Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। পাঁচ ।।

এইভাবে প্রায় বছর দুই পার হয়ে গেছে। ছোটো বড় মিলিয়ে বিনির আরও তিনটে সম্বন্ধ এসেছিল। নানা কারণে কোনটাই এগোয় নি। বিনির বিয়ে হচ্ছে না – এই খবরটা তখন আর কোন ফিসফাস করে গল্প করার বিষয় নয়; সবাই জানে, সকলেই এ নিয়ে কথা বলে। কেউ-কেউবা বিনির সামনেই বলে।

প্রতিদিন সকালে শঙ্কর আসে দুধ দিতে। সেইদিন মায়ের শরীরটা ভালো নেই। তাই বিনি দুধের পাত্র নিয়ে দুধ নিতে গেল। শঙ্কর হাঁড়ি থেকে দুধ ঢেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছিস বিনি?’ ‘এই চলে যাচ্ছে।’ ‘তোর চাকরি কেমন চলছে?’ ‘ওই একই রকম।’ ‘আর কোথাও চেষ্টা করছিস না?’ ‘সেই রকমভাবে তো চেষ্টা করা হচ্ছে না।’ ‘তুই তো স্কুলে ফার্স্ট গার্ল ছিলি, তুই যদি এইরকম বলিস তো আমাদের কথা ভেবে দ্যাখ। সারা জীবন দুধ বেচে কাটাতে হবে আমাদের।’ এই বলে শঙ্কর এক মুহূর্ত বিনির দিকে তাকিয়ে দুধের হাঁড়িতে ঢাকনা লাগিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

বিনি ভাবল, শঙ্করকে কতদিন ধরে দেখছে ওদের বাড়িতে দুধ দিতে, কিন্তু আজ বিনির চোখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তারপরে ঘুরে চলে যাওয়াটাকে ওর মনে হল, খুব কাছের কেউ যখন অনেক দিনের জন্যে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মত দেখে, যে চাউনিতে কাছে পাওয়ার আকুতি থাকে, হারানোর ব্যথা থাকে; যার অনুরক্তিতে থাকে এমন স্নিগ্ধতা থাকে যা মনের মধ্যে একটা দাগ কেটে যায়, শঙ্করের তাকানোর মধ্যে সেইরকম একটা অনুভূতি ছিল। বিনি দুধটা ফ্রিজের মধ্যে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল।

তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আর একদিন সকালে বিনি দুধ নিতে এগিয়ে এল। তারপরে শঙ্করকে বলল, ‘শঙ্কর তোদের পাড়ার মোড়ে যে সিনেমা হল আছে তাতে সামনের রবিবারে চারটে টিকিট কেটে দিবি? আমি আর আমার তিন বান্ধবী যাব।’ ‘ঠিক আছে।’ বিনি শঙ্করকে টিকিট কাটার টাকা দিয়ে দুধ নিয়ে ভিতরে চলে এল। এই প্রথম নয়। বিনির মা এর আগেও শঙ্করকে টিকিট কাটতে দিয়েছে। সিনেমা হলের পাশেই শঙ্করদের মিষ্টির দোকান। ও সবাইকে চেনে। তাই কোন অসুবিধা হয় না ওর।

সে যাহোক, পরের রবিবারে বিনি সিনেমা হলে পৌঁছে দেখে শঙ্কর টিকিট কেটে হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিনি বলল, ‘আমাদের এক বান্ধবী আসতে পারে নি। তুই চল আমাদের সাথে।’ শঙ্কর বলল, ‘আমি কি তোদের সাথে সিনেমা দেখতে পারি? আমি বরং একটা টিকিট বিক্রি করে দিচ্ছি।’ বিনির বান্ধবীরা বলল, ‘চলুন না আমাদের সাথে। ও টিকিট বিক্রি করতে হবে না। ভালোই হবে, আপনি আমাদের গার্ডজিয়েন হয়ে থাকবেন।’ হাসতে হাসতে এই কথা বলে যখন ওরা থামল, শঙ্কর বলল, ‘আপনারা বললে আমি গার্ড হয়ে বাইরে থাকতে পারি, আপনাদের গার্ডজিয়েন হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘আপনাদের মত সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাথে বসে সিনেমা দেখা আমার মানায় না, আর তাতে আপনাদেরও সম্মানে বাঁধবে।’ শুনে সবাই চুপ।

বিনি খুব শান্ত ও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোকে আমাদের জন্য টিকিট কাটতে বলেছিলাম, কিন্তু তুই যাবি কিনা সেটা একবারও জিজ্ঞেস করি নি। সেই কারণে যদি তুই এইসব কথা বলিস তো আমার কিছু বলার নেই। তাড়াহুড়োয় একটা ভুল হয়ে গেছে, মানছি। কিন্তু অন্য কোন কারণে যদি এইসব বলিস তাহলে তোর সাথে আর কোনদিন কথা বলব না।’ তারপর একটু থেমে আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আর একটা শেষ কথা শুনে রাখ। তুই যদি না-যাস তাহলে আমিও সিনেমা দেখব না। বাকিটা তোর উপর, আমি কোন জোড় করব না।’ বিনির বান্ধবীরা বলল, ‘প্লিজ চলুন না। আমরা সকলে রিকোয়েস্ট করছি আপনাকে।’

শঙ্কর কিছুটা ইতস্তত করে বলল, ‘ঠিক আছে, চলুন।’ চারজনে সিনেমা হলে ঢুকল। বিরতির সময়ে শঙ্কর সকলের জন্যে কিছু স্নাক্স কিনে নিয়ে এল। টুকটাক গল্প-গুজবের মধ্যে শঙ্কর একবার বলল, ‘আপনাদের সাথে একসাথে বসে যে সিনেমা দেখব সেটা কোনদিন ভাবিনি। আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম?’ ‘আয়না দেখে উঠেছিলি,’ বিনি বলল।

সিনেমা দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়ে গেল। আর কোন কথা হল না। সিনেমা শেষ হওয়ার পরে বিনির দুই বান্ধবী চলে গেল। বিনি শঙ্করকে বলল, ‘আমার সাথে একটু চল।’ দুইজনে পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

বিনি বলল, ‘শঙ্কর, তোকে আমি কবে থেকে দেখছি, তোর মনে আছে?’

– ‘না। ছোটবেলা থেকে তোদের বাড়িতে দুধ দিতে যাই। এইটুকুই মনে আছে।’

– ‘তুই কি কলেজটা শেষ করেছিলি?’

– ‘না। ফার্স্ট ইয়ারেই ড্রপ দিয়ে দিয়েছি। আমি তো পড়াশুনোয় তোদের মত ভালো ছিলাম না। আর যখন বুঝলাম যে কলেজ পাশ করেও একই কাজ করতে হবে তখন আর ওর পেছনে সময় নষ্ট করলাম না।’

বিনি হাসতে হাসতে বলল, ‘তোর মাথায় তো চিরকালের পাকা বুদ্ধি। তা পড়াটা শেষ করলি না কেন?’

শঙ্কর বলল, ‘মাঝে মাঝে যে সে কথা ভাবি নি তা নয়। তবে আজ থেকে আর কোন আফসোস নেই।’

– ‘তার মানে?’

‘কলেজ পাশ করলে তোদের সাথে একসাথে বসে সিনেমা দেখা যেত। আজকের পর থেকে সেই আফসোসটা আর থাকবে না।’ বলে শঙ্কর হাসতে থাকল।

– ‘তোর কি দুঃখ হয় না যে তোকে ছোটবেলা থেকে এইসব করতে হয়? অন্যদের মত আড্ডা মেরে বেড়াতে পারিস না।’

– ‘খুব একটা হয় না। আর তাই যদি বলিস, দুঃখ কার না নেই? তোর কোন দুঃখ নেই?’ এই বলে শঙ্কর বিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।

আবার অন্তর্ভেদী সেই চাউনি। বিনির ভিতরটা কেঁপে উঠল। বলল, ‘কথাটা খুব খারাপ বলিস নি। আমি সারা স্কুল, কলেজ লাইফ পড়াশুনো করলাম। কি লাভ হল? তুই ভালোই করেছিস।’ তারপরে একটু থেমে বিনি বলল, ‘বাবা-মাকে খুশী করার জন্যে সবসময় পড়াশুনো করে গেলাম। ভালো রেজাল্ট করলাম। প্রেম করলাম না, আড্ডা মারলাম না, সেইরকম কোন ছেলে বন্ধু হল না।’ একটু থেমে বলল, ‘কিন্তু গায়ের রঙটা একটু ফর্সাও করতে পারলাম না যে।’

শুনে শঙ্কর অবাক হয়ে গেল; কোন কথা খুঁজে পেল না। শঙ্কর বিনির দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না। তখন বিনি শঙ্করের চোখের উপর চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি দেখতে এতই খারাপ যে কেউ সেটাকে অতিক্রম করে আমাকে জানতে চেষ্টা করে না?’

শঙ্কর বলল, ‘আমি জানি তোর ঘটনা। দুধ দিতে গিয়ে কয়েকবার টুকটাক শুনেছি।’ এই বলে শঙ্কর হাঁটা শুরু করল। কেউ বিশেষ কথা বলল না। একটু পরে বিনির বাড়ি চলে এল। ‘ভাবিস না বিনি। মন খারাপ করিস না।’ এই বলে শঙ্কর বিদায় নিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9