Home » বড় গল্প » অনুষঙ্গ

অনুষঙ্গ

।। সাত ।।

রুমিদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে পাচু একটু দাঁড়াল। তারপরে জোরে একটা শ্বাস নিল। এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ওর ভালোমানুষির পর্ব শেষ হল বলে। একবার মনে হল, ওর এইসব নিয়ে অত ভাববার কি আছে? হয় ভদ্রলোক জেনে বুঝে চেপে গেছেন, নতুবা রুমি বলে নি। কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে দোষী মনে চিন্তাগুলো বারবার অকুস্থলে এসে আটকে যায়।

দিন কয়েক নানান কাজে পার হল। বিষয়ের তীব্রতাটা অনেক হালকা হয়ে গেলেও রুমির বাড়িটা পাচুকে মাঝে মাঝেই টানে; তবে সৈকত-বাবু বাড়িতে আছেন কি না – সেটা না-জেনে সেখানে আর যাচ্ছে না।

সেদিন সকাল বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। দুম করে শীতকাল চলে এল মনে হচ্ছে। রাস্তায় লোকজন কম। পাচু রুমির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানলা থেকে ডাক এল, ‘কি ব্যাপার? একটুও না-তাকিয়ে একেবারে সোজাই চলে যাচ্ছ।’ পাচু ঘুরে তাকাতেই রুমি বাইরে বেরিয়ে এল। পাচুকে ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির ভিতরে। ‘সেদিন দুম করে চলে গেলে। তারপর তো আর তোমার দেখাই পেলাম না। রাগ করেছো না কি?’

পাচুর নিঃস্পৃহ সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘না, রাগ করবো কেন?’

– ‘সেদিন সারাক্ষণ মুখ শুকনো করে বসেছিলে। তারপরে হঠাৎ করে চলে গেলে।’

পাচু জানে রুমি সব লক্ষ্য করেছে। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি তোমার বরকে আমার সব কথা বলে দিয়েছ?’

এই কথার উত্তর না-দিয়ে রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেম করেছ কখনো?’

– ‘কলেজে একজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তবে সেটাকে ঠিক প্রেম-করা বলা যায় না।’

– ‘তো, সে পর্ব সাঙ্গ হল কি করে?’

– ‘সে অনেক কথা। তাছাড়া ওর এখন বিয়ে হয়ে গেছে।’

– ‘খোঁজ নিয়েছো কখনো তার বিয়ের পরে?’

– ‘না।’

– ‘হয়ত সে এখনো তোমাকে ভালোবাসে।’

‘আমার তো মনে হয় না। অন্তত এখন আর না।’ অভিমানী চোখে পাচু রুমির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি যা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দাও।’

– ‘মেয়েরা যে রহস্যময়ী তা কি শুধু তাদের শরীরেই? তোমরা ছেলেরা তাদের রূপ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকলে যে তাদের মনটার দিকে একটু সময় দিতে পারলে না। দায় সারা ভাবে চালিয়ে দিলে মেয়েদের বোঝা যায় না। আরও যেন কি সব বল তোমরা।’

পাচু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বুঝলাম। থ্যাঙ্ক ইউ। না-বলার জন্যে।’

‘কে বলল? বলিনি? সব বলেছি। এমন কি ঝালমুড়ি খাওয়ার ঘটনাটাও বলেছি।’ পাচুকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখে রুমি আবার বলল, ‘তবে তাঁর যতটুকু জানার প্রয়োজন ততটুকুই বলেছি। তোমার এ নিয়ে অস্বস্তি পাওয়ার কোন কারণ নেই। চা করি, কি বলো?’

খুশিতে আবেগে পাচু রুমির হাত দুটো ধরে বলল, ‘না চা থাক। একটু বসো।’ রুমি কোন বাধা দিল না; যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকল। রুমির হাত দুটো ধরে অপলক দৃষ্টিতে রুমির দিকে তাকিয়ে পাচুর মনে হল – এ সত্যি এক রহস্যময়ী মহিলা – কিন্তু বুঝে পেল না রহস্যটা কি তার দৃষ্টিতে, শরীরে, না-কি তার মনে। নিশব্দতা পাচুর সময়কে অনেক সংক্ষিপ্ত করে দিল যখন রুমি বলল, ‘এরার ছাড়ো আমাকে।’ পাচু চাইছিল এইভাবে আরও অনেকক্ষণ বসে থাকতে। হাত ছাড়িয়ে রুমি আঁচল দিয়ে নিজের মুখটা মুছল। তারপরে একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কিছু না-বলেই সেখান থেকে উঠে ভিতরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে রুমি ফেরত এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি সেই মেয়েটাকে এখনো ভালোবাসো? বা -‘

পাচু বুঝল, এই ‘বা’-টাই হল আসল প্রশ্ন। বলল, ‘না। তোমার ওই বা-এর আগে এবং পরে – দুটোই না।’

তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘সৈকত বাবু সেইদিন আমাকে অযাচিতের মত দেখে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?’

‘না। আমি তো ওঁকে তোমার কথা আগেই বলেছি। সেদিন তোমাকে ধন্যবাদ না-জানিয়ে চলে আসার জন্যে ও আমাকে খুব বকেছিল।’ একটু ফিক করে হেসে আরও বলল, ‘পরে যেদিন তোমাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলাম। সেইদিন ওঁকে সেটাও বলেছি।’

পাচুর মুখে একটা হাসির আভা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল যখন বুঝল, এই সবই রুমির কেরামতি। বলল, ‘সেইদিন এসে তোমাদের বিরক্ত করলাম। সেইটে নিশ্চয় উনি ভালো মনে নেন নি। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই চা খেয়েই পালিয়েছিলাম সেইদিন।’

– ‘সে তোমার মুখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম। তবে এই কয়দিন আসো নি কেন?’

– ‘বুঝতে পারছিলাম না, যদি উনি বাড়িতে থাকেন। তোমাদের বিরক্ত করতে চাইছিলাম না।’

রুমি চোখ বড় বড় করে পাচুর দিকে তাকিয়ে, ঠোটে আর গালে একটা হাসির টান বজায় রেখে বলল, ‘তাই বুঝি?’ তারপরে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোমাকে একটা গোপন খবর দেই। ও বাড়িতে থাকলে এই জানালাটা খোলা থাকে না। ও পছন্দ করে না।’

পাচু দেখল এই জানালা দিয়ে বাইরের অনেকটা দেখা যায়, হয়ত বাইরে থেকেও ঘরের ভিতরটা ততটাই দেখা যায়। ভাবল, কে আর চায় নিজেদের একান্ত সময়ে অন্য ব্যক্তির উৎসুক দৃষ্টিপাত। পাচু এই সোজা কথাটা সোজাসুজি বুঝল। তবে ধন্ধে পরল এইটে ভেবে যে রুমি কোন ইঙ্গিত চালান করে দিল কি না। সেইটে ঠিক করে বোঝার চেষ্টায় রুমির দিকে তাকাতেই পাচুর মনে হল, রুমি যেন ওর চাউনির জন্যে অপেক্ষা করেছিল। চোখাচোখি হাওয়া মাত্র রুমির চোখের মধ্যে থেকে একটা দুলুনি উদ্ভূত হয়ে ওর সারা শরীর দিয়ে বয়ে গেল। সে দেহকম্প পাচুর মধ্যেও কিছুটা বয়ে গেল। সেটা সামলে নিয়ে পাচুর মনে হল রুমি এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ – সঠিক জায়গায় পরলে মুহূর্তে আগ্নিকান্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। তার যে সামান্য কিছু নমুনা সে পায় নি তা নয়। বলতে চাইল, সৈকত বাবু থাকলে কি তুমি চাও না যে আমি আসি? কিন্তু মুখে বলল, ‘ভালোই করলে এইটে জানিয়ে রেখে।’

হঠাৎ রুমি ‘উঁউঁ’ করে গান শুরু করল। পরিচিত গান – পাচুর বুঝতে দেরি হল না গানের কথাগুলি – ‘গোপন কথাটি রবে না গোপন।’ পাচুর মনে তখন নানান প্রশ্ন – ভালো, মন্দ, সমাজ গ্রাহ্য এবং সমাজ গর্হিত সবই এসে হাজির হচ্ছে। রুমি কোন গানের এক কলি বা দুই কলির পরেই অন্য গানের গুনগুনানি শুরু করছে। পাচু মন দিয়ে শুনছে না, চেনার চেষ্টাও করছে না। ওর মনে একটা সম্ভাবনা একবার উঁকি মারতে না-মারতেই অন্যটা এসে হাজির হচ্ছে। রুমি গান থামিয়ে ভ্রু-দুটো কপালে টেনে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কি হল?

– ‘আচ্ছা, তুমি যে তোমার স্বামীকে পুরোটা বলো নি। সেকি শুধুই বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখার জন্যে? না কি?’

– ‘না কি-তে থামলে কেন? প্রশ্নটা তো মাল্টিপল চয়েজের মত করে বানাচ্ছিলে। যেদিন পুরো প্রশ্নটা করতে পারবে, সেদিন সঠিক উত্তরটাও পাবে। হয়ত, আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।’

যাও-বা এই প্রশ্নের কিনারা করার একটা রাস্তা দেখতে পেয়েছিল, রুমি পুরোটা গোল পাকিয়ে দিল। পাচু অনেকটা অভিযোগের সুরে বলল, ‘এই জন্যেই মেয়েদের রহস্যময়ী বলে সবাই।’

‘সেই তো, কি আর করা যাবে বলো? আমরা যে তোমাদের ছাড়া থাকতে পারি না – তোমাদের উপর আমাদের বড় টান। সবাই মিলে তোমরা যখন ঠিক করেছ, না-মেনেও তো কোন লাভ নেই আমাদের। অশান্তি বাড়ে তাতে।’ এই বলে একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘তুমি তো প্রশ্নটা আসলে আমাকে করো নি। করেছ নিজেকে। আমি একটা উপলক্ষ মাত্র।’

পাচু বলল, ‘এমন অনেক কথা হয় যা বলা যায় না, কিন্তু চিঠিতে লেখা যায় সহজেই। সেইরকম অনেক কথা আছে যা ভাবলেও মুখে বলা যায় না।’

– ‘তাহলে তুমি কি করে ভাবলে, সে কথা আমি তোমাকে বলতে পারব?’

পাচু নিজের জালে নিজে জড়িয়ে হাতদুটো জোড় করে কপালে দুইবার ঠুকল। রুমি উঠে এসে নিজের কপাল দিয়ে পাচুর কপালে হালকা একটা ঢিস দিয়ে বলল, ‘তোমার ভাবের প্রশ্নের উত্তর আমার ভাবনা দিয়ে দিলাম। এইবার আর মুখ ফুঠে জিজ্ঞেস করতে হবে না। প্রয়োজনে ভেবে দেখো উত্তর পেয়ে যাবে।’ এই বলে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে নিজের জায়গায় বসে পরল। পাচু আরও গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘কি খুঁজে পেলে?’ পাচু ভাবল, যাতে না-পাই তার ব্যবস্থা খুব ভালো করেই করেছো; মুখে বলল, ‘না সেইটে ভাবছি না।’ তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘উত্তরটা তো তুমি আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। যখন দরকার হবে বের করে নেব।’

এমন সময় বাড়ির পিছনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। রুমি বলল, ‘এবার এসো তুমি। বাড়ির কাজের লোক এসেছে। ঘরদোর ঝাঁট দেবে। এখানে বসে থাকলে ফাঁকি দিয়ে পালাবে।’ পাচু বলল, ‘হ্যাঁ, চলি আজ।’ পাচু বের হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10