Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। ছয় ।।

কয়েকদিন নানা কাজে রুমির সাথে দেখা হয় নি। সেদিন শুক্রবার। বিকেল বেলায় পাচু রুমির বাড়িতে দরজায় বেল টিপতেই, সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়া এক ভদ্রলোক দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন – ‘বলুন।’ পাচু আমতা আমতা করে, ‘না, মানে’ বলতে না-বলতেই রুমি এসে সেই লোকটির পিছনে দাঁড়ালো – ‘আরে, ওখানে কেন? ভিতরে এসো।’ লোকটি বুঝলেন, এ রুমির চেনা। আর কিছু না জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘আসুন।’ পাচু দুই পা ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে আর লোকটি তখন দরজার ছিটকিনি লাগাচ্ছেন। পাচুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমি বলল, ‘আরে দাঁড়িয়ে কেন? বসো।’ ততক্ষণে লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বসুন।’ এই বলে, সোফার দিকে হাত বাড়ালেন।

পাচু তখনো প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারে নি। ধীরে ধীরে সোফায় বসল। রুমি লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দেই। ওর নাম, পঞ্চম। ওই যে তোমাকে বলেছিলাম না, সেইদিন সেই রিকশাওয়ালার…।’ রুমিকে আর কিছু না-বলতে দিয়ে লোকটি নিজেই বললেন, ‘আরে ভাই, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব। বুঝতেই পারছেন, আমরা নতুন, কারোর সাথে সেইরকম ভাবে আলাপ পরিচয় হয় নি। আপনি যে কি উপকার করেছেন সেদিন, কি বলব। অসংখ্য ধন্যবাদ। ও তো আপনার কথা আমাকে প্রায়ই বলে।’

পাচুর বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হল না যে ইনি ঘটনাটা ভালোভাবে জানেন। কিন্তু কতটা জানেন, আর কি কি জানেন – সেইটেই বড় প্রশ্ন।

পাচু ভাবল, এইরকম মেয়েকে নিয়ে যে ঘর করছে, সে হয় একটা বে-বোদা লোক হবে নাহলে ভয়ঙ্কর ধুরন্ধর লোক হবে। কথা শুনে তো বে-বোদা বলে মনে হচ্ছে না। এইটুকু ভাবতেই পাচু ভয়ে একরকম সিটকে গেল। বলল, ‘এই নিয়ে আপনাদের এত সৌজন্য দেখানোর কিছু নেই।’ বিষয়টা হালকা করার জন্যে বলল, ‘আমি তখন ওখানে বসেছিলাম। দেখলাম, রিকশাওয়ালাটা বেশ উদ্ধত হয়ে পাড়ার এক ভদ্রমহিলার সাথে ঝগড়া করছে, তাই ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ব্যাপারটা মিটে গেল। এর বেশী আর কিছু করিনি।’

রুমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। কোমরটা বাঁদিকে ঠেলে ঘাড় কাত করে ভ্রু-দুটো টেনে তুলে, অনেকটা অজন্তার মূর্তির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও তাই বুঝি?’

পাচুর কান দুটো ঝাঁঝাঁ করে উঠল। ভাবল, এই বুঝি লোকটি পাচুর গালে কসে একটা থাপ্পড় লাগায়। সুন্দরী মেয়েকে একা পেয়ে ছোকরা তুমিও কম যাও নি। পাচুর চোয়ালটা সক্ত হয়ে উঠল, ভয়ে চোখ দুটো বুজে এল। ঘোর কাটল যখন শুনল লোকটি বললেন, ‘কি যে বলেন আপনি? আপনার সাহায্যের কথা আমি সব শুনেছি ওর কাছ থেকে।’

পাচু এবার ধন্ধে পরল, দেখল রুমি পাচুর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। পাচুর সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ‘আজকাল অন্যের বিপদে কেউ আসে না, দেখলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আপনি যেভাবে সেই দিন ওর উপকার করেছিলেন, তার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’ লোকটি বলেই চললেন, ‘আপনার সাথে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার নাম সৈকত বোস।’ এই বলে লোকটি যখন পাচুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তখন পাচুর কিছুটা হলেও সম্বিত ফিরে এল। পাচুও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করল। এইবার রুমি পিছন ঘুরে আঁচল টেনে ভিতরে চলে গেল।

পাচু সৈকতের সাথে এটা-সেটা নানান কথা বলল। সৈকতের সব কথাতেই পাচুর মনে হল ওর কুকীর্তি সবটা না জানলেও কিছুটা হয়ত জানে। মাছ জল থেকে তোলার আগে যেমন একটু খেলায়, উনি ওকে এখন সেইরকম খেলাচ্ছেন। ফেঁসে যখন গেছে, তখন এই সুতোর টানে চলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। একবার মনে হল বলে, আপনার সাথে আলাপ করে খুব ভালো লাগল, পরে আবার কথা হবে – এই বলে এখনকার মত বিদায় নেয়। আবার ভাবল, যদি জিজ্ঞেস করে বসেন, কি জন্যে এসেছিলেন? – সেইটে তো বললেন না। ভাবল বলবে, এমনি এসেছিলাম। এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম একবার খবর নিয়ে যাই – এই আর কি। যদি জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মাঝে মাঝেই এইরকম ভাবে এসে খবর নিয়ে যান? পাচুর মনে হল মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। কিছুই মনে আসছে না। নিজের প্রতি বিরক্তি এল। কি দরকার ছিল এই অভিসারের?

সৈকত জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি করেন?’ পাচু বলল, ‘এম-এ পরীক্ষা দিয়ে আপাতত বেকার।’ রুমি তখন চা-বিস্কুটের ট্রে নিয়ে ঘরে এল। বলল, ‘দেখো না তোমাদের কোম্পানিতে কোন ভালো পোস্ট…।’ ‘খোঁজ করতে পারি, তবে সেক্ষেত্রে ষষ্ঠীকে যে চাই এই পাড়াতে। পঞ্চম কাজে চলে গেলে তোমাকে কে বাঁচাবে রিকশাওয়ালাদের হাত থেকে?’ বলেই সৈকত হা-হা করে হাসতে থাকল, ‘তোমার যা মুখ! কতবার বলি এইসব নিয়ে রাস্তাঘাটে ঝগড়াঝাঁটি করো না।’

পাচু বেশ একটা মজা পেল। ভাবল, রুমি এবার জব্বর কিছু একটা বলবে। কিন্তু রুমি কিছু না-বলে, ওদের দুইজনকে চা এগিয়ে দিয়ে সৈকতের সোফা চেয়ারের হাতলের উপর এমন ভঙ্গিতে ঝুঁকে বসল যে পাচুর মনে হল পাচু যেন এক্স-রে ছবির মত রুমিকে দেখতে পাচ্ছে। কারুর সাথে কথা বলার সময়ে তার দিকে না-তাকিয়ে কথা বলা অভদ্রতা, বিশেষ করে সে যখন সে বাড়ির কর্তা, আবার তাকালে তারই সামনে তার বউয়ের যে আবয়ব চোখে পরে তা অন্য সময়ে আর যায় হোক, এই মুহূর্তে অস্বস্তিকর। পাচু কখনো চোখ ছোট, কখনো কুচকে, কখনো বড় করে, যতটা সম্ভব রুমির মিটিমিটি হাসি, বসার দেহ-ভঙ্গি এড়িয়ে কথা বলা যায় তাই বলল। চা শেষ হতেই কোন ভণিতা না-করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আজ উঠি। আমার একটা কাজ আছে। দেরি হয়ে যাবে।’ এই বলে, সেখান থেকে বিদায় নিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10