রাত পোহালেই মহালয়া। সাহেবের গাড়ি গ্যারাজে রেখে হরিপদ আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে। ওকে দরজা খুলে দিয়ে দেবারতি চলে গেছে রান্নাঘরে। চা আর একটু মুড়ি – বাড়ি এসে, হাত পা ধুয়ে, হরিপদর এই একটাই চাহিদা।
হরিপদ রোজকার মত সোজা চলে গেল শোয়ার ঘরে। সেখানে একটা আলমারি – তাতে হরিপদর সব কাজের জিনিষ থাকে। বাড়িতে এসে ওখানে এটা-সেটা করা হরিপদর রোজকার অভ্যাস। হরিপদর কড়া নির্দেশ – ওই আলমারি যাতে কেউ না হাত দেয়, এমনকি দেবারতিও না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম দেবারতির বেশ কৌতূহল ছিল; তখন কয়েকবার নাড়া-ঘাটা করে হরিপদর কাছে ধরা পরেছে এবং প্রচণ্ড বকাও খেয়েছে। এই পাঁচ বছরে দেবারতির সেটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ও জানে, ওখানে কিসব কাগজপত্র, সাহেবের চিঠি, সুন্দর উপহার বাক্স – হরি রাখে, আবার দু-একদিন পরে নিয়ে যায়। ওসব সাহেবের জিনিস। হরি সাহেবের ড্রাইভার – সাহেবের হয়ে এসব লেনদেন করাও ওর কাজের মধ্যে পড়ে।
আজও হরি কিছু রাখল সেখানে। তারপর উর্দি খুলে, হাত পা ধুয়ে, ঘরে-পরার জামাকাপড় পরে, ডাক দিল, রতি।
একান্তে এই নাম ধরে ডাকলে দেবারতির ভালো লাগলেও সবার সামনে ডাকলে প্রথম দিকে কেমন একটা অস্বস্তি হত – বেশ কয়েকবার আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু হরিপদর জেদ, ও ওই নামেই ডাকবে। রতি বলে ডাকতে হরির বেশ একটা রোমাঞ্চ হয় – বিশেষ করে সারাদিন পরে এইসময়।
দেবারতি চা মুড়ি নিয়ে এসে বসল হরিপদ গা ঘেঁসে। দুজনে টিভির সামনে বসে চা মুড়ি খেতে খেতে কিছু অবান্তর কথাবার্তা হল। একসমেয়ে হরিপদ বলল, রাত পোহালেই মহালয়া।
দেবারতি জানে, এর পরে কি কি ঘটবে। চা খাওয়া শেষ হলেই হরিপদ রেডিওতে নতুন ব্যাটারি লাগাবে আর ঘড়িতে অ্যালার্ম দেবে। তারপরে চলবে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখার যে সব ঠিক আছে কিনা। রেডিও এই বাড়ীতে বছরে এই একদিনের বেশী খুব একটা ব্যবহার হয় না।
হরিপদর মতে, মহালয়াই হল দুর্গাপূজার আসল কথা। পূজার দিনগুলোতে শুধু হই-হুল্লোড়, মাইকের আওয়াজ, আর লোকের ভিড়। সেটা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে পিকনিক করার মত মজা, সেখানে পূজার শান্তি কোথায়? ছোটবেলা থেকে মহালয়ার এইদিনটাকে হরিপদর খুব ভালো লাগে – আধো ঘুম, আধো জাগরণে আগমনীর গানে শুরু হয় দিনটা। নতুবা সকাল হলেই তো শুরু হয় কলতলায় কলসি-বালতিতে ঠোকাঠুকি আর কথা কাটাকাটি। তারপরেই মিছিল-মাইক আর মোটর গাড়ির শব্দ – বিরক্তিকর!
ততক্ষণে চা-মুড়ি খাওয়া হয়ে গেছে। হরিপদ উঠে গিয়ে রেডিওর কাটা একদম ঠিক আকাশবাণীতে রেখে পরীক্ষা করছে যাতে সেটা পরিস্কারভাবে শোনা যায়। দেবারতি চলে গেছে রান্না ঘরে – ভাত বসাচ্ছে। হরিপদ বলল, বুঝলে রতি, এই মহালয়ার জন্যেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে সবাই চিরকাল মনে রাখবে।
রান্নাঘরের ভিতর থেকে উত্তর এল, সেটা ঠিকই বলেছ তুমি।
কিছুক্ষণ পরে দুজনে খেতে বসল। আবার কিছু অবান্তর কথাবার্তা, নেহাতি সংসারের কথা হল। দেবারতির মনে হল – আজ হরিপদ খুব খুশিতে আছে, তবে কখনো কখনো যেন আনমনা হয়ে যাচ্ছে। কে জানে?
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ। দেবারতি বাসনপত্র তুলে, খাওয়ার টেবিল পরিষ্কার করে, শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘরের একটা লাইট ছাড়া ঘরের প্রায় সব লাইট নিভে গেছে তখন। ওদিকে হরিপদ ওর আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। দেবারতি শুতে যাওয়ার নাইটি পরতে যাবে, এমন সময়ে হরিপদ দেবারতিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল – হাতে একটা শাড়ির ব্যাগ।
– রতি, এই দ্যাখো।
– পূজোর শাড়ি তো কিনে দিয়েছ। এটা আবার কি জন্যে?
– কেন? তোমার জন্যে।
বলতে বলতে দেবারতিকে জড়িয়ে ধরে রেখে হরিপদ শাড়ির ব্যাগটা ছিঁড়ে শাড়িটা বের করে ফেলল।
– এ তো অনেক দাম! দেবারতি চমকে বলে উঠল।
– তা হোক, অনেক দিন ধরে তোমার এটার উপর লোভ ছিল।
– না, মোটেই লোভ নয়, দোকানে শো-কেসে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত, তাই দেখতাম। আমি এর দাম জানি – এত দামী শাড়ি! এত টাকা কোথায় পেলে?
হরিপদ টাকা-পয়সার প্রায় সব কথাই দেবারতিকে বলে।
– সাহেব আজ অনেক টাকা পূজোর বোনাস দিয়েছে।
– কত?
– চার মাসের মাইনে, চল্লিশ হাজার টাকা।
দুটোই দেবারতির কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে খেয়াল করে দেখে সামনেই আয়না – নিজে বস্ত্রহীন, হরি ওকে হাঁ করে দেখছে আর ও হরির গায়ের সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে। দেবারতি লজ্জায় মুখ নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
– কি হচ্ছে? ছাড়ো।
দেবারতি ‘ছাড়ো’ বলল, কিন্তু নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ওর সাড়া শরীর তখন অবশ; ঘাড়ের উপর হরিপদর গরম নিশ্বাস পড়ছে, আর তাতে দেবারতি কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর অনুভুতিতে সময় তখন থেমে গেছে; কি যে ভাবছে, কি সব হয়ে যাচ্ছে – ও নিজেও জানে না। হরিপদ কখন যে দেবারতির হাত থেকে নাইটি সরিয়ে দিয়েছে তার কোন খেয়াল নেই দেবারতির।
বাংলায় যাদের ফর্সা মেয়ে বলা হয় – দেবারতি তাদের মধ্যেই পরে। কাঁচের বাক্সে রাখা মডেলের মত না হলেও দেবারতির চেহারা অনেকেরই নজর কাড়ে। হরিপদ এবং দেবারতি – দুজনেই সেটা ভালো করে জানে।
পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে হরিপদর নিজের পরিবারবর্গ বলতে শুধুমাত্র এই দু’জন। এর পেছনের গভীর থেকে গভীরতর কারণ খোঁজার জন্যে তাদের প্রায় সব কাছের মানুষই বিনা পারিশ্রমিকে কোন না কোন সময়ে সত্যান্বেষীর ভূমিকায় এসেছিল। তারা সকলেই নিজের মত কোন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সে কাজ সমাপ্ত করেছে। মাঝে মাঝে সেই সব সত্যান্বেষীরা নিজেদের অনুসন্ধান নীতি এবং তার ফলাফল নিজেদের মধ্যে বিনিময় করে নতুন কোন সর্বগ্রাহ্য ফলাফল বের করার চেষ্টা করে। এই কথা হরিপদ এবং দেবারতি ভালো করেই জানে। দেবারতি এ নিয়ে কখনো-সখনো ভাবলেও হরিপদর মাথায় এনিয়ে চিন্তার বিশেষ কোন স্থান নেই। সে নিজের মত করে কিছু একটা ভেবে নিয়েছে। আত্মীয় ও প্রতিবেশী মহিলারা – যারা ভাবেন কোন এক সময় তারাও দেবারতির মত সুন্দরী ছিলেন – তাদের অকারণ বিদ্রূপে দেবারতি মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়। এছাড়া এ নিয়ে তার আর কোন মাথা ব্যথা নাই।
দেবারতি তখনো দুই হাতে মুখ ঢেকে একই রকম ঠাই দাঁড়িয়ে আছে আর হরিপদ দেবারতিকে শাড়ি পরানোর চেষ্টা করে চলেছে – ঠিক যেমন কাঁচের বাক্সের মডেলের গায়ে পরানো ছিল।
কৌতূহল যখন লজ্জাকে ছাপিয়ে গেল, দেবারতি তখন দুই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে আয়নাতে হরির কাণ্ড দেখে, না বলে আর পারল না।
– শাড়ি পরতে হলে আগে সায়া পরতে হয়।
হরিপদ সেটা জানে, তবে মডেলের গা থেকে দোকানদার যখন শাড়িটা খুলেছিল, সেটা সে ছবির মত মনে রেখেছে – রাতে রতিকে ঠিক একই রকমভাবে পরিয়ে দেখবে বলে। তাই প্রচণ্ড মন দিয়ে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু উত্তর দিল, একটুও নড়বে না।
অল্পক্ষণ পরে হরি উঠে দাঁড়াল। আঁচলের অংশটা রতির বা-কাঁধের উপর দিয়ে পিছন দিকে ফেলে বলল, এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই আমার কাছে। এবার দ্যাখো কেমন লাগছে।
দেবারতি দেখল, খালি কোমরে শাড়ি জরিয়ে যেভাবে তার মধ্যে কুঁচি দিয়েছে তাতে বেশ কেতা আছে বলতে হবে। তবে মুখে বলল, আমি কি এবার থেকে অর্ধেক বুক খুলে রাস্তায় বেড়াব?
হরিপদ বিব্রত বোধ করল। সেটাকে এড়িয়ে বলল, তুমি তো এখন রাস্তায় নেই।
– তা হলে এই ফ্যাশনের কি লাভ? এ কি শুধু তোমার সামনে?
দেবারতির বেশ এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে – তা ভালোও না; আবার খারাপও বলা চলে না। নিজেকে এভাবে দেখে – লজ্জা এবং অস্বস্তির সাথে এমন ভালোলাগা, হরির একটু ছোঁয়াতেই সারা শরীরে কাঁপুনি – অনেকদিন পরে আজ পাচ্ছে। তখন সেই আবেশ পা থেকে বের হয়ে শেকড় হয়ে মেঝের সাথে তাকে আটকে রেখেছে – দেবারতি চাইলেও একটুও নড়তে পারছে না – সারা শরীর পাথরের মত শক্ত, নিথর, একদম স্থির। কপাল ভিজে গেছে, একটু একটু ঠাণ্ডা লাগছে।
হরিপদ আর কথা না বলে, দু’হাতে দেবারতির চুল পেছন দিকে সরিয়ে দিল যাতে ওর চোখ আর কপাল ঠিকভাবে দেখা যায়। তারপর রতির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল – ওকে আয়নাতে দেখবে বলে।
কোমর থেকে ঝুলে পরেছে শাড়ি একদম মেঝে অবধি মোটামুটি জানু-হাঁটু-পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে পায়ের গড়ন। বুকের শুধু বাঁ দিকটা ঢাকা থাকায়, অনাবৃত ডান দিক আরও সপ্রতিভ হয়ে আছে। দেবারতিকে কাঁচের বাক্সের মডেলের থেকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হল হরিপদর। এই ধরনের সাদা পাথরের মূর্তি হরিপদ অনেক দেখেছে। হরিপদ ভাবতো, সেগুলো দেখতে ভালোই লাগে, তবে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যেই শিল্পী বুকের দিকের কাপড়টা আলগা করে রাখে। আজ সেই রকম এক মূর্তি বানিয়ে ফেলে নিজেকে শিল্পী মনে হতে লাগল। মেয়েদের পিঠও যে এত সুন্দর হয় সেদিকে তার নজর কোনদিন যায়নি। দেবারতির অনাবৃত পিঠে একটা সরু আঁচল প্রায় পা পর্যন্ত নেমে গেছে – দেখে হরিপদ সম্মোহিত হয়ে গেল।
দেবারতি বলল, আমি আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
বলে দেবারতি এক পা হাটতেই কোমর থেকে শাড়িটা খুলে পড়ল। সে চটপট সেটাকে তুলে নিয়ে ঘুমের নাইটি পরে ফেলল। দেবারতি নতুন শাড়িটা একবার শুকে সেটাকে ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখল। হরিপদ তখনো ঘরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন হাটা চলা করছে।
দেবারতি বলল, কি হল? শুতে যাবে না?
– হ্যাঁ, চলো। রাত পোহালেই তো মহালয়া।
ঘরের সব আলো নিভে গেল। অনেকক্ষণ মেঘ-গুমোট থাকার পরে দমকা হাওয়ায় কিছু বোঝার আগেই যেমন সব তোলপাড় হয়ে যায়; বাইরে মেলা কাপড় তুলবে, না জানালা বন্ধ করবে – কিভাবে সামলাবে তা বুঝে ওঠার আগেই সারা শরীর ভিজে চুপচুপে; তখন সেই আবেগে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করা যায় না। ঘরের মধ্যে সেরকম একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দেবারতির খোলা চুল তখন হরিপদর মুখের উপর – কাশফুলের ঝাড় যেন একবার মাটিতে ছুঁয়ে আবার আকাশের দিকে ছিটকে যেতে লাগল; সেই ঝড়ে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে একসময় সব চুপ, একটা ঘুমের আচ্ছন্নে ডুবে গেল দুইজনে।
তারপরে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। রাস্তার শব্দ অনেক কমে গেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। আর ঘরের মধ্যে ঘড়ির টিক-টিক, আর সিলিং ফ্যানের কট-কট শব্দ বিলম্বিত লয়ে এক ঐকতান-বাদ্য বাজিয়ে চলেছে।
হরিপদ ঘুমের মধ্যে দু-একবার কেঁপে উঠল। দেবারতি সেটা টের পেয়ে হরিপদর মুখের কাছে মুখ নিয়ে দেখল হরিপদ গভীর ঘুমে। দেবারতি পাশ ফিরে শুলো – ওর খুব ঘুম পাচ্ছে।
আমি কিছু শুনিনি সাহেব, আমি কিছু শুনিনি সাহেব – হরিপদর ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বল উঠল। দেবারতি হরিপদর দিকে ঘুরতেই হরিপদ অন্য দিকে পাশ ফিরল। বাইরে তখন বেশ মেঘ করেছে – একটু শীত শীত করছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজবে। তখন উঠে রেডিও অন করতে হবে – রাত পোহালেই মহালয়া। দেবারতি হরিপদর গায়ের উপর চাদরটা ভালো করে টেনে দিয়ে নিজেও সেটা টেনে শুয়ে পড়ল।
কতক্ষণ পার হয়ে গেছে তার কোন খায়েল নেই। হঠাৎ শব্দ – টিং-টং, টিং-টং।
দেবারতি তড়াক করে উঠেই ঘড়ির দিকে হাত বাড়াল। নাঃ, এটা তো কলিং বেলের শব্দ! এতো রাতে কে এলো? দেবারতি হরিপদকে ঠেলে তুলল।
আবার, টিং-টং, টিং-টং।
– দ্যাখো, কেউ ডাকছে, বাইরে।
এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। সাহেব এর আগেও লোক পাঠিয়ে মাঝরাতে হরিপদকে ডেকে পাঠিয়েছে। হরিপদ প্রথমেই মোবাইল দেখল। সব ঠিক আছে। তবে?
আবার, টিং-টং, টিং-টং। কতক্ষণ ধরে ডাকছে কে জানে? হরিপদ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?
– হরিপদ, স্যার ডাকছেন। মোবাইলটা সুইচ অফ করে রেখেছিস কেন?
গলাটা ঠিক চিন্তে পারল না। দরজাটা একটু খুলে হরিপদ দেখল – চেনা মুখ। মন্ত্রীকে অন্য সবাই স্যার বলে, তবে এই মন্ত্রী যখন কেবল এক স্থানীয় নেতা মাত্র, হরিপদ সেই সময় থেকে তাঁকে সাহেব বলে ডাকে – এখনও তাই চলছে।
– তাড়াতাড়ি আয়। বাইরে থেকে তাড়া এলো।
হরিপদ হাতের কাছে যা পেল কোনরকমে পরে নিতে নিতে বলল, রতি, আরেকটু পরেই মহালয়া শুরু হবে। তুমি শুনো, আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।
দেবারতি মোবাইল, এটা-সেটা হাতের কাছে এগিয়ে দিল। বলল, দেরি হলে ফোন কোরে দিও; আমি চিন্তায় থাকব।
হরিপদ লোকগুলোর সাথে চলে গেল। দেবারতি দরজা ভালো করে লাগিয়ে, বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর চেষ্টা করল। মাথার মধ্যে হাজার রকম চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগল – বেশিরভাগই দুশ্চিন্তা। দেবারতি উঠে পড়ল। জল খেয়ে, ঘড়ির অ্যালার্মটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। নানান সুখ স্মৃতি আর দুশ্চিন্তার মধ্যে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
দেবারতির যখন ঘুম ভাঙল মহালয়া তখন অনেকটা হয়ে গেছে। চারিদিকে বাজছে একই গান, একই স্তোত্র – এক স্বর্গীয় অনুভূতি। দেবারতির নিজের রেডিওটা চালাল না। এটাই শুনতে ভালো লাগছে – চারিদিক থেকে আসা মহালয়া সুর। হরিপদকে এখন খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে ওর। আধো ঘুম, আধো জাগরণে মনটা বেশ হালকা। বিরক্তিকর হচ্ছে মাঝে মধ্যে পটকা ফাটার শব্দগুলো।
এমন সময় বাইরে একটা হট্টগোল দেবারতির কানে এল – কেউ ওর আর হরিপদর নামে কি সব বলছে। দেবারতির উঠে বসল, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে উঠতে যাবে এমন সময় দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা, আর কলিং বেলের শব্দ। দেবারতির তাড়াতাড়ি দরজা খুলল।
– বৌদি চলুন, হরিপদপদা পরে আছে প্যান্ডেলের পাশে।
– পরে আছে মানে?
কিছু বুঝে, বা না-বুঝেই দেবারতি দৌড়তে লাগল। কয়েকটা বাড়ী পরে পাড়ার মোড়ে পূজার প্যান্ডেল হচ্ছে। কুকুর যেমন রাস্তা পার হতে গিয়ে সামনে আগন্ত বাস দেখে ঝপ করে দাঁড়িয়ে পরে, দেবারতিও তেমনি প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। যা দেখছে ও নিজেই বিশ্বাস করতে পারল না।
হরিপদ মুখ হাঁ-করে চিত হয়ে শুয়ে আছে, আধা খোলা চোখ, কপালের মাঝখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পরে সেখানকার মাটি ভিজে গেছে। ওপাশে অনেক লোকের ভিড়, একটা পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে।
দেবারতি এক-পা, এক-পা করে এগিয়ে কাছে গেল – নিজের দৃষ্টিকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না তখনও। দেবারতি যেই ছুঁয়ে দেখতে যাবে, ওদিক থেকে পুলিশটা বলে উঠল, এটা মার্ডার কেস, কেউ হাত দেবেন না, সবাই সরে যান।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল, ও হরিপদর বউ।
– সে যে যাই হোক, পোস্ট মরটেম না হওয়া পর্যন্ত কেউ ডেড বডি ছুতে পারবে না।
– ডেড বডি!
দেবারতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানেই ধপ করে পড়ে গেল।
রেডিওতে তখন বাজছে,
যা দেবী সর্বভুতেষু বুদ্ধি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমো নমাহ।
যা দেবী সর্বভুতেষু নিদ্রা রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমো নমাহ।
… …
যা দেবী সর্বভুতেষু জাতি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমো নমাহ।
যা দেবী সর্বভুতেষু লজ্জা রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমো নমাহ।
যা দেবী সর্বভুতেষু শান্তি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসই নমস্তসই নমস্তসই নমো নমাহ।
… …
যখন দেবারতির জ্ঞান ফিরল, ওর চারপাশে অনেক পুলিশ, বেশ কিছু লোক ফটো তুলছে, কেউ কেউ ওর ফটোও তুলল। দেবারতি উঠে বসতে চেষ্টা করল – ওর মনে হল যেন অনেকদিন ধরে ও ঘুমচ্ছিল। ওর পাশে হরিপদ স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। দেবারতি জিজ্ঞেস করল, ওর কি হয়েছে?
তখন কোথা থেকে সাহেব এসে দেবারতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি ওর খুনিকে খুঁজে বের করে যথার্থ শাস্তি দেবই।
– খুনি?
তারপর দেবারতির যখন জ্ঞান ফিরল, ও তখন ওর বিছানায় শোয়া। আশেপাশে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলা, ঘর ভর্তি লোক।
বিকেল বেলায় সাহেবের খাস লোক এসে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে আবার আশ্বস্ত করে গেল যে মন্ত্রী নিজে এই বিষয়টা দেখছেন এবং খুব শীঘ্রই দোষী শাস্তি পাবে।
পরেরদিন কাগজে একটা খুনের বিষয়ে অনেক কিছু বেরাল। তার মূল কথা এইরকম – গতকাল আনুমানিক রাত তিনটে নাগাদ পশুপালন প্রতিমন্ত্রী তার নিজগৃহে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এই নিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকেই সব জানাবে। পুলিশ এখনই কোন মন্তব্য করতে রাজী নয়, তবে সমস্ত সম্ভাবনাকেই তাঁরা সামনে রেখেছেন, তার মধ্যে বিরোধী দল, বিদেশী চক্রান্ত, উগ্রপন্থীর দৃষ্টান্তমুলক আক্রমণ বিশেষ ভাবে খতিয়ে দেখছেন। পুলিশ আপাতত হরিপদ মৃত্যুর সাথে প্রতিমন্ত্রী হত্যার কোন যোগ আছে বলে মনে করেন না। হরিপদ দশ বছর আগে এই প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ড্রাইভার ছিল। গত দশ বছর ধরে সে অন্য এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ড্রাইভার।
— শেষ —