Home » ছোট গল্প » চতুর্দশী » জয়দীপের উস্কানি

জয়দীপের উস্কানি

তেত্রিশ বছর হয়ে গেল – আমার পিছনে জয়দীপের উস্কানি দেওয়া এখনো গেল না। স্কুলে পড়ার সময়ে জয়দীপের হাতের লেখা ছিল তাকিয়ে থাকার মত সুন্দর এবং পরিষ্কার। তাই ওর অন্য সব গুণাবলি বাদ দিলেও শুধু সুন্দর হাতের লেখার জন্যেই হাতে-লেখা ক্লাস ম্যাগাজিন কমিটিতে চিরকালই ওর একটা পাকাপাকি স্থান ছিল। এই কমিটির ছেলেপুলে মোটামুটি তিন-চার সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন টিফিনের পরে মিশনের মণ্ডপে বসে ম্যাগাজিন বানাত। স্কুলের কড়া নিয়ম না-ভেঙ্গে ক্লাস না-করার এই উপায়টাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল সবচেয়ে বেশী। সুযোগ করে ঢুকে গেলাম সেই কমিটিতে। কাজ ছিল – ডাই করা লেখা পড়ে সেগুলো বাছাই করা, কিছু লতা-পাতা, কলকে এঁকে, দাঁত মাজার পুরানো ব্রাশ দিয়ে লাল-নীল-সবুজ রঙ স্প্রে করে ম্যাগাজিনটা সুন্দর করে তোলা। আমার কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া।

হাতে লেখা দেওয়াল ম্যাগাজিন বানানোতে যে কাজটা সবচেয়ে কঠিন ছিল তা হল, গল্প বাড়ানো বা কমানো। দেওয়াল পত্রিকার লে-আউটটা আগে তৈরি হত, তারপরে যথা স্থানে উপযুক্ত লেখা বসিয়ে, এক-আধটা ইলাসস্ট্রেশন দিয়ে সেটা সাজানো হত। প্রায়শই পাণ্ডুলিপি অর্ধেক বা তার বেশী অংশ কপি করার পরে দেখা যেত বাকি লেখার পরিমাণ নির্ধারিত জায়গার থেকে বেশী বা কম। তখন সেই গল্পগুলোকে অ্যাডজাস্ট করাটা ছিল একটা কঠিন কাজ।

একবার মহা বিপদ হয়েছিল জয়দেবের লেখা হারিয়ে গিয়ে। এদিকে জয়দেবকে বলা হয়ে গেছে যে ওর লেখা ম্যাগাজিনে প্রকাশ হবে। গল্পের ঝারাই বাছাই পর্বে আমি সেই গল্পটা পড়েছিলাম। ক্লাসে সম্ভাব্য ঝগড়াঝাঁটি এড়ানোর জন্যে আর জয়দীপের প্ররোচনায় আসল গল্পের যতটা মনে ছিল সেই মূল কাহিনীটা ঠিক রেখে নির্ধারিত জায়গায় আঁটবে এইরকম একটা গল্প কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে লিখে ফেললাম। পরে দেখেছিলাম সেই গল্পটা স্কুল ম্যাগাজিনে জয়দেবের নামে ছাপা হয়েছে। এনিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা ছিল না, কারণ প্রথমত আমার উদ্দেশ্য ছিল ক্লাস কামাই করা এবং দ্বিতীয়ত আমি তখন ব্যস্ত সায়েন্স ফেয়ার নিয়ে – স্কুলের নিয়ম বাঁচিয়ে আবার ক্লাস কামাই দেওয়ার আরও এক দীর্ঘমেয়াদি উপায় হাতে এসে গেছে তখন।

কিন্তু ওই যে বললাম, আমার পিছনে জয়দীপের উস্কানি দেওয়া – ওর চিরকালের অভ্যাস। যেকোন কারণেই হোক – আমাদের শিক্ষক রাজরাখাল বাবুকে এই গল্প তৈরির ভিতরের ঘটনা বলে জয়দীপ ওনার কাছে চরম বকা খেয়েছিল।

জয়দীপের উস্কানির কারণেই বোধহয় রাজরাখাল বাবু তার পরের বছর  আমাকে পাঠিয়েছিলেন মালদহের এক বিখ্যাত সাংবাদিক, গবেষক ও সাহিত্যিক শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর কাছে। সুধীর বাবুর ভয়ঙ্কর রকমের রাশভারী ব্যক্তিত্ব এবং খুব লম্বা গলা থাকার জন্যে মালদা শহরে ওনাকে ‘জিরাফ’ নামে সবাই চিনত। সে যাই হোক, লেখার বিষয়বস্তু আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল – সেটা সাধারণ লোকের না-জানা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। পরাধীন ভারতে মালদহে জিতু সরদার নামে এক সাঁওতাল মোড়ল তার দলবল নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে শহিদ হয়েছিলেন। শুধু তীর-ধনুক দিয়ে এই সাঁওতাল দল ব্রিটিশদের অনেকদূর সরিয়ে দিয়েছিল। পরাজিত ব্রিটিশ কমান্ডার তখন এক স্থানীয় জমিদারের সাহায্য নিয়ে জিতু সরদারকে শান্তির জন্যে ডেকে পাঠিয়ে হত্যা করে। সুধীর বাবুর বলে যাওয়া কথাগুলো গুছিয়ে লিখে দেখি তারমধ্যে আর বিশেষ কিছু করার নেই। রাজরাখাল বাবুকে লেখাটা জমা দিয়ে বললাম – এর প্রায় সবই সুধীর বাবুর কথা – হুবহু দিয়ে দিয়েছি, কারণ একে বদলানো মুর্খামি হবে। তার বছর দুই পরে, আমি তখন স্কুল পাস করে কলেজে পড়ি – রাজরাখাল বাবু ডেকে বললেন, তুই একটা সায়েন্স ফিকশন লেখ এবার। লিখেছিলাম – “মহাকাশ থেকে বলছি”।

এই লেখাটা ডেকে এনেছিল দুইটা বিপদ। ছোটোদের বিজ্ঞান গোছের এক মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার ডাক পেয়ে সায় দিয়েছিলাম। ছদ্মনামে বছর দেড়েক লিখেও ছিলাম। ছদ্মনামে লিখে বন্ধু মহলে সেই নামের সাথে নিজের আসল নামটা জুড়ে দেওয়ার মত ক্যালানে মার্কা কাজ কখনো করিনি। তাই এতে শুধু নিয়মিত লেখা দেবার চাপ ছাড়া আর বিশেষ কোন চাপ ছিল না। কিন্তু সেটা একটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন।

আর মারাত্মক যেটাতে ফেঁসেছিলাম সেটা হয়েছিল মালদা কলেজের দেওয়াল পত্রিকার সম্পাদনা। অমরের পুরকি খেয়ে আর কিছুটা হাতের কাছে কিছু না-করতে পারার জন্যে আমরা একবার ঠিক করলাম একটা ক্লাস ম্যাগাজিন বের করবো। এই পরিকল্পনা ক্লাসে বলা মাত্র কবিতার ছড়াছড়ি পরে গেল সেখানে। হঠাৎ করে প্রায় সবাই কবি হয়ে গেল। তার একটা নমুনা দেই।

ঝকঝকে সবুজ গাছটা

একরাতের বৃষ্টিতে সারা মাথা

লাল করে বেড়িয়ে এলো।

অকস্মাৎ এক বজ্রপাত

ছিটকে পড়ল তার নরম ডাল

– ঝুম।

– কবি ভবোতোষ মণ্ডল।

কবিতাটা আমাদের হাতে দিয়ে ভবোতোষ বলল, পইড়লে মনে হইবে ন্যাচার, কিন্তু আসলে এইটা হইল গে নারী।

ভাবলাম, সেই তো, কবি মন যদি এইটুকু হেঁয়ালি না করে, তো করবে কি ওই হরিপদ কেরানি?

অমর ফস করে জিজ্ঞেস করল, কি রে? ওর বিয়ে হয়ে গেছে?

ভবোতোষের মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়িয়ে এলো – একখানা শব্দ – হ্যাঁ।

অমর জিজ্ঞেস করল, ওর বিয়ের দিন কি খুব বৃষ্টি হয়েছিল?

ভবোতোষ এবার চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, তুই কি করে জানলি?

অমর বলল, সেটা ছাড়। কতদিন প্রেম করেছিলি?

ভবোতোষের একদিকে খুব উৎসাহ যে ওর কবিতা থেকে এত কিছু বোঝা গেছে, অন্যদিকে লজ্জা এবং হাফসুল খাওয়ার ব্যথা – চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।

কথা ঘোরানোর জন্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর ওই বজ্রপাত, নরম ডাল, ঝুমের ব্যাপারটা কি?

ভবোতোষ বলল, একবার ও পিছলে পরে গিয়েছিল। তাতে ওর গলার চেনটা ছিঁড়ে লকেটটা ছিটকে পরে ছিল – তার শব্দ।

তারপর সেসব লেখা ঝারাই বাছাই করতে করতে আমাদের প্রাণ যায়।

কফিনের শেষ কাঁটাটা পুতেছিল আমার বন্ধু, দেবু। দেবু বেশ ভালোই কথা বলে।

অমর ওকে বলল, দেবু, তুই একটা গল্প লেখ তো – একটু রম্য রচনা – এই কবিতা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।

এরপরে দেবু লেখা শুরু করল। ও রোজ আমাদেরকে বোম্বে রোডের সায়েসে খেতে নিয়ে যায় আর ওর গল্পের অগ্রগতির খবর দেয়। হাতে লেখা চোদ্দ পাতা গল্প শেষ করে যখন নিয়ে এলো, অমর পড়ে বলল, অরে দেবু, তরে আমি রম্য রচনা লিখতে কইছিলাম, পর্ণ রচনা নয়।

দেবু বলল, সেরকম লাগছে বুঝি? দে, কাল ঠিক করে দেবো।

পরের দিন দেবু আবার আমাদেরকে সায়েসে নিয়ে খাইয়ে দাইয়ে যেটা দিল, তাতে যা কারেকশন ছিল তা হল – বাথরুম কেটে বেডরুম, বেডরুম কেটে ড্রয়িংরুম – এই গোছের। আর সাথে তিন নামি লেখকের তিনটি গল্প। দেবু বলল, এই সব গল্পের সাথে আমার গল্পের কি পার্থক্য? আমি যা বলি স্পষ্টাস্পষ্টি বলি, ওরকম রেখে ঢেকে বলি না।

অমর আমাকে চোখের ইশারায় বলল – এখানে তর্ক নিষ্প্রয়োজন। আমি চেপে গেলাম।

দেবু চলে যাওয়ার পরে অমর বলল, ভাবতে পারিস সায়েসে আমদের জন্যে দেবু কতো টাকার বিল দিয়েছে? হোস্টেলে ওকে হয়ত ধার করে এই মাসটা চালাতে হবে। এরপরে যদি ওর লেখা না-বের করি ব্যাপারটা কি ভালো হবে?

চোদ্দ পাতার সেই পর্ণ রচনাকে তিন পাতার একটা রম্য রচনাতে পরিবর্তন করতে অমরের না-হোক, আমার বাংলা জ্ঞানের শেষ নির্যাস টুকু বের হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করেছিলাম অনেক হয়েছে এই সম্পাদনা – এবার ক্ষান্ত দাও বাবা – করার মত অন্য অনেক কিছু আছে এই পৃথিবীতে।

কিন্তু, জয়দীপ? তেত্রিশ বছর হয়ে গেল – আমার পিছনে উস্কানি দেওয়া ওর এখনো গেল না। ও আমাকে এই চতুর্দশী লিখিয়েই ছাড়বে।

— শেষ —