Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। আট ।।

স্কুল কলেজে শীতের ছুটি শুরু হয়েছে। শীত তেমন পরে নি এখনো। সকাল থেকে রাস্তার মাঝখানে ক্রিকেট খেলা চলছে। পূজোর পরে এই সময়টাতে বেশ একটা খুশির আমেজ দেখা যায়। পাচুর সকাল কেটে যায় কিছুটা পড়াশুনোয়, আর কিছুটা অন্যান্য কাজে। দুপুরে বন্ধুরা প্রায় সবাই ব্যস্ত – কেউ কাজে, কেউ কাজের খোঁজে, আর অনেকে থাকে বাইরে। এই দুপুরটাই সবচেয়ে বাজে সময়। এখনো মাস খানেক লাগবে রেজাল্ট বের হতে। যেখানে যা অ্যাপ্লাই করার করা সব হয়ে গেছে – এখন শুধু অপেক্ষা।

পাচু অনেক ভেবে ঠিক করেছে রুমির সাথে কম দেখাসাক্ষাৎ করবে। রুমির ভাবগতিক কিছু বোঝা যায় না। মাথায় ছিট আছে হয়ত। কিন্তু ছিটেল মেয়ে সম্পর্কে পাচুর যা ধারনা তার সাথে রুমির খুব একটা মিল নেই। তা হলে? এই ‘তা হলে’-র পরে যে চিন্তাগুলো মাথায় আসে, সেই সব এড়ানোর জন্য পাচু ঠিক করেছে রুমিকে একটু এড়িয়ে চলবে।

ক্লান্তিকর সারা দুপুরটা ঘরে বসে কাটিয়ে পাচু সেদিন বিকেল হতে না-হতেই চলে ঠেকের বারান্দায়। কেউ নেই সেখানে। থাকার কথাও না। এক কাপ চা নিয়ে খবরের কাগজটা পড়া শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে বিষ্ণু এসে চায়ের কাপটা নিয়ে গেল। পাচু বিষ্ণুকে কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখ তুলে দেখল, একটু দূরে রুমি হরির সাথে কথা বলছে। দূরত্বটা এমন যে, সব পরিষ্কার দেখা যায় কিন্তু পরিষ্কারভাবে কিছু শোনা যায় না। পাচু খরবের কাগজটা নাক অবধি তুলে ধরে পুরানো দিনের সাদা-কালো ছবির গোয়েন্দার মত ওদের দেখতে থাকল। হরি মাঝে মাঝেই হাত নেড়ে কিসব বলছে। কিছু বোঝাচ্ছে। রুমিও বেশ হাসি হাসি মুখে শুনে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রুমিও কিছু একটা বলছে; মনে হয়, কিছু জিজ্ঞেস করছে। একবার ভাবল, বিষ্ণুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে – হরি এখানে এসেছিল কিনা? তারপরেই ভাবল, বিষ্ণু বলবে, ওই তো হরিদা ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে নিজেকে বোঝাল, শান্ত হও পঞ্চম, ধৈর্য ধর। একি পাগলামি? পাড়ার একজন মহিলা কি হরির সাথে কথা বলতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে, সারাদিন, সারারাত ধরে কথা বলতে পারে। কিন্তু, রুমি তো নতুন এখানে, ও হরিকে চেনে না। এটা নান্টু হলে ও এতো ভাবত না। হয়ত এতক্ষণে সেখানে চলে যেত। মনে হল, রুমি আসলে খুব সহজ সরল। তারপরে নিজেরই হাসি পেল। ভাবল, ওর কি দরকার এসবের মধ্যে জড়িয়ে। এইসব মেয়ে ঘটিত ব্যাপারের শেষটা কখনো ভালো হয় না। এইটে মনে হতেই, হরির অনেক কীর্তি-কলাপ মনে পরে গেল।

একবার ভাবল, বিষ্ণুকে জোরে ডেকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয় যাতে ওরা শুনতে পায়, যে ও এইখানে আছে। তারপর ভাবল, দুই কাপের অর্ডার দেয়। বলে, এক কাপ হরিকে দিয়ে আয়। তখনি মনে হল, তাহলে তো রুমিও জেনে যাবে। অথচ ওর জন্যে পাঠালাম না। দুইজনের জন্যে পাঠালে হরি জেনে যাবে যে ওর সাথে রুমির আলাপ আছে। চিন্তাটা পুরো জমে উঠতে না-উঠতেই বিষ্ণু এসে জিজ্ঞেস করল, ‘পাচুদা, ওই পেপারগুলো নেব? ওদিকে চাইছে।’ পাচু দুটো পাতা রেখে বাকিগুলো দিয়ে দিল।

একবার ভাবল, এরমধ্যে হরিকে যদি বলত রুমির সাথে ওর আলাপ হয়েছে, তাহলে নির্দ্বিধায় গিয়ে বলতে পারত, কি রে কি এত বোঝাচ্ছিস? কিছুক্ষণ পরে পাচু দেখল হরি সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে আর রুমি হাত তুলে বাই বলে একটা রিক্সায় উঠে চলে গেল। বিরক্তি লাগল রুমির এই ঢলানি ভাব দেখে। হরি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে; না, ভাবছে না; কিছুক্ষণ আগের সময়টা অনুভব করে উপভোগ করছে। পাচু আর পারল না। প্রয়োজনের তুলনায় একটু জোরেই ডাক দিল, ‘ওই হরি, কি করছিস? আয়।’ চায়ের দোকানের দু-একজন ঘুরে তাকাতে পাচু বুঝল, ওর ডাকাটা আসলে একটা চিৎকার হয়ে গেছে। হরি আসতে আসতে বলল, ‘বিষ্ণু, চা দিয়ে যাস এদিকে।’ পাচুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই খাবি তো?’ পাচুর চা খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবে ও যে এখানে অনেকক্ষণ ধরে এখানে বসে ওদের দেখেছে সেইটে ঢাকার জন্যে বলল, ‘হ্যাঁ, খাব।’ হরি বলল, ‘বিষ্ণু দুটো চা দিয়ে যা।’

চা খেতে খেতে হরি বলল, ‘ওই মহিলা বেশ কথা বলেন।’ পাচুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ‘কোন মহিলা?’ কিছুই না-জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল। হরি বলল, ‘এই যে কয়েক মাস হল নতুন এসেছে পাড়ায়?’ রাগে পাচুর মুখ থেকে অন্য কিছু বেরিয়ে আসছিল; নিজেকে সামলে পাচু বলল, ‘তোর সব মহিলাকেই ভালোলাগে, যতদিন না ঝামেলায় পরছিস। এ আর নতুন কি?’ হরি নিজের ভঙ্গিতে বলল, ‘কি আর করব? আমার হৃদয়টাই যে ওইরকম! একজনে মন ভরে না যে।’ পাচু উঠে গেল। ‘আমার কাজ আছে, সন্ধের সময় দেখা হবে।’

পরের দিন পাচু দুপুর বেলায় একটু তাড়াতাড়ি রুমির বাড়ি গেল। দরজা খুলেই পাচু জিজ্ঞেস করল, ‘অসময়ে চলে এলাম। তুমি ব্যস্ত না তো?’

– ‘ব্যস্ত না, তবে একটু বাজারে যাব ভাবছিলাম। তুমি এসেছ এতদিন পরে, এখন আমার না গেলেও চলবে।’

তুমি কি গতকাল বাজারে গিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পাচু কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি আজকাল রোজ বাজার যাও?’

– ‘রোজ যাই না। তবে যাই – কখনো কাজে, কখনো বা অকাজে। কেন বলতো?’

পাচু দেখল এই সুযোগ। জিজ্ঞেস করল, ‘কাল গিয়েছিলে?’

– ‘হ্যাঁ, কয়েকটা জিনিষ বানাতে দিতে গিয়েছিলাম। আজ নিতে যাওয়ার কথা। পরে যাব।’

– ‘দেখলাম, হরির সাথে খুব গল্প করছিলে।’ কথাগুলো বলেই পাচু বুঝল মনের মধ্যেকার অনেকগুলো জমে থাকা বুদবুদ একবারে ফেটে বের হল যেন।

– ‘কেন? তাতে হিংসে হচ্ছে নাকি তোমার?’

– ‘হিংসে হবে কেন? তবে, হরি ছেলেটা ভালো নয়। পাড়ায় একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। ওর থেকে একটু সাবধানে থেকো।’

– ‘ও, তাই বলতে আজ ছুটে এসেছো।’

– ‘বলতে না। ভাবলাম, জানিয়ে দেওয়া ভালো, তাই।’

– ‘কেন? তুমি রক্ষে করতে পারবে না?’

‘আমাদের পাড়ায় প্রবাদ আছে, ধরলে হরি, বাঁচায় কে?’ বলেই পাচু নিজের অজান্তে জিব কাটল। রুমি সেটা লক্ষ্য করে বলল, ‘আর তোমরা শুধু তার গল্প শুনে মজা পাও।’

‘মজা পাই না বলেই তো তোমাকে সাবধান করে দিলাম।’ একটু থেমে পাচু আরও বলল, ‘হরি ছোট থেকেই এইরকম। অসভ্যতা, নিষ্ঠুরতার মধ্যে ও এক আনন্দ পায়।’ এই বলে ওর ছোটবেলার পাখির বাচ্চাগুলো নিয়ে খেলা করে মেরে ফেলার ঘটনাটা বলল। শুনে রুমি আর রসিকতা করতে পারল না। পাচুর কাছে এসে বলল, ‘I’m sorry. আমি মনে রাখব তোমার কথাগুলো। Thank you for warning me.’ পাচু যেন একটা শান্তি খুঁজে পেল। বলল, ‘তুমি যে কি বোঝ আর কি বোঝ না – সেটা আঁচ করা আমার ক্ষমতার বাইরে।’ ‘সে বুঝতে গেলে অনেক গভীরে ডুব দিতে হবে। সে সাহস বোধহয় তোমার নেই। হয়ত হরির আছে। তাই হয়ত, ও-‘ এই বলে রুমি ইচ্ছে করে পাচুর মুখের সামনে কোমরটা একটু দুলিয়ে ভিতরে চলে গেল।

একটা আবছায়া দৃশ্য পাচুর চোখের উপর ভেসে গেল। হরিও কি এখানে আসে? রুমি কি হরির সাথেও একই রকম আচরণ করে। সম্ভাব্য সামঞ্জস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাচু ঠিক কখন যে রুমির ভিতরের ঘর পর্যন্ত চলে গেছে পাচু নিজেও তা খেয়াল করে নি। সম্বিত ফিরে পেল রুমির কথায়, ‘তুমি এখানে কি করছ?’ পাচু বাক্যহীন, শূন্য-চিন্তা দৃষ্টিতে রুমির দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে হল – রমণীর অনির্বচনীয় রূপ – এই নিয়েই কেউ ছবি আঁকে, কেউ ভাস্কর্য মূর্তি বানায়? পাচু চোখ বুজে ফেলল – নিজেকে লুকানোর এর থেকে আর কোন সহজ উপায় পেল না। চোখ বন্ধ হলে মানুষের কান সাধারণ অবস্থার তুলনায় বেশী সজাগ হয়ে ওঠে। পারিপার্শ্বিক শব্দগুলো তখন পাচুকে বুঝিয়ে দিল সেখানে কি হয়ে চলেছে। সব শব্দ শেষ হল। পাচু চোখ খুলে এক পা এক পা করে হেঁটে বাইরের ঘরে এল। রুমি বাজারে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে সোফায় একটা ম্যাগাজিনের পাতা খুলে সেটা পড়ার ভান করে বসে আছে। পাচু কিছু না-বলে একই গতিতে সেখান থেকে বের হয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10