একদিন দীপক এল ওর টপ বসের ঘরে, পনের দিনের একটা ছুটির দরখাস্ত নিয়ে। বিশেষ কোন কারণ ছাড়া এত দীর্ঘ ছুটি মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে সাধারণত দেওয়া হয় না, তাই কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট দীপককে সোজাসুজি পাঠিয়ে দিয়েছিল টপ বসের কাছে। তিনি একমাত্র এই রকম একটানা দীর্ঘ ছুটি মঞ্জুর করতে পারেন।
দীপক গৌতমের চেম্বারের দরজাটা একটু ফাঁক করে বলল, May I come in, Sir?
গৌতম টেবিল থেকে চোখ তুলে দীপককে দেখে বলল, Please come.
দীপক ঢুকতেই গৌতম বলল, Please sit down. কি ব্যাপার? বলো।
দীপক প্রথমে দুই-একটা কাজের কথা বলে, আসল কথাতে এল। বলল, স্যার আমার পনের দিনের ছুটি চাই। প্রজেক্টের কোন ক্ষতি হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে যাব।
দীপক ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেই এই চাকরিতে ঢুকেছে। মিশুখে ছেলে, সবার সাথে মানিয়ে চলে। কোম্পানিতে ওর একটা সুনাম আছে। দুই বছরের মধ্যে সে একটা প্রমোশনও পেয়ে গেছে। গৌতম দীপককে বেশ পছন্দ করে।
গৌতম নিজেও একজন ইঞ্জিনিয়ার। একই কলেজ থেকে পাস করেছে। দীপকের থেকে তিন বছরের সিনিয়র। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে গৌতম এই মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি শুরু করেছে। প্রথমদিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, তবে এখন এই লাইনে এই কোম্পানিকে অনেকেই চেনে। দুটো কাজে খুব ভালো রিভিউ বেরানোর পর থেকে এখন আর তেমন অসুবিধে হয় না। কাজের চাপ প্রতিদিন বেড়েই চলেছে।
গৌতম জিজ্ঞেস করল, তোমার কাজের দায়িত্ববোধ নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই। আমি জানি, তুমি সেসব ব্যবস্থা না করে আমার কাছে আসোনি। তবে পনের দিনের একটানা ছুটি, তাও এখন থেকে একমাস পরে। কি ব্যাপার?
দীপক বলল, স্যার আমার বিয়ে।
গৌতম আর কি বা বলবে? ছুটির আপ্লিকেশনে গ্রান্টেড লিখে একটা সই করে দিল।
দীপক গৌতমকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ওর বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে, বৌভাত অনুষ্ঠানে যেতেই হবে; আমি কোন অজুহাত শুনব না; ইত্যাদি বলে সেখান থেকে বিদায় নিল।
ছুটিতে যাওয়ার আগের দিন দীপক আবার এলো গৌতমের ঘরে, পুরো কাজের দায়িত্ব কাকে কিভাবে দিয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে, বৌভাতের অনুষ্ঠানে গৌতম যেন অবশ্যই যায় তার একরকম প্রতিশ্রুতি নিয়ে সেখান থেকে বের হল।
যথা দিনে গৌতম যখন দীপকের বৌভাতের অনুষ্ঠানে পৌঁছালো, দীপক নানা ব্যস্ততার মধ্যেও সকলের সাথে গৌতমের আলাপ করিয়ে দিল। গৌতম দেখল, দীপক সব কাজ একই রকমভাবে মনোযোগ দিয়ে করে। একটা ফুলের বুকে আর একটা গিফট চেক দীপকের নতুন বউয়ের হাতে দিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে গৌতম বিদায় নিল।
এর পরে আরো কিছুদিন পার হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট দিনে দীপক যেদিন কাজে যোগ দিল, গৌতম দীপককে ওর চেম্বারে ডেকে পাঠাল। বিয়ের সবকিছু সুষ্ঠু ভাবে মিটেছে কিনা, বাবা-মা এবং বাড়ির অন্য সবাই কেমন আছেন, হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলে ইত্যাদি কথাবার্তা হওয়ার পরে জিজ্ঞেস করল, তোমার বউয়ের সাথে তোমার কিভাবে আলাপ হল? আগে থেকে চিনতে? পারিবারিক সূত্রে বা অন্য কোনভাবে?
দীপক বলল, একদমই না। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের বিয়ের সম্পর্ক হয়।
এই শুনে গৌতম খুব উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বিজ্ঞাপন দেখে চিঠি পাঠালে?
– না, আমার বাবা যোগাযোগ করেছিলেন।
– বেশ, তারপর কি হল?
দীপক বলল, চিঠিতে আমাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা দেওয়া ছিল। রুমার বাবা একদিন আমদের বাড়িতে ফোন করে আমার বাবার সাথে কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন। কি কথা হয়েছিল তা ঠিক আমি আজও জানি না।
– কখন ওদের সাথে দেখাশোনা হল? তোমরা ওদের বাড়ি গেলে, না ওনারা এলেন?
– বাবা দিনক্ষণ ঠিক করেছিলেন। আমরা সেইদিন ওদের বাড়ি গেলাম।
– সেখানে যাওয়ার পরে কি হল?
– সেখানে পৌঁছে দেখলাম সবাই বসার ঘরে বসে আছে, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। অন্য বাড়ীতে সাধারণত যেমন হয় যে, পাত্রী পরে চা-মিষ্টি নিয়ে আসে, সেই রকম নয়। সকলের সাথে আলাপ পরিচয়টা হয়ে গেল। নানান কথাবার্তা, ওই যেমন হয়।
– রুমার বাবা, মানে তোমার শ্বশুর-মশাই, তোমাকে কিছু প্রশ্ন করেন নি?
– করেন নি আবার! দীপক, তুমি কি পড়াশুনো করেছ? কোথায় কাজ করছ? তোমার সেখানে কি পজিশন? কি ফিউচার ইত্যাদি, হাজারো প্রশ্ন।
– তো, তুমি কি বললে?
– আমি বললাম, আমি একজন গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার। পাস করেই মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে ঢুকেছি। জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢুকেছিলাম, বছর দেড়েকের মধ্যে প্রমোশন পেয়ে আমি এখন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। কারেন্টলি একটা বড় প্রজেক্টের দায়িত্বে রয়েছি। আর মাইনে পত্র নিয়ে আমাকে সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি, তবে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। বাবা পরে আমাকে বলেছিলেন।
– বেশ। তারপরেই তোমাদের বিয়ে পাকা হয়ে গেল?
– অনেকটা সেরকমই বলতে পারেন। তবে আরও কয়েকবার কথাবার্তা হয়েছিল। ওরাও আমাদের বাড়ি এসেছিলেন।
– বাঃ, বেশ। ভালো থেকো। Wish you a very happy conjugal life.
– Thank you, Sir.
এরপরে দীপক কয়েকটা কাজের কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
গৌতম শুধু একবার হাসল। দীপকের বৌভাতে রুমাকে দেখার পর থেকেই গৌতম এই কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে অপেক্ষা করছিল, কারণ মাস ছয়েক আগে গৌতম ওই একই কারণে রুমাদের বাড়ীতে গিয়েছিল। রুমার বাবার প্রশ্নের উত্তরে গৌতম বলেছিল, আমি একজন গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার। পাস করে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং কোম্পানি খুলেছি, নাম মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। প্রথমদিকে অনেক অসুবিধে ছিল, দুটো কাজে ভালো রিভিউ বের হওয়ার পর থেকে এখন বেশ ভালোই চলছে। ছয়জন গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার আর চারজন নন-ইঞ্জিনিয়ার কাজ করে আমার কোম্পানিতে।
কয়েকদিন পরে, রুমার বাবার কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছিল। তা এইরকম –
প্রিয় বীরেশ বাবু,
আশাকরি গত রবিবার আপনারা সকলে ভালভাবে বাড়ি পৌঁছিয়েছিলেন। সপরিবারে আমাদের বাড়িতে আসার জন্য আপনাদের সকলকে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আরও একবার ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের সাথে আলাপ করে আমাদের সকলের অত্যন্ত ভালো লেগেছে। আপনার পরিবারের সকলকে এবং বিশেষত গৌতমকে আমাদের সকলেরই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।
আমি গৌতমের সাথে রুমার বিয়ে দিতে পারলে সত্যই খুশি হতাম। তবে নানান দিক বিবেচনা করে আমরা ঠিক করলাম যে, ব্যবসায়ী ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না, আর্থিক ভরসা পাই না। আপনাদের প্রস্তাবে রাজি না হতে পাড়ার জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত।
আমরা গৌতমের আরও সাফল্য কামনা করি, মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আরও নাম করুক। আপনারা সকলে ভালো থাকবেন।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে,
শ্রী রমেশ সরকার (রুমার বাবা)।
— শেষ —