Home » ছোট গল্প » অন্যান্য » সফল প্রচার

সফল প্রচার

সেদিন সকালের প্রথম বাসে মালদা থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার জন্যে রওনা হয়েছি। স্টেট বাসের কাউন্টার খোলা মাত্র একটা টিকিট কেটে বাঁদিকের জানালার পাশে একটা সিটে বসে পড়লাম। চোখে তখন আমার ভীষণ ঘুম। পাশের সিটে কে এসে বসল, বা বাসে কারা উঠল সে দিকে খেয়াল করার মত কোন উৎসাহ আমার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস মালদা শহর ছেড়ে রওনা হল। খুব সকালের দিকে শহরের রাস্তা ফাঁকা, তাই হুহু করে বাস চলল। জানালা দিয়ে সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলে বেশ একটা ঝিমুনি আসে – সেইভাবে চলেছি।

প্রায় ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পরে, বাসটা হঠাৎ ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। চোখ খুলে দেখলাম, হাট বসেছে, রাস্তার দুই পাশে লোকে লোকারণ্য, আর তার জন্যেই এই ভিড়। গরুর গাড়ি, টাঙ্গা গাড়ি, রিক্সা, সাইকেল যত্রতত্র, কে যে কোন দিকে যেতে চায় তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। এরই মধ্যে আমাদের বাস এবং আরও কিছু গাড়ি কোনরকমে এগোচ্ছে। সমাজে হাটের অর্থনৈতিক উপযোগিতা নিয়ে অনেক পড়েছি, কিন্তু এইজন্যে যে যাত্রাপথে এত বিভ্রাট হতে পারে সেটা সবাই বেমালুম চেপে গেছে। সেইটে ভেবে তখন ভীষণ রাগ হল। তা যাহোক, আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উদ্বেগ ছিল না।

হাট নিয়ে মজা করতে কেউ কখন ছাড়ে নি – এমনকি রবীন্দ্রনাথও নয়। নাহলে কি ‘হাট’ কবিতায় লিখতেন? – গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন। আমাদের আমলেও ছিল। সতিনাথ নিজের জমি থেকে তুলে অনেক ধনে নিয়ে বসেছে, পাইকারি দরে বেচবে বলে। রমানাথ বাবু, এক আঁজলা ধনে নিজের হাতে তুলে পরীক্ষা করে বলেন, “কি হে সতিনাথ, এ যে দেখছি তোমার ধনেতে পোকা!” সতিনাথ দুই পায়ের মধ্যে তার লুঙ্গিটা গুটিয়ে নিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে উত্তরে দিল, “হলেও হতে পারে”।

তা যাই হোক, কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর যাই ভালো লাগুক, রসিকতা ভালো লাগে না। এইসব মনে পরাতে আরও বিরক্ত লাগল। চারিদিকে ঘ্যান ঘ্যান, প্যান প্যান করে মাইক বাজছে আর নানান রকম প্রচার চলছে। মনে হল, এই জায়গাটা পার হলে যেন বাঁচি।

এমন সময় বাসের ডান দিকের সব যাত্রী একটা কিছু শুনে বাঁদিকে জানালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার ঘাড়ের উপর, মাথার উপর দিয়ে বেশ কয়েকজন উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। বিরক্ত হলাম বটে, তবে উৎসাহও পেলাম যে এমন কি বলছে যে সবাই শুধু শোনা নয়, বক্তাকে দেখতেও চায়।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, সেই সময়ে দেশে ভিসিপি আর ভিডিও ক্যাসেটের চল নতুন শুরু হয়েছিল। তাই দিয়ে নতুন ব্যবসাও চালু হয়েছিল তখন। শহরে, গ্রামে ছোট ছোট ভিডিও হল তৈরি হয়েছিল। সেগুলোতে কম পয়সায় নতুন নতুন সিনেমা দেখান হত – ভিসিপিতে ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে কালার টিভিতে দেখান হত।

আমাদের বাস তখন যেখান দিয়ে যাচ্ছিল, সেই জায়গাটার নাম কালিয়াচক। সেখানেও এইরকম ভিডিও হল গজিয়ে উঠেছিল। তারই প্রচারকার্য চলছিল একটা ঘোড়ার গাড়ি থেকে।

এইবার আমি মন দিয়ে শুনলাম এবং দেখলাম। ঘোড়ার গাড়িতে একটা ছেলে বসে মাইক নিয়ে বলছে, আর তার সাথে ইকো লাগিয়ে দিয়েছে। সে বলছে,

কালিয়াচকের বিখ্যাত হাসানের ভিডিও হলে চলছে তেরি মেহেরবানিয়া, আ, আ, আ, আ, ……

শো-টাইম, দুপুর একটা, বিকাল চারটা, এবং সন্ধে সাতটা।

এতে নায়কের ভূমিকায় আছেন জ্যাকই শুরুফ। নায়িকার ভূমিকায় আছেন পুনম ধিলান, লান, লান, আন, আন, ……

এতে একটা কুত্তার সিন আছে, এ, এ, এ, এ ……

আর ওনেক-খন ধরে একটা ইজ্জত লেবার সিন আছে, ছে, ছে, ছে, এ, এ, এ, ……

হোস্টেলে পৌঁছে আর দেরী করিনি। সেইদিনই নাইট-শো দেখতে গেলাম – “তেরি মেহেরবানিয়া”।

— শেষ —