।। তিন ।।
একদিন রুমির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাচু শুনতে পেল লতা মঙ্গেশকরের গান ভেসে আসছে সেই বাড়ি থেকে। পাচুর মনে হল, রুমির গলার আওয়াজটা সত্যি একদম লতা মঙ্গেশকরের মতই। পাচু সোজা তাকিয়ে রুমির বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, এমন সময় শুনতে পেল, ‘এই পঞ্চম, কোথায় যাচ্ছ?’
এই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এইরকম একটা ডাক শোনার জন্যে যে মন এতদিন আকুল হয়েছিল, সেই ডাক শুনে পাচু চমকে উঠল। স্কুল-কলেজের টিচাররা ছাড়া ‘পঞ্চম’ বলে কেউ ডাকে নি। এমনকি ক্লাসের মেয়ে বন্ধুরাও ডাকত না। পাচু দেখল – জানালায় মুখ, হাতে ইশারা। রুমির ইশারায় পাচু রুমির বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। রুমি দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘এসো ভিতরে। আমার গান বুঝি তোমার ভালো লাগল না?’ ক্যাসেট প্লেয়ারটা অফ করে দিয়ে বলল, ‘আসবে বললে। কই? একবারও এলে না তো এই কয়দিনে।’
পাচু এই প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তা নয়। বরং এইরকম যে একটা কিছু হতে পারে সেই ভেবে পাচু মনে মনে অনেক কিছু কল্পনা করে তার নানান উত্তরও প্রস্তুত করে রেখেছিল। কিন্তু সেইগুলোর একটাও তখন মনে পরল না। পাচু বলল, ‘না মানে, আমি কয়েকদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম।’
শরীরে একটা হালকা দুলুনি টেনে রুমি বলল, ‘কচিকাঁচা মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলে বুঝি? নাবালিকাদের পিছনে লাগার ফল খুব খারাপ হতে পারে, সে জানো তো। ওদিকে যাওয়ার আগে ভেবে চিন্তে যেও।’
পাচু কিছুটা বিরক্তি আর অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কিছু বুঝলাম না। কি বলতে চাইছ?’
রুমি অনেকটা আদেশের মত করে বলল, ‘বসো তো আগে শান্ত হয়ে।’
পাচু ধপ সোফার একটা কোনে বসে পরল। ‘তোমার মত আমারও দুটো চোখ আর দুটো কান আছে, সেইটে ভুলে যেও না। ছাড়ো ওসব কথা।’ রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘বল, কি খাবে?’
– ‘কিছু না। বলো কি জন্যে ডাকলে?’
– ‘অত তাড়া কিসের? কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। তা নাহলে, নান্টু-হরি গেল কিছুক্ষণ আগে এখান দিয়ে, তাদের না ডেকে তোমাকে ডাকলাম কেন? আমার সাথে না কথা বলতে চাইলে চলে যেতে পারো, আমি আটকাবো না।’ একটু থেমে রুমি জিজ্ঞেস করল, ‘চা করি, কি বল?’
পাচুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই রুমি ভিতরে ঘরের দিকে যেতে লাগল। বলল, ‘ভয় না পেলে তুমি আমার পিছন পিছন আসতে পার। এই বাড়িতে এখন তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। বাইরের দরজা বন্ধ। ওখানে বসাও যা এদিকে আমার সাথে আসাও তাই।’
অকাট্য যুক্তি। রান্নাঘরে যেতে পাচুর খুব একটা ভালো না লাগলেও পাচু রুমির পেছন পেছন রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল। রুমি চা বানাতে লাগল। প্রথম দিনের সেই সুগন্ধটা আবার পাচুর নাকে এলো। ছাড়া চুলে পিঠ ঢাকা। রুমির পাশে এসে পাচু জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে ডাকলে কেন?’ রুমি বলল, ‘একসাথে চা খাব, আর গল্প করব বলে। কেন তোমার কি আমার সাথে গল্প করতে ভয় করছে?’
চা বানিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে রুমি বসার ঘরে ফেরত এল। পাচুকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে অন্য কাপটা নিয়ে ওর পাশের চেয়ারে এসে বসল। চা খেতে লাগল চুপচাপ। গরম চা ফু-দিয়ে একটু ঠাণ্ডা করে খেতে ব্যস্ত। কয়েক চুমুক চা খাওয়ার পরে রুমি শাড়িটা টেনে পা ঢাকতে গিয়ে পাচুর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল একবার। পাচু চোখ সরিয়ে চায়ে মন দিল। পাচু ভাবল, রুমি হয়ত ইচ্ছে করে পায়ের অতটা বের করে রেখেছিল। আবার ভাবল, হয়ত না। যাই হোক ওর নজর ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়াই উচিৎ ছিল। পাচু যখন এইসব ভাবছে, ‘রুমি বলল, কি ভাবছ? আমার পায়ের নখের নেল-পালিশটা উঠে কি রকম বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। আজ বিকেলেই যাব পার্লারে। তুমি দ্যাখো নি তো কিছু?’
এই কথায় কিছুটা স্বস্তি পেয়ে রসিকতাটা বজায় রেখে পাচু বলল, ‘যতটুকু দেখালে তার বেশী নয়।’
রুমি কিছুটা অভিযোগের সুরে বলল, ‘তোমাদের ছেলেদের ওই একই চিন্তাভাবনা।’ পাচু বলল, ‘আর মেয়েদের বুঝি নয়?’ রুমি বলল, ‘আমারা যে সাজগোজ করি, তা মেয়েদেরও দেখাই।’ পাচু বলল,’ তা ঠিক। তবে সেটা কম্পিটিশনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর ছেলেদের দেখাও কমপ্লিমেন্ট পাওয়ার জন্যে।’
‘তা আমার কমপ্লিমেন্ট তো এখনো দিলে না’, একটু থেমে রুমি আবার বলল, ‘আমার পায়ের নেল-পালিশের যা ছিড়ি, কি আর কমপ্লিমেন্ট দেবে?’
‘সময় হলে পাবে। এত তাড়াহুড়ো কেন? ‘চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে পাচু বলল, ‘পা দেখিয়ে কমপ্লিমেন্ট পাওয়ার জন্যে তো আর আমাকে ডাক নি। কি জন্যে ডাকলে – সেইটে বল।’
– ‘তুমি যে সাধু ভাষায় কথা বলো তা তো জানতাম না। আমার সাথে এত কথা বললে, একবারও সাধু ভাষায় কিছু বললে না। সে কি শুধু কচিকাঁচা মেয়েদের জন্যে তোলা থাকে?’
– ‘হচ্ছিল কথা নেল-পালিশ, কমপ্লিমেন্ট নিয়ে – এসবের মধ্যে সাধু ভাষা এলো কোত্থেকে?’
পাচুর মনে হল রুমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। পাচু বলল, ‘কি দেখছ ওরকম করে?’
– ‘দেখছি তোমাকে। আর ভাবছি, কত রূপ আছে তোমার। তুমি কি স্কুলের মেয়েদের টিজ করো?’
– ‘স্কুলের মেয়ে কেন? কোন মেয়েদের আমি কক্ষনো টিজ করি না। আমার সেই রকম রুচি নয়।’
– ‘তোমার সাথে কথা বলে আমার প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু, প্রমাণ তো অন্য কথা বলে। তাই ভাবলাম তোমাকে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি।’
পাচু এবার রেগে বলল, ‘এইরকম অপবাদ দেওয়ার আগে তোমার পুরো ঘটনাটা বলা উচিৎ। আমি কিন্তু অফেন্ডেড হচ্ছি এবার।’
রুমি পাচুর দিকে একটু ঘুরে বসে বলল, ‘আহা! আমার নাগর রে। উনি এখন অফেন্ডেড হচ্ছেন। টিজ করার সময় এই মন কোথায় ছিল?’
পাচু চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে রুমির দিকে ঘুরে মুখোমুখি হয়ে বসে আরো গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘পরিষ্কার করে বলবে – কি বলতে চাইছ?’
– ‘তুমি কিছুদিন আগে বাচ্চা মেয়েদের টিজ করো নি? তারা কি পড়ে এল তাদের প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে – সেই নিয়ে?’
এবার পাচুর মনে পরল ঘটনাটা। পাচু হো-হো করে বেশ কিছুটা হেসে বলল, ‘ও তাই বলো। প্রথমত, আমি একটা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন মেয়েকে নয়।’ তারপরে বলল, ‘আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়টা পড়তে পড়তে মনে হল, এই সাধু ভাষায় লেখার কি প্রয়োজন? এই ভাষায় কেউ কি আর কথা বলে? তাই একটা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কি পড়ে এল সেদিন। আমার প্রশ্ন শুনে তো ও সেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। আমাকে কি আজীব লোক ভেবেছিল – তা ওই জানে।’
রুমি কিন্তু তখনও খুব গম্ভীর, বলল, ‘তুমি হলে, কি ভাবতে?’
পাচুর হাসি তখন শেষ হয়নি। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আজীব লোকই ভাবতাম। তবে পরের দিন প্রস্তুত হয়ে গিয়ে উত্তরটা দিয়ে আসতাম।’
‘ওসব তোমাকেই মানায়’, রুমি একই রকম গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোন মেয়েকে কিছু বলো নি?’
পাচু বলল, ‘একদম না। তবে, এবার আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তুমি কবে থেকে আমার বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করা শুরু করলে?’
– ‘তোমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে আমার বয়ে গেছে। তোমার কোন পাত্তা নেই দেখে সেদিন একটা মেয়েকে বললাম, দ্যাখ তো ওই বারান্দায় পাচুদা বসে আছে নাকি। সে তো আমাকেই খারাপ একটা কিছু ভেবে বসল। তারপর তোমার টিজিঙের কথা বলল। ও আমাকে মিথ্যে কথা বলে না।’
পাচু এবার সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘ডাক তোমার ইনফরমার মেয়েটাকে। আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে আমি কোন মেয়েকে কিছু বলি নি।’
রুমি পাচুর চুলটা একটু ওলোঝালো করে দিয়ে চায়ের কাপ দুটো তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ওরে আমার নাগর রে। উনি আবার প্রমাণ দিতে পারেন। প্রমাণ তো আমার কাছেই আছে। তারজন্যে অন্যকে টেনে আনতে হবে না। আমার যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।’
রুমির পেছন পেছন পাচুও গেল রান্নাঘরে। রুমি কাপ দুটো রাখা মাত্র পাচু রুমির কাঁধ ধরে রুমিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি প্রমাণ আছে? কি বুঝছো? বলতেই হবে। তুমি যা-তা বলে যাবে আর আমি মেনে নেব?’
রুমি একটুও না-নড়ে নরম আদুরে সুরে বলল, ‘এই রকম ভাবেই বুঝি তুমি মেয়েদের টেনে ধরো?’ পাচু টের পেল, হঠাৎ ঘোরানোতে ব্যাল্যান্স হারিয়ে রুমি ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরেছে। পাচুর এক হাত তখনও রুমির পিঠে। সম্বিত ফিরে পেতেই পাচু হাতটা সরিয়ে নিল। রুমি কিন্তু পাচুকে ধরেই থাকল। বলল, ‘ছাড়লে কেন? কেরামতি শেষ? নাগর হওয়ার এতো সখ, কিন্তু নাগরের আর সাহসে কুলচ্ছে না – এইতো?’ তারপর বলল, ‘তাহলে এসো, আমি না-হয় আমার নাগরকে একটু আদর করি।’ এই বলে পাচুকে ঠেলতে ঠেলতে সোফা অবধি এনে বসিয়ে দিল আর নিজেও পাচুর একদম গা ঘেঁসে বসল।
এই কয়েক মুহূর্তে পাচু ঘেমে উঠেছে, তাড়াতাড়ি শ্বাস নিচ্ছে, মাথাও কেমন একটু বোঁ বোঁ করছে। ভাবছে, এ আবার কিসের পাল্লায় পড়লাম। মহিলা সুন্দরী, ঠেকের ভাষায় একটু ঢলানিও বলা চলে, কথায় পটীয়সী; কিন্তু এ কি পাগলামি? এর কোন বাজে মতলব নেই তো? কি করে ভালোয় ভালোয় এখান থেকে পালানো যায় তাই ভাবছে আর ঘেমে উঠছে।
রুমি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল? ফাঁকা বাড়ি। আমাকে টানলে, আমি কোন বাধা দিলাম না, চিৎকার করলাম না একটুও, বরং আরো জড়িয়ে ধরলাম। একটুও কমপ্লিমেন্ট পর্যন্ত পেলাম না এখনো। আমার নাগরের সব রস কি বেরিয়ে গেল নাকি এইটুকুতেই?’
পাচু বিরক্তির সাথে বলল, ‘তখন থেকে কি নাগর নাগর বলে যাচ্ছ আমাকে? তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাকে কিন্তু আমি ভালো ঘরের মেয়ে বলেই ভেবেছিলাম।’
রুমি পাচুর হাত দুটো নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তা আমি কি রকম ঘরের মেয়ে হলে তুমি আমার নাগর হতে?’
পাচু একটা ঝটকা দিয়ে নিজের হাতটা রুমির কোল থেকে টেনে নিয়ে বলল, ‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমাকে তখন থেকে নাগর বলে যাচ্ছ কেন? আমি কি করেছি?’
রুমি উঠে দরজার ছিটকিনিটা খুলে এসে সোফার পাশের চেয়ারে বসে পাচুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে খুব সাধারণ গলায় বলল, ‘সেদিন রিকশাওয়ালাকে তো তুমি এই কথাই বলেছিলে। বলো নি?’
পাচু মাথা নিচু করে আর একটাও কথা না বলে রুমির ঘর থেকে বের হয়ে গেল।