Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। সাত ।।

সারাটা রাস্তা বিনির একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে গেল নিজের ঘরে। তারপরে সারাক্ষণ এইটাই ভেবে গেল যে, হঠাৎ ওর কি যে হল? কি করে ও শঙ্করকে বিয়ে করতে বলতে পারল? লজ্জায় নিজেকে ছিঃছিঃ করতে লাগল। পরে মনে হতে লাগল, এতদিন নিজের সমস্ত সুখ-দুঃখ কোন এক অপরিচিতের হাতে নির্দ্বিধায় তুলে দিতে রাজি ছিল। তখন কিছু মনে হয় নি। তারচেয়ে একজন চেনাজানা ছেলের সাথে বাকি জীবনটা কাটানই ভালো না কি?

আঁকা প্রায় শেষ করে আনার পরে হঠাৎ একটা কালির দোয়াত উল্টে তার উপর পরে গেলে যেমন হয় – বিনির এখন সেই রকম অবস্থা। গত আড়াই বছর ধরে একই কথা শুনে শুনে বিনি জেনে গেছে যে সে দেখতে এতটাই বাজে যে কেউ তাকে পছন্দ করে বিয়ে করবে না। এই গ্লানি সহ্য করতে করতে এটাকেই সত্যি বলে মেনে নিয়েছিল একদিন। ধরে নিয়েছিল ওর আর কোনদিন বিয়ে হবে না। মনে মনে একা থাকার একটা পরিকল্পনা একরকম তৈরি করে ফেলেছিল। ছবিটা হঠাৎই যেন বদলে যাচ্ছে। বিনি ভয় পেল।

ভালোবাসা না-পেয়ে যে দুঃখ হয়, সে দুঃখ ব্যথা দেয়, কিন্তু তাতে ভয় করে না। আজ ক্ষণিকের জন্যে হলেও একবার ভালবাসার আশ্বাস পেয়ে তাকে হারানোর ভয় বিনিকে এবার ছেঁকে ধরল। বিনি ভাবল, কাল বা পরশু যদি শঙ্কর ওকে বলে, সে মুহূর্তে সে যা বলেছিল সেটা নেহাতই ঝোঁকের বসে বলে ফেলা। তখন সন্ধে রাত। একবার ভাবল, যায় শঙ্করের সাথে আরেকবার দেখা করে আসে। পরক্ষণে ভাবল, এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।

পরের দিন সকালে শঙ্কর আসার আগে বিনি নিজের ঘরে ঢুকে বসে থাকল। শঙ্কর এসে অন্যদিনের মত ডাক দিল, ‘দুধ নিয়ে যান।’ বিনি পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল, শঙ্করের চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে। বিনির মা ডাক দিল, ‘ বিনি শঙ্কর এসেছে দুধটা নিয়ে নে।’ বিনি চুপ করে বসে থাকল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শঙ্কর আরেকটু জোরে ডাক দিল, ‘দুধটা নিয়ে যান।’ কাজের মাসি বেড়িয়ে দুধ নিয়ে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শঙ্কর চলে গেল।

বিনির বুঝল, শঙ্কর ওকে খুঁজছিল। একবার ভাবল, না-গিয়ে ও ভুল করেছে। তারপর ভাবল, শঙ্কর যদি ওকে বলত কালকের কথা ভুলে যেতে। বিনির মাথাটা বোঁবোঁ করে উঠল।

পরের দিন বিনি বুঝতে পারল, যাই হোক না কেন এটা পাকাপাকি ভাবে না-জেনে ও আর থাকতে পারছে না। সকাল বেলায় শঙ্কর যেই ডাক দিল, ‘দুধ নিয়ে যান।’ বিনি অমনি দুধের পাত্র নিয়ে বাইরে এল। শঙ্কর দুধ দিয়ে ওর হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে একটু হেসে চলে গেল। বিনি কাগজের টুকরোটা হাতের মধ্যে লুকিয়ে দুধটা ফ্রিজে রেখে নিজের ঘরে চলে এল।

“গতকাল আশা করেছিলাম তোকে দেখতে পাব। এলি না কেন? সামনের রবিবার দেখা হবে। ভাল করে চিন্তা করে বলিস আমাকে। ভালো থাকিস।”

বিনি বার বার করে লাইন কয়টা পড়ল আর ভাবল, সকলের কাছে যে শুধু প্রত্যাখিত হয়ে এসেছে তার কাছে ভালো করে চিন্তা করার মত কি আছে?

সেদিন রবিবার। বিকাল বেলা কি পড়বে, কি সাজবে তা নিয়ে সকাল থেকে বিনি অনেকবার মত বদল করেছে। এর আগে যখন কোন পাত্রপক্ষ দেখতে আসত, বিনি সাজত। তবে তাতে সাজার আনন্দের থেকে উৎকণ্ঠাই থাকত বেশী। আজ ওর সবচেয়ে ভালো করে সাজতে ইচ্ছে করছে। কেউ আজ ওকে সত্যি দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।

সিনেমা হলের সামনে পোঁছাতেই শঙ্কর এগিয়ে এল। বলল, ‘তোর পাশে আমি এমনিতেই বেমানান। তার উপর তোকে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে কি বলব!’ নে এবার বাইকে উঠে পর।’ শঙ্কর বিনিকে নিয়ে চলে গেল দূরে একটা পার্কে। সেখানে শঙ্কর বিনির সামনে বসে বিনিকে হাঁ-করে দেখতে লাগল। বিনির অস্বস্তি লাগলেও ভালো লাগল। মনে হল, অন্তত কারুর কাছে সে সুন্দর, অন্তত একজনের তাকে ভালো লাগে। বলল, ‘অমন করে দেখিস নাতো, আমার খুব অস্বস্তি লাগছে।’

শঙ্কর একটু হেসে বলল, ‘কি করব? তোকে এইরকম ভাবে কোনদিন দেখিনি তো আগে।’ বিনি মাথা নিচু করে নিল। ঘাসের মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে খুশীতে ভিতরটা শিরশির করে উঠল। বিনি চোখ বন্ধ করে দুয়েকটা ঘাসের পাতা ছিঁড়ে নিল। তারপরে শঙ্করের দিকে তাকাতে দেখে শঙ্কর তখনও একই রকম ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ঘাস দুটো শঙ্করের চোখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বিনি শঙ্করের মাথাটা ঠেলে একটু ঘুরিয়ে দিল। মুখে বলল, যা!

কয়েকটা মুহূর্ত তবু সেটা পার করতে বিনি অধৈর্য হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল, কি রে?

শঙ্কর মাথাটা আস্তে করে বিনির দিকে ঘুরিয়ে বিনিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভাবলি শেষ পর্যন্ত?’

বিনি চমকে উঠল। বলল, ‘তার মানে?’ ‘মানে, তুই কি সত্যি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিস? কিছুদিন পরে আবার আফসোস করবি না তো? আমি কে? কি? – সবই তুই জানিস। তোর বাড়ির লোক মেনে নেবে?’

বিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে থাকল। আর মনে মনে ভাবল, এর ঠিক উল্টো ভয়টা ওর নিজের মনেও আছে। শঙ্কর আজ ঝোঁকের বসে যা বলছে, কাল যদি সেই মনোভাব আর না-থাকে। তারপরে খুব শান্ত হয়ে বলল, ‘এর আগে পাঁচজনকে ভালবাসবো, তাদের ভালোবাসা পাবো – এই আশায় তাদের সামনে সেজে-গুজে বসেছিলাম। সারাক্ষণ মুখে হাসি বজায় রেখে মিষ্টি-মিষ্টি করে তাদের সাথে কথা বলেছিলাম, যাতে তাঁরা আমাকে পছন্দ করে। তাঁরা আমাকে অপমান না-করলেও, সকলেই সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতিবার একটু একটু করে নিজেকে নামাতে নামাতে আজ আর আমার কোন জায়গা নেই। আজ আমার আফসোস একটাই, আর সেটা সারা জীবনই থেকে যাবে।’ শঙ্কর বিস্ময় আর কৌতূহলের চূড়ান্তে এসে বিনির মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে তখন। বিনি আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কতো বছর ধরে তোকে দেখছি, তোর কাছে অনেক আবদারও করেছি। কোনদিন এই আবদারটা কেন করিনি? অনেকটা সময় নষ্ট…’। গলা ধরে এল। বিনি আর বলতে পারল না। শঙ্করের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। বিনির হাতটা ধরে একই রকম ভাবে চুপ করে বসে থাকল।

বিনি আবার বলা শুরু করল, ‘ভালোবাসা বলতে কি বোঝায় আমার কাছ থেকে একটু একটু করে সব চলে গেছে। যাকে বলে করুণা করে ভালোবাসা পাওয়া, এক সময় তাও চেয়েছিলাম। সেও পাই নি। ঘরে-বাইরে কত রকম কথা শুনতে হয়েছে – এখন তার লিস্ট রাখি না। তাই, তোকে ভালবাসি কি না – তা বলতে পারব না আজ। তবে, আমি এটা ঠিক করে ফেলেছি যে, তুই যদি আমাকে বিয়ে করিস তো আমার বিয়ে হল, নতুবা সেইটে আমার জীবনে আর হবে না। এখন তুই ভেবে চিন্তে যা বলার আমাকে বল।’

এই কথাগুলো শোনার আগে অবধি শঙ্করের কোন ধারনা ছিল না বিনি কি ভীষণ দুঃখের মধ্যে দিয়ে দিন পার হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে এনিয়ে কোনদিন ভাবেও নি। শঙ্করের মনে হল সেই অচেনা লোকগুলোকে ধরে তাদের মুখে আলকাতরা লেপে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। রাগে গা রিরি করে উঠল। শঙ্কর বলল, ‘বিনি, আমার ক্ষমতায় যদি কুলতো, তাহলে এখুনি তোকে তোর বাড়ির উঠোনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পড়িয়ে নিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু তোর বাড়ির লোক তো আমাকে মেনে নেবে না।’

বিনি বলল, ‘বিয়েটা করব আমি। আমার বাড়ির লোক কি করবে, কি মানবে, না-মানবে তার ভার আমার। তবে তোকে আমি কোন জোর করব না। একবার বলে ফেলেছিস মানে তোকে সেটা মেনে চলতে হবে না। ঝোঁকের মাথায় অনেকেই অনেক কথা বলে। তবে ভালোবাসা পেয়েছি বলে যদি একবার বিশ্বাস করি, সেটা ভেঙ্গে যাওয়ার মত নিদারুণ কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না।’

শঙ্কর শুধু বলল, ‘তোকে আগেও বলেছি, আবার বলছি। তোকে বিয়ে করব, বা তোর সাথে প্রেম করব, এমনকি তোর সাথে একলা পাশাপাশি বসে গল্প করব – তেমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আজ তোকে পেয়ে আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?’ তারপর পরিবেশ হালকা করার জন্যে বলল, ‘তুই আমার সামনে চুপ করে বসে থাক আজ, আমি শুধু তোকে দেখি। যা ভালো লাগছে তোকে।’ ‘উপহাস করছিস আমাকে নিয়ে?’ ‘একেই বলে পরিহাস! তুই যে আমার কাছে কি তা যদি তুই একটুও জানতিস! তাহলে!’ শঙ্কর আর কিছু বলল না।

বিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল শঙ্করের দিকে। ভাবল, এও কি সম্ভব! তারপরে শঙ্করের কাছে সরে এসে ওর হাত ধরে বসল। বলল, ‘সরি রে। এইসব কোনদিন পাইনি তো, তাই এর মর্যাদাও করতে শিখি নি। কয়েকদিন দে প্লিজ। কোন অমর্যাদা করব না। কথা দিচ্ছি।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9