Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। দুই ।।

মাস কয়েক পার হয়ে গেছে। একদিন পাচু দেখতে পেল সেই মহিলা এক রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। বেশ কিছুক্ষণ দূর থেকে মজা দেখার পরে, পাচু রিকশাওয়ালার কাছে এসে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে? উনি কি কম ভাড়া দিচ্ছেন?’ রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করে মহিলার এমনিতেই মেজাজ গরম, তার উপরে পাচু এসে হাজির সেখানে। মহিলা মনে মনে কোন প্রমাদ গুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। পাচু তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাজার থেকে এখানকার ভাড়া কত?’ সেই রিকশাওয়ালাটি বলল, ‘দশ টাকা।’ পাচু এবার এই রিকশাওয়ালার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, ‘ইনি কত দিয়েছেন?’ ‘বারো টাকা’, রিকশাওয়ালাটি বলল, ‘তবে রাস্তায় তিন জায়গায় থেমে ছিলেন।’ পাচু বলল, ‘এবার যদি এখান থেকে না-কাটিস, তাহলে এমন ব্যবস্থা করব যে বাকি সারাটা দিন তোকে এইখানেই থেকে যেতে হবে। করব নাকি?’

রিকশাওয়ালা আগেই পাচুকে বসে থাকতে দেখেছিল। উপরি ভাড়া না-পেয়ে শেষ খোঁচা দেওয়ার চেষ্টায় রিকশাওয়ালা পাচুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এর মধ্যে আসছেন কেন? আপনি এনার কে হন?’ পাচু বলল, ‘আমি? আমি ওঁর নাগর রে।’ এই বলে, রিক্সার হর্নটা আস্তে করে টিপে জামাকাপড়ের ব্যাগটা রিক্সা থেকে উঠিয়ে মহিলার হাতে তুলে দিল। মহিলা ‘ছিঃ’-বলে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।

তার দুই-দিন পরে, দুপর গড়িয়ে বিকেল হয়নি তখনো, পাচু একা রাস্তার ধারে বারান্দায় বসে একমনে আনন্দবাজার পড়ছে। সেই মহিলা পাচুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাচুকে বলল, ‘এই যে শুনুন।’ হঠাৎ মহিলাকে এত কাছে দেখে – মিলিটারি কমান্ডার অ্যাটেনশন বললে, অধস্তন মিলিটারিরা যেমন ভাব করে – পাচু অনেকটা সেইরকম ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে, বলুন।’ মহিলা আর এক পা কাছে এসে বলল, ‘সেদিন আপনি নিজে থেকে এসে, আমার হেনস্থা হওয়া থেকে আমাকে বাঁচালেন, আর আমি আপনাকে ধন্যবাদটুকু না বলে, আপনার উপরে রাগ করে চলে গেলাম। তারপর থেকে আমার খুব খারাপ লাগছে; ভাল করে ঘুমাতে পারি নি, জানেন। আপনাকে খোঁজার জন্যে কয়েকবার এদিকেও এসেছি।’

পাচু আমতা আমতা করে বলল, ‘ও আর এমন কি? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।’ পাচুর কথা কানে না-তুলে মহিলা বলল, ‘আমার সাথে একটু আসুন এখন।’ এই বলে তিনি পাচুর দিকে না-তাকিয়ে হাঁটা দিলেন। পাচুও বাধ্য ছেলের মত তার পিছন পিছন চলতে লাগল। মহিলা পাচুকে নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। বসার ঘরে পাচুকে বসতে বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতে চায়ের ট্রে আর সাথে কিছু নিমকি ও বিস্কুট। বললেন, ‘একটু চা না খেলে আমি ভাবব আপনি এখনো আমার উপরে রাগ করে আছেন।’

পাচু চায়ের কাপ আর কয়েকটা নিমকি তুলে নিল। দুজনে চা খেতে লাগল। কোন কথা খুঁজে না-পেয়ে পাচু বলল, ‘এইসবের কোন দরকার ছিল না। এইসব না-করলেও পারতেন।’

সে কথার উত্তর না দিয়ে মহিলা বলল, ‘আমাকে আপনি বলবেন না তো। হয়ত আমি আপনার সমবয়সী হব। তাছাড়া, আমাকে কেউ আপনি বলে ডাকলে, আমার কেমন যেন লাগে। আমার নাম রুমি। আপনি রুমি বলেই ডাকুন।’

পাচু কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে কিছু না-ভেবেই বলল, ‘ঠিক আছে। আমার নাম পাচু। মানে, পাড়াতে এই নামেই আমাকে সবাই ডাকে।’

মহিলা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার ভালো নাম কি? পাচু নামটায় আপনাকে ঠিক মানায় না। কিছু মনে করবেন না যেন – আপনার নামে নিয়ে এইরকম ভাবে বললাম বলে।’

পাচুর মাথা থেকে একটা হালকা ঠাণ্ডা কাঁপুনি পা অবধি নেমে গেল। ঘরের মধ্যে একটা হালকা সুগন্ধ ওর নাকে এসে লাগল। এর আগে পাচু নিজের নাম নিয়ে কোনদিন ভেবেছে বলে পাচুর নিজেরই কিছু মনে পরল না। যতদূর মনে পরল ছোট থেকে সবাই ওকে পাচু বলেই ডাকে। পাচু বলল, ‘আমার ভালো নাম, পঞ্চম মিত্র। বাবা রাহুল দেব বর্মণের ফ্যান ছিলেন। ওনার নামের নকল করে আমার নাম রেখেছিলেন – পঞ্চম। সেখান থেকে পাচু।’

– ‘বাঃ! কি সুন্দর নাম আপনার। আর সেইখান থেকে পাচু?’ তারপরে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আপত্তি করেন না কেন?’

পাচু ততক্ষণে কিছুটা ফর্মে ফিরে এসে বলল, ‘প্রথমত, আপনাকে তুমি বলব যদি আপনিও আমাকে তুমি বলেন।’ তারপরে হাসতে হাসতে বলল, ‘আর পঞ্চম যে পচা হয়ে যায় নি, পাচুতে আটকে গেছে, সেই ভাল নয় কি?’

মহিলা বলল, ‘বেশ তুমিই বলব। বয়স্ক মানুষ না-হলে আমি ঠিক আপনি-টাপনি বলতে পারি না।’ নিজের চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘তা, তোমার বাবা যখন এই নাম রেখেছিলেন, তার মানে তুমি নিশ্চয় ভালো গান করতে পার।’ এই বলে মহিলা ওড়নাটার মাঝখান ধরে টেনে গলা থেকে নামিয়ে, আচল দুটো পেছন থেকে কোলের মধ্যে টেনে নড়েচড়ে বসল।

পাচু এই প্রথম মহিলাকে খুব কাছ থেকে শান্ত হয়ে দেখল – ওর কথা বলার মধ্যে এক ধরনের উচ্ছলতা আছে – মনে হয়, শুধু মুখ নয়, চোখ দিয়ে, কখনো সারা শরীর দিয়েও কথা বলে। দূর থেকে দেখলে যার যৌবনের উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছুই চোখে পরে না, কাছ থেকে দেখলে তার সারল্য ছাড়া আর কিছুই বড় একটা আকর্ষণ করে না। পাচু বুঝল, সুগন্ধটা ঘর থেকে না, রুমির কাছ থেকে আসছে।

পাচু বলল, ‘আপনার ছেলের নাম যদি আইনস্টাইন রাখেন, তা হলে কি সে বিজ্ঞানী হয়ে যাবে?’

মহিলা চোখ বড় বড় করে ধমকের সুরে বলল, ‘আবার আপনি!’

সম্বোধনটা পাচুকে বাঁচিয়ে দিল। খোঁচাটা টেনে নিজের ছেলের দিকে এগোয়নি, ভাগ্যিস। পাচু তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি গান শিখি নি। বাবা একটা চেষ্টা করেছিলেন। তবে এই বিষয়ে আমার এলেম বুঝতে পেরে সেদিকে আর বেশী ঠেলেন নি। বরং তুমি গান শোনাও। দেখুন, তুমি বললাম এবার।’

রুমি বলল, ‘শোনাতে পারতাম। তবে এখন কারেন্ট নেই তো, তাই হচ্ছে না।’

এই কথার মানে বুঝতে না-পেরে পাচু জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে?’

– ‘অনেকে বলে আমার গলার স্বরটা নাকি অনেকটা লতা মঙ্গেশকরের মত। তাই ঠিক করেছি, উনি যখন গান করছেন, আমার না করলেও চলবে। দরকার হলে লতার ক্যাসেট চালিয়ে দেই। আমি করলেও একই রকম শোনাত – তাই কি না?’

ঠিক সেই সময়ে সিলিং ফ্যানটা ঘোরা শুরু করল। টিউব লাইটা দুই-একবার জ্বলে-নিভে পুরোপুরি জ্বলে উঠল। রুমি আর পাচু দুজনেই হা-হা করে হেসে উঠল।

পাচু বলল, ‘আজ উঠি। চায়ের জন্য ধন্যবাদ।’

– ‘ও শুধু চা-টাই ভালো লাগল, আমার সাথে গল্প করতে ভালো লাগল না বুঝি?’

পাচু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘না মানে, সেটা তো নিশ্চয়ই।’

– ‘ঠিক আছে। তা চা-ই হোক আর আমি হই, চলে এসো। আমি এই সময়ে ফাঁকাই থাকি। তোমার সাথে গল্প করে খুব ভালো লাগল।’

পাচু একটু থেমে, দম নিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই আসব।’ এই বলে পাচু ওখান থেকে চলে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10