দোষ ডে

বাড়ীতে এখন আমার মেয়েদের সাথে আমার একটা খেলা মজার খেলা চলে – সেই খেলার নাম ‘দোষ ডে’ – একেকদিন একেকজনের দোষ ডে পরে। সেইদিন যেখানে যা কিছু হোক সব নির্ধারিত জনের দোষ। যেমন ধরা যাক, তরকারি পুড়ে গেছে, বা উত্তরাখণ্ডে পাহাড়ে ধস নেমেছে, কিংবা ফোনে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না – সবই তার দোষ। এই উদ্ভট খেলা শুরু হয়েছিল আমার হোস্টেল থেকে। সে এক মারাত্মক ঘটনার কথা বলি।

ছেলেদের হোস্টেলে রাতে এক নাইট গার্ড থাকত। কি গার্ড দেওয়া তার দায়িত্ব – সেটা নিয়ে কেউ ভাবত বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা অনেকটা দারা সিং-এর বডি গার্ড রাখার মত হাস্যকর। কলেজ নির্বাচনের পরে কিছু স্থানীয় গুণ্ডা ছাত্ররা যখন উৎপটান ঝামেলা করতে আসত তখন নাইট গার্ড প্রথমেই লুকত রান্নাঘরের পিছনে। সে যাই হোক, নাইট গার্ড রাত দশটায় মেইন দরজায় তালা বন্ধ করে আধ বোতল দেশী মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তারপরে হোস্টেলে ঢুকতে গেলেই হাজারো ঝামেলা। সারারাত এসো না – কারুর কোন মাথা ব্যথা নেই, কেউ খোঁজও করবে না কেবল কয়েকজন বন্ধু ছাড়া।

কোন এক রাতে এইসব ঝামেলা এড়াতে নাইট-শো সিনেমা দেখে বাকি রাতটা স্থানীয় বন্ধুর বাড়ীতে থেকে গেলাম। পরেরদিন সকাল সাতটা নাগাদ হোস্টেলে ঢুকেই দেখি পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে। বুঝলাম, কিছু একটা হয়েছে। এই অবস্থায় প্রথম কাজ হল নিজের গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে সব খবর নেওয়া। তাই করতে গেলাম। সেখানেও সবাই গম্ভীর – সবাই ভাবছে – কিছু একটা ভাবছে – গভীর অনুসন্ধান – কি যে উদ্ধার করতে চলেছে কে জানে?

একজন আমাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে চাপা স্বরে বলল, কয়েকজন সুপারের ঘরের সামনে পেচ্ছাপ করে তারপরে কয়েক বালতি জল ঢেলে সেটাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভোর পাঁচটা থেকে সেই নিয়ে দফায় দফায় মিটিং হয়ে গেছে।

আরও বলল, এরকম কাজ তো আমরাই করি, তাই সবার নজর এখন আমাদেরই উপর।

আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কে করেছে?

ও বলল, আমাদের মধ্যে কেউ না।

ওকে বললাম, যেই করুক ভালোই করেছে।

যে রাতে এইসব হয়েছে সেই রাতে আমি হোস্টেলে ছিলাম না। তাই এবার সাইড লাইনে বসে মজা দেখার পালা। ঘরে এসে শুনলাম সকাল থেকে বেশ কয়েকজন আমার নিরীহ রুমমেট দুজনকে কয়েকবার জেরা করে গেছে যে আমার রাতে হোস্টেলে না থাকার ব্যাপারে ওরা কোন মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছে কি না। হোস্টেলে তখন সবাই গোয়েন্দা। যে ছেলে লোডশেডিং হয়ে গেলে একা বাথরুমে যেতে ভয় পায় – সেও গোয়েন্দা! কারুর দরজা বন্ধ থাকলেই কেউ না কেউ বাইরে থেকে কান পেতে শোনে ভেতরে কি কথা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের সব হোস্টেলের মত আমাদের হোস্টেলেও চারটে গোষ্ঠী। প্রথম দুটো শক্তিশালী এবং সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী, তৃতীয়টিকে কেউ পাত্তা দেয় না – তারা হচ্ছে আমরা রাজা আমাদের নিজের দলে, আর চতুর্থটি গাণ্ডেপিণ্ডে খায় আর দরজা বন্ধ করে সারাদিন ভুল অঙ্ক মুখস্থ করে। বেশ কিছুদিন ধরে চলল এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে সন্দেহ করা। তাতে যখন কিছুই পাওয়া গেল না, তখন সরু হল নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে খোঁজা। সে কি গোয়েন্দাগিরি! সুযোগ পেলেই তোষকের তলে, বালিশের ভিতরে অনুসন্ধান চলছে, কত ছেলের ডায়েরী পড়া হয়ে গেল – কত কি যে ঘটে গেল। তাও কোন কিছুর হদিস পাওয়া গেল না। এদিকে শোনা গেল, কারা যেন সেই জল থেকে পেচ্ছাপ আলাদা করে এবং দেওয়ালে পেচ্ছাপের দাগ দেখে অনুমান করেছে যে এতে কমপক্ষে পাঁচজন তো ছিলই।

হোস্টেলের কুকর্মগুলো হত একটা সমবেত প্রকল্প – তাতে কমপক্ষে তিনজন থাকতই এবং কেউ না কেউ কাউকে বলেই দিত। আশ্চর্যজনকভাবে পাঁচজন মিলে এইরকম কুকর্ম করে গেল অথচ কোন গোষ্ঠী কোন কিনারা করতে পারল না। কেউ কেউ আবার মেয়েদের হোস্টেলেও গোয়েন্দাগিরি চালাল – কেউ যদি মেয়েদের কাছে হিরো গিরি করার জন্যে কাউকে কিছু বলে থাকে। তাতেও কোন ফল হল না। এদিকে সুপারকে সবাই যে যার মত প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল – সব ফেইল। আমার তো বেশ মজা হচ্ছিল, যে দ্যাখ এবার – সবসময় আমার উপর দোষ দেওয়া?

এই ফরেনসিক এবং তথ্যভিত্তিক গোয়েন্দা ও গবেষণা-গিরি সব যখন বিফল, সবাই পরল আমার উপর, যে তুই বল তোর সাথে আর কে কে ছিল?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে?

একজন বলল, তার মানে, তুই আর কে কে এই কাজ করেছিলি সেই রাতে?

মজার ব্যাপার হল যারা জেরা করছিল তার মধ্যে আমার বন্ধুরাও ছিল। কথা কিছুদূর এগোনোর পরে বুঝলাম – এটা কোন রসিকতা হচ্ছে না। এসব গোয়েন্দাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু আমি এইরকম কিছু একটা করব সেই জন্যেই আমি আটঘাট বেঁধে রাতে হোস্টেলের বাইরে থেকে রাতের বেলায় এসে আমার দলবল নিয়ে এই কাজ করে আবার পালিয়েছিলাম এবং সকাল সকাল উঠেই দেখতে এসেছিলাম যে জল এতদূর গড়িয়েছে।

বললাম, বেশ তো। তোদের হিসাবের বাকি চারজনকেও নিয়ে আয়, সবাই মিলে গল্পটা সাজানো যাবে।

উত্তরটা এলো খুব সোজাসুজি – সেইজন্যেই তো জিজ্ঞেস করছি তোর সাথে আর কারা ছিল।

বললাম, আমি সেই রাতে অনুপের বাড়ীতে ছিলাম। অনুপ এসে বললে বিশ্বাস হবে তো তোদের?

উত্তরে বলল, অনুপ কি তোর জন্যে এইটুকু মিথ্যে কথা বলবে না?

এরপরে শুরু হল সবাই একদিকে আর আমি একা নিজের সপক্ষে। নিরীহ গোছের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম ভিতরের রহস্যটা বোঝার জন্যে – কোন ফল হল না। তারপর এক সন্ধ্যেয় ওই তৃতীয় গোষ্ঠীর মাথাটার কাছে গেলাম। দুএকটা কথার পরে ওকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা যে আমাকে সন্দেহ করছ, কেন? কেউ ওকে পাত্তা দিয়েছে এই খুশিতে ও যা বলল – শুনে আমি হতবাক।

সে বলল, প্রথমত এটা হোস্টেলের তিন গোষ্ঠীর কারুর কাজ নয় – সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সুতরাং, অন্যকোন নতুন গ্রুপ এই কাজ করেছে।

আমি বললাম, তা বেশ – তাতে আমি কোথায় এবং কিভাবে?

সে বলল, তোর সব ইয়ারের ছেলেদের সাথে সমান বন্ধুত্ব আছে। সুতরাং, রাতারাতি তুই আর একটা গ্রুপ বানাতে পারিস।

নিজের এত বড় ক্ষমতার কথা জানতাম না। পারি বা না পারি, শুনে খুশি হয়ে বললাম, আমি তো সেই রাতে হোস্টেলে ছিলাম না। অত রাতে এলে কেউ দেখতে পেত না আমাকে?

সে বলল, তুই তো এক লাফে প্রাচীরে উঠে বা গেটের উপর দিয়ে আসতে পারিস।

আমি বললাম, রোগাদের পৃথিবী ততো জোড়ে টানে না, তাই আমার মত আনেকেই পারে। কিন্তু, সামনে দিয়ে এলাম আর কেউ দেখতে পেল না আমাকে?

সে বলল, হয়ত জানালা দিয়ে ঢুকেছিলে।

আমি বললাম, তার মানে?

সে বলল, মনে আছে? ফুলুর রুমমেট দরজায় তালা দিয়ে বাড়ী চলে গিয়েছিল আর ফুলুর চাবিটা ঘরের মধ্যে ছিল। তখন তুই জানালার দুই শিকের ভিতর দিয়ে ঘরে ঢুকে ওর চাবিটা উদ্ধার করেছিলি।

আমি বললাম, সে তো ওর উপকার করার জন্যে।

সে বলল, সে যাই হোক, তুই সেভাবেও আসতে পারিস।

আমি বিরক্তিতে ওকে বললাম, ধন্য তোমরা সকলে। বড় হলে নাপিত হবে – হোস্টেল ছেড়ে যাওয়ার সময় ঠিকানাটা দিয়ে যেও। কোনদিন তোমার শহরে গেলে চুল-দাড়ি কেটে আসব।

বুঝলাম, আমার এটা দোষ ডে নয়, দোষ সিজন চলছে।

— শেষ —