।। পাঁচ ।।
পাচু রুমির বাড়ি থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে থাকল। এক মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে মনে হল, পুজোমন্ডপে ধুপের ধোঁয়ায় কিছুক্ষণ থাকার পরে চোখ জ্বালা করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়; মনে হয়, কখন একটু বের হয়ে ফাঁকা জায়গায় দাড়াই, অথচ কিসের টানে সেখানে থাকতে বেশ ভালোলাগে, রুমির সঙ্গটা অনেকটা সেই রকম – কয়েক মিনিটের মধ্যে কান গরম হয়ে ওঠে, মাথা ঘুরতে থাকে, অথচ সেইখান থেকে কেন জানি বের হয়ে আসা যায় না। একবার মনে হল, আবার ফিরে যায়। যা যা ভেবে সেখানে গিয়েছিল সেগুলো কিছুই ঠিক করে বলা হল না। পুরোটা না হলেও সে যে অনেকটাই নির্দোষ – সেটা আজ প্রমাণ করে ছাড়বে। রুমির ইনফরমার মেয়েটা ডেকে প্রমাণ করে দেবে যে সে মেয়েদের টিজ করে না, এমনকি কাউকেই টিজ করে নি। সেটা নেহাতই একটা মজা করার জন্যে বলেছিল। তারপরেই মনে পরল, ঝালমুড়ি স্ট্যান্ডের ঘটনাটা। মনে হল রুমি যেন ওর মাথার ভিতরে থেকে সব কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে। পাচু বা-হাত দিয়ে নিজের গালটা ছুঁয়ে দেখল – নরম ঠোটের স্পর্শটা এখনো যেন লেগে আছে। ভীষণ রাগ হল। জামার আস্তিন দিয়ে গালটা ঘসে নিল।
একবার ভাবল, নান্টু-হরিকে বলবে। কি বলবে, কতটা বলবে – সেইটে ভাবতে ভাবতে আড্ডা দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে গেল। একবার ভাবল, নান্টুকে সব বলে ওর পরামর্শ নেবে। তারপরেই মনে পরল ছোটবেলার একটা ঘটনা। পাচু বাড়ির বারান্দার থামের কার্নিশে একটা পাখির বাসা আবিস্কার করে করেছিল। যখন বাড়িতে কেউ থাকত না, বা দুপুরে সবাই ঘুমাতো, পাচু টেবিলের উপর চেয়ার তুলে তার উপর উঠে সেটা দেখত। একদিন দেখল পাখিটা কয়েকটা ডিম পেড়েছে। কয়েক সপ্তাহ পরে সেই ডিমগুলো থেকে কয়েকটা বাচ্চা হল। পাচু চুপ করে চালের টিন থেকে চাল নিয়ে সেখানে রেখে আসত। তারপর একদিন নান্টু আর হরিকে সেটা দেখাল। হরি অমনি পাখির বাচ্চাগুলো নামিয়ে নিয়ে খেলা করতে করতে একটাকে সেখানেই মেরে ফেলল। পাচু বাকি বাচ্চা দুটোকে বাসায় তুলে রেখেছিল। কিন্তু পরের দিন দেখল সেইদুটো মরে পরে আছে। তার কয়েকদিন পরে মা-পাখিটাও সেখান থেকে চলে গেল। বহুদিন পর্যন্ত পাচু মাঝে মাঝে উঠে দেখত সে ফিরে এসেছে কিনা। তারপর একদিন ঝড়ে সেই বাসাটা সেখান থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেল। পাচু অনেকদিন হরির সাথে কথা বলে নি। এইটে মনে পড়াতেই পাচু ঠিক করল, কাউকে কিছু বলবে না।
প্রতিদিন বিকেলে পাচু নিজেকে জোর করে আটকে রাখে – বই পড়ে, গান শোনে, কিছু করতে ভালো না লাগলে ছাদের উপর একাই বসে থাকে। কয়েকটা দিন এইভাবে কাটল। তারপরে একদিন বিকেলবেলায় দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি কিনে রুমির বাড়ি গেল।
ঘরে ঢুকে পাচু বলল, ‘রোজ তো তুমি আমাকে খাওয়াও। আজ তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।’ এই বলে পাচু প্যাকেট দুটো টেবেলের উপরে রাখল।
রুমি একগাল হাসি দিয়ে একটু লাফিয়ে প্যাকেটগুলোর দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটাতে বেশী ঝাল?’
– ‘কেন?’
– ‘তুমি তো আমার থেকে বেশী ঝাল খাও। তাই জিজ্ঞেস করছি কোনটা আমার জন্যে এনেছ?’
পাচু একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘দুটোই এক। যেটা ইচ্ছে নাও।’ মনে পড়ল ঝালমুড়ি স্টান্ডের ঘটনাটা। ও তো সে’দিন সেই কথাই বলেছিল। ভাবল, রুমির এত কিছু মনে আছে কি করে? জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি এখনো আমার উপরে রেগে আছো?’
– ‘তোমার উপরে আমি কোনদিনই রাগিনি। হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?’
– ‘সেই দিন ঝালমুড়ি ওয়ালাকে বলেছিলাম আমারটা বেশী করে ঝাল দিয়ে বানাতে। সেইটের জের টেনে আজ বললে তা বেশ বুঝেছি। তুমি এখনো ভুলতে পারো নি।’
– ‘ভুলি নি – সেইটে সত্যি। তবে তোমার উপরে রেগে নেই। রাগ করলে কি তোমার সাথে একসাথে বসে ঝালমুড়ি খাই?’
শুনে পাচুর আটকে থাকা শ্বাসনালীটা যেন খুলে গেল। বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে রুমির একটা হাত টেনে ধরে বলল, ‘তোমাকে একটা সত্যি কথা বলছি। ওইদিনের ঝালমুড়ি স্ট্যান্ডের কথাগুলোর জন্যে আমি নিজে খুব অপরাধবোধে ভুগছি। তুমি প্লিজ ভুলে যাও সেইগুলো। তবে, আমি স্কুলের মেয়েদের টিজ করি নি আর রিক্সাওয়ালাকে সেইখান থেকে ভাগানোর জন্যে আমি ওইটা বলেছিলাম। তোমাকে অপমান করার জন্যে বলি নি।’
‘জানি। বোসো একটু। তোমার জন্যে চা করে আনি।’ এই বলে রুমি সোফা থেকে উঠে আচলটা কোমরে গুঁজে ভিতরে চলে গেল।
অনেকদিন জ্বরে ভোগার পড়ে যেদিন সকালবেলায় ঘুম ভাঙ্গার পরে বোঝা যায় জ্বর সেরে গেছে – শরীর দুর্বল বোধ হয়, ক্লান্তি থাকে, কিন্তু অস্বস্তি এবং উদ্বেগ থাকে না – মনটা বেশ ঝরঝরে লাগে – পাচুর এখন সেইরকম অনুভুতি হচ্ছে। পাচু নিজের আঁটসাঁট ভঙ্গি ছেড়ে, ঝালমুড়ির প্যাকেট থেকে একটা বাদাম তুলে মুখের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে পা-দুটো সামনে লম্বা করে টেনে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। মনে হল, এই কয়দিন আটকে থাকা সমস্ত ধমনিতে এতক্ষণে রক্ত চলাচল শুরু হল।