতে হবে। কাল সকালে আসব।’

পরের দিন সকাল বেলায় সবাইকে বাসে তুলে দিয়ে যখন পাচু এলো, তখন প্রায় সকাল ন’টা। রুমি ঘরে একা বসে আছে। রুমি বলল, ‘সৈকত ওর কাজে সকাল বেলায় বের হয়েছে। দুপুরের পরে আসবে।’ তারপর কিছু একটা ভেবে রুমি পাচুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাল রাতে যেখান থেকে কার্শিয়ং-এর নেকলেস দেখিয়েছিলে সেখানে এখন নিয়ে যাবে?’ পাচু রুমিকে মাগুরমাড়ি নদীর ব্রিজের উপর নিয়ে গেল। দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় সেখান থেকে নেকলেসের কোন চিহ্নই দেখা গেল না। যা দেখা গেল তা শুধু এক সারি পাহাড়ের দৃশ্যপটাবলীর পিছনে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়া। ‘ফিরে চল।’

দিনে আর রাতে পাহাড়ের দৃশ্য যে এতটাই অন্যরকম হতে পারে – এর আগে রুমি কোনদিন এইরকম ভাবে দেখে নি, ভাবেও নি। মনে হল কাল রাতে যা দেখেছিল, সেইটে যেন অন্য কোন জায়গা। সারা রাস্তা গুম মেরে থাকল রুমি। পাচু রুমির অকারণ মেজাজ পরিবর্তন লক্ষ্য করল, তবে কিছু জিজ্ঞেস করল না।

সাজপোশাকের ব্যাপারে রুমি সবসময় সতর্ক; ও জানে শরীর ও পোশাকের কখন, কোনটা, কিভাবে হাইলাইট করতে হয়। আজ পড়েছে সাদা সালোয়ার-কামিজ। ‘সকালের হালকা রোদে তোমাকে এই সাদা সালোয়ার-কামিজে দারুন লাগছে’, একটু থেমে পাচু যখন রুমির কাছ থেকে কোন উত্তর পেল না, রুমির মেজাজটা হালকা করার জন্যে পাচু বলল, ‘যদিও সেরকম কিছু হাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই; এখন ঝুপ করে বৃষ্টি এলে এর মহিমাটা পুরোপুরি খুলত। কি বল?’ রুমি বড় বড় চোখে এক মুহূর্ত পাচুর দিকে তাকাল; কিন্তু কিছু বলল না। একইরকম ভাবে হাঁটতে থাকল।

গেস্ট হাউসে এসে রুমি ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ওর ঠিক একদম পিছনেই পাচু দাঁড়িয়ে। রুমি গলা থেকে ওড়নাটা টেনে মেঝেতে ফেলে দিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্বে পাচুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যদি তোমার কাছে ওই রকম একটা নেকলেশ চাই, আমার গলা ভরে থাকবে আর বুকের মাঝে পেনডেন্টটা জ্বলজ্বল করবে’, তারপরে পাচুর দিকে ঘুরে পাচুর চোখে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, ‘দেবে আমাকে?’

পাচু কিছু বুঝে বা না-বুঝেই বলল, ‘নিশ্চয় দেব।’ ‘তবে দাড়াও এখানে একটুখানি’, এই বলে রুমি বাথরুমে চলে গেল। পাচু হতভম্ব হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে রুমি ডাকল, ‘পঞ্চম, এইবার বলো। ভালো লাগছে? এইটাই তো দেখতে চেয়েছিলে তখন। তাই বা কেন অপূর্ণ রাখি আর?’

পাচুর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না; হাত এগোল না; পা পেছাল না। রুমি সাদা কামিজের উপরে কয়েক মগ জল ঢেলে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে একটা বড় কাঁচের জানালা। সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধবলগিরি। সূর্যের আলো তার উপরে এমন ভাবে ঠিকরে পড়েছে যে মনে হচ্ছে কেউ আকাশ থেকে ধবলগিরির মাথায় দুধ ঢালছে আর সেটা তার গা বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে। ধবলগিরি থেকে একটা টুকরো ছিটকে রুমি যেন এসে ঘরের মধ্যে পড়েছে।

জন্মদিনের কেক ফুল, মোমবাতি দিয়ে যখন টেবিলের উপরে সাজানো থাকে তখন তাকে কাটতে ইচ্ছে করে না; মনে হয় একবার কাটলেই তো তার সৌন্দর্যের সব শেষ; অথচ একটা সময় আসে যখন নিজের হাতে সেই সৌন্দর্য ধ্বংস করতে হয়। পাচুর এখন সেই আবস্থা। মন চাইছে রুমিকে এইভাবেই দেখে যেতে, একটুও না-সরিয়ে, একটুও না-নড়িয়ে; ভিজে কাপড়ে রুমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে; আলো-আবছায়ায় তনুতা, কোমলতা, লাবণ্য, মাধুর্য, যা কিছু আকর্ষণীয় এবং নারী দেহের যা যা লোভনীয় চোখের সামনে সেই সবই বিরাজমান; আর এই যন্ত্রনাদায়ক আকর্ষণ পাচুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রুমির ভিতরে। পাচুর ধমনিতে তখন রক্ত প্রবাহ উচু মাত্রায়, বিস্ফারিত চোখ, কিংকর্তব্য বিমুর অবস্থা। রুমি বলল, ‘কি হল? আমার যে এবার ঠাণ্ডা লাগছে।’

পাচু একটা তোয়ালে রুমির পিঠের উপর দিয়ে ওকে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল; নিজের জামা ভিজিয়ে ফেলল। পাচুর ওমে রুমি ডুবে পরস্পরের লাব-ডুব, ডুব-লাব স্পন্দনে আবিষ্ট হয়ে রইল অনেক্ষন। ধবলগিরির মাথার উপরে তখন এক টুকরো মেঘ এসে সমস্তটাকে ঢেকে দিল। তারপর?

দুপুর পার করে সৈকত ফেরত এলো – প্রমোশনের ফাইনাল অর্ডার হাতে নিয়ে। বলল, ‘এই দ্যাখো ফাইনাল অর্ডারটা একেবারে নিয়েই এলাম। এবার বম্বে চলে যেতে হবে, কর্পোরেট হেড-অফিস। চলো আজই বেড়িয়ে পড়ি এখান থেকে। তোমার জন্যেই এইটা হল, তুমি না-থাকতে চাইলে হয়ত আজ যেতাম না সেখানে। আরো কতদিন লাগত কে জানে?’ খুশীতে সৈকত রুমিকে কোলে তুলে নিল।

রুমি হাসি হাসি মুখে সব গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে; কিন্তু পাচুর কোন পাত্তা নেই। সৈকত বলল, ‘পঞ্চমের সাথে দেখা না-করে যাওয়াটা ঠিক হবে না। ও জোড় করে না-রাখলে আজ হয়ত এটা হত না।’

পাচু যখন এলো, রুমি আর সৈকত সব গুছিয়ে রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত। পাচু সব শুনে সৈকতকে কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে ওদের বাসে তুলে দিতে এল। বাসে ওঠার আগে রুমি সৈকতকে আড়াল করে পাচুর হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ গুঁজে দিয়ে, আর আলতো করে একটা চিমটি কেটে বাসে উঠে গেল। বাস ছেড়ে দিল।

পাচু কাগজটা খুলে পড়ল – আজকের ভিজে স্মৃতিকে নিয়ে এখন চললাম। কিছুদিনের মধ্যে বম্বে চলে যাব। সেখানে পৌঁছে ঠিকানা পাঠিয়ে দেব। একবার এসো কিন্তু। পুনঃ- দেখলাম তোমার জামায় আমার কালো টিপটা এখনো লেগে আছে, সেইটে এইবার তুলে ফেল।

পাচু জামার পকেটের উপর থেকে কালো টিপটা টেনে তুলে প্রথমে আঙ্গুলের ডগায় নিল। তারপর পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিল। লাব-ডুব, ডুব-লাব শুনতে শুনতে একা ফেরত চলে এল নিজের ঘরে।

— শেষ —

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10