Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। আট ।।

সেইদিন রাতে খেতে বসে বিনির মা বললেন, ‘একটা নতুন সম্বন্ধ এসেছে। তোর বাবা সামনের রবিবারে ওনাদের আসতে বলেছে। সেদিন তুই কোথাও বের হোস না।’

বিনি গম্ভীরভাবে বলল, ‘ওদের আসতে মানা করে দিও। অনেক তো হল। আমি আর পারছি না।’

– ‘পারছি না বললে তো হয় না।’

– ‘আমি এ বিয়ে করব না।’

– ‘কিছু না-জেনেই একথা বলছিস কেন? কি করবি? তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ হয়েছে?’

বিনি একটু রেগেই উত্তর দিল, ‘কিছু না-জেনে মানে? আর কতবার আমাকে জানতে হবে যে আমাকে তাদের পছন্দ হবে না? দরকার পড়লে কোন এক রিকশাওয়ালাকে বিয়ে করব। আমার বিয়ে, আমি বুঝব। তোমাদের এনিয়ে আর কোন চিন্তা করতে হবে না।’ এই বলে উঠে চলে গেল।

রবিবারে যথারীতি বিনিদের বাড়িতে পাত্রপক্ষের বাড়ির লোক এল। বিনি খুব সাধারণ ভাবেই তাদের সামনে গেল, অত্যন্ত নিঃস্পৃহ হয়ে দু-একটা কথা বলে উঠে চলে গেল ভিতরে। পাত্রপক্ষ বিদায় নেবার পরে বিনির সাথে ওর বাবা-মায়ের এক চোট ঝগড়া হয়ে গেল।

সোমবার স্কুলের শেষে বিনি শঙ্করের মিষ্টির দোকানে গেল। বিনিকে দেখে শঙ্কর বের হয়ে এল। শঙ্কর জানত যে রবিবারে কেউ বিনিকে দেখতে আসবে। শঙ্কর জিজ্ঞেস করল, ‘তোকে এই রকম দেখাচ্ছে কেন? তোর কিছু হয় নি তো?’ ‘না কিছু হয় নি। গতকালের অতিথিদের এমন বিদায় দিয়েছি যে এ পথ আর মাড়াবে বলে মনে হয় না। তবে আমি আর পারছি না। বাবা-মার সাথে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। তুই তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা কর। আমি আর বাড়িতে থাকতে পারছি না।’ ‘কয়েকটা দিন সময় দে।’ ‘সাতদিন দিলাম।’ এই বলে বিনি গটগট করে ফিরত চলে গেল। শঙ্করের উত্তরের কোন অপেক্ষা করল না।

বিনির এই অবস্থা দেখে শঙ্কর কিছুটা ঘাবড়ে গেল। অনেক ভেবেচিন্তে সন্ধের পরে সমীরের কাছে গিয়ে সমীরকে সব বলল। শঙ্কর বিনির সাথে যে সিনেমা দেখেছে বা বিনির বিয়ে নিয়ে যা চলছে সে সম্পর্কে এক-আধটু জানলেও ঘটনা যে এতদূর গড়িয়েছে সমীর তা জানত না। আশ্চর্য হওয়ার প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে সমীর বলল, বল আমাকে কি করতে হবে? তোর কথা শুনে আর তোদের অবস্থা দেখে আমি তো বলব, যত তাড়াতাড়ি পারিস রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেল। অ্যাডাল্ট মেয়ে। একবার রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেললে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না।

পরের দিন সকাল বেল দুধ দিতে গিয়ে শঙ্কর বিনির হাতে একটা চিরকুট দিয়ে এল। “স্কুল শেষ হওয়ার পরে আমি মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করব। কথা আছে।”

স্কুল শেষ করে বিনি শঙ্করের সাথে দেখা করল। শঙ্করের বিনিকে এক নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ওর পুরো পরিকল্পনাটা বলল। তার মূল কথা এই যে, শঙ্কর সব কথা সমীরকে বলেছে। সমীরের সাথে এক ম্যারেজ রেজিস্টারের আলাপ আছে। সমীর তাকে বলে সমীরের বাড়িতেই রেজিট্রির ব্যবস্থা করবে। একবার রেজিট্রি হয়ে গেলে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। তারপর সুযোগ বুঝে বাড়িতে বলা যাবে। এখন বিনির মত পেলেই কাজে লেগে পরা যায়।

সব শুনে বিনি বলল, এতে আপত্তি করার কি আছে। যত তাড়াতাড়ি পারিস ব্যবস্থা করে ফেল।

পরিকল্পনা মত কাজ এগোল। রেজিট্রার অনেক প্যাঁচঘোট করে জানালো আগামি পয়লা এপ্রিলের আগে এটা সম্ভব না। অতপর সেই দিনই রেজিট্রি করা ঠিক হল।

এদিকে বিনির বাড়িতে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে লাগল। আগে বিনির বিয়ে নিয়ে কেউ কিছু বললে বিনি সেখান থেকে সরে যেত। সেটাই একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন বিনি সেইসব আলোচনায় যোগ দেয়, তর্ক-বিতর্ক করে। সেই নিয়েই যত বিপত্তি। একদিন রাতে বিনি ওর বাবা-মাকেও দোষীর কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দিল এইবলে যে, তাঁরা বিনির ভালো করার চেয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানোর দিকে বেশী ঝোঁক। সেই কথা নিয়ে সেদিন তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। বিনি ঠিক করল, সোমবারই ও চলে যাবে। দিনের বেলায় গেলে, নানান প্রশ্ন এবং বাধার মধ্যে পড়তে হবে। তাই কাউকে না-বলে বের হয়ে যাবে।

পরের দিন দুধ নেবার অছিলায় বিনি শঙ্করের হাতে একখানা কাগজ পাশ দিল। তার মূল বক্তব্য – এক মুহূর্তে বাড়িতে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখান থেকে পালানো ছাড়া আমার আর কোন সহজ উপায় নেই। পয়লা এপ্রিল, সোমবার ভোরবেলা আমি তোর সাথে চলে যাব। তুই সেইমত ব্যবস্থা করে রাখিস।

শঙ্কর সমীরের কাছে গিয়ে আবার সব বলল। তারপরে সমীরের পরামর্শে দুজনে ঠিক করল যে, ভোরবেলা ওরা দুজনে সমীরের বাড়িতে উঠবে। সেখানে সকাল-সকাল রেজিট্রি  সেরে তারপরে দু-একদিন সমীরের বাড়িতেই থাকবে। তারমধ্যে বিনির বাড়ির অবস্থা বুঝে পরের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

এই কয়েকদিনে বিনি একটু একটু করে কিছু জিনিষ আগেই শঙ্করকে দিয়ে এসেছিল যাতে সোমবার দিন ভোরবেলা চুপচাপ বের হয়ে আসতে কোন অসুবিধা না হয়। তারপর পয়লা এপ্রিল, সোমবার, পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনি শঙ্করের সাথে সমীরের বাড়িতে গিয়ে উঠল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9