Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। ছয় ।।

শঙ্করদের দোকান রবিবার বন্ধ থাকে। শঙ্কর বিনিকে প্রায় ওর বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা চলে গেল। সারাক্ষণ আড্ডার মাঝে ঘুরে ফিরে বিনির কথাগুলো মনে পরে যাচ্ছিল। শঙ্কর বিনির সাথে এর আগেও কথা বলেছে। তবে এই প্রথম বিনি ওর দুঃখের কথা বলল। এক দফায় এতগুলো কথা কেন বলল, শঙ্করের মনে বারবার সেইটেই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। বিনির কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শঙ্করের মনটা একটা দুঃখে ভরে উঠল।

শঙ্করদের বেশ কয়েকটা গরু আছে। ওই দুধ বিক্রি করে আর মিষ্টির দোকান থেকে যা আয় হয় তাই দিয়েই ওদের সংসার চলে। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে ওর কাজ হল সকাল বেলায় বেশ কয়েকটা বাড়িতে দুধ দিয়ে আসা। বিনিরা ওদের অনেকদিনের খদ্দের। এইটুকুই ওর সম্পর্ক, এইটুকুই ওর চেনা। তবু বিনির কথা শুনে আজ শঙ্করের মনটা ভারি হয়ে গেল।

দিন কয়েক পরে প্রতিদিন সকালে যেমন দুধ নিয়ে এসে শঙ্কর ডাক দেয়, ‘দুধ নিয়ে যান’, সেইরকম একটা ডাক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শঙ্কর শুনল, ঘরের মধ্যে বিনির সাথে ওর মার একটু উঁচু স্বরে ঝগড়া চলছে। বিনি বলল, ‘এই নিয়ে তো পাঁচ বার হল, আর কেন?’ বিনির মা বললেন, ‘বিয়ে তো দিতে হবে। আর এটাই তার প্রথা। ছেলের বাড়ির লোক না-দেখলে কথাবার্তা কি করে হবে?’ ‘এর আগেও তো হয়েছে। আমার কি কোন মান-সম্মান নেই? দেখতে যদি আসে তো আগে থেকেই বলে দিও যে আমার গায়ের রঙ কালো, বাবার টাকাও নেই। আমি কোন বাজারের পণ্য নই।’ ‘তোর সব বড় বড় কথা। এইভাবেই সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়।’ ‘সে আর হল কোথায়?’ ‘তো নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলেই তো পারিস।’ ‘এবার তাই করব।’

শঙ্কর বুঝল এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যের কথা শোনা ঠিক নয়। সে এবার জোরে ডাক দিল, ‘দুধটা নিয়ে যান।’

বিনি বের হয়ে এল। দুধের পাত্রটা শঙ্করের সামনে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। শঙ্কর ধীরে ধীরে দুধ ঢেলে দিয়ে একবার বিনির মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। তারপর নিজের দুধের ক্যানের মুখটা লাগিয়ে চলে গেল।

শঙ্কর ভাবল, আজ যদি বিনির জায়গায় ও থাকত আর পাঁচজন ওকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যেত তাহলে ওর মনের অবস্থা কি হত। ভাবতেই শঙ্কর শিওরে উঠল। শঙ্কর দেখতে তেমন ভালো নয়, ওর বিদ্যা বা পয়সা কোনটাই নেই। এইটা মনে হতেই নিজেকে যেন আরও বিনির খুব কাছের কেউ মনে হতে লাগল।

দিন কয়েক পরে একদিন দুধ দিতে এসে বিনিকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই রবিবারে সিনেমা দেখতে যাবি?’

বিনি কি একটা ভাবল, তারপরে বলল , ‘যেতে পারি। টিকিট কেটে রাখবি তো?’ ‘হ্যাঁ। ওই জায়গায় থাকব।’ এই বলে শঙ্কর চলে গেল।

শঙ্কর টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে ছিল। বিনি এসে বলল, ‘সিনেমাটা তেমন ভালো না শুনেছি। চল, তার চেয়ে ভালো কোথাও বসে গল্প করা যাক।’

শঙ্কর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তারপরে নিজেকে সামলে কি ভেবে বলল, ‘চল। তাই ভালো।’

বিনিকে বাইকের পেছনে বসিয়ে শঙ্কর নিয়ে গেল পার্কের এক নিরিবিলি জায়গায়। তারপর বাইকটা দাড় করিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করিস না। সেইদিন তোর কথা শুনে আর গত সপ্তাহে দুধ দিতে গিয়ে তোর বাড়িতে কিছু কথা শুনে তোর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই তোকে সিনেমা দেখতে আসতে বলেছিলাম।’ শঙ্করের কথা থামিয়ে বিনি বলল, ‘এখন কি অন্য কথা ভাবছিস? বস এখানে।’

দুজনে সামনা-সামনি বসল। কারুর মুখে কোন কথা নেই। বিনি প্রথম মুখ খুলল। বলল, ‘বল, কি বলবি বলে আমাকে ডেকেছিলি?’

শঙ্কর বলল, ‘অন্যের কথা আড়ি পেতে শোনা আমার স্বভাব নয়, তবে আমি কানে কালাও নই। এরপর থেকে তোদের নিজেদের কথা একটু নিচু স্বরে বলিস।’ বিনি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল। শঙ্কর বলল, ‘এই নিয়ে তোর কয়টা সম্বন্ধ এল?’

বিনি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘পাঁচটা। সবগুলোতে আমাকে বাতিল করে দিয়েছে, বাবা-মা এখন ছয় নম্বরের জন্য উঠে পরে লেগেছে।’ এই বলে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ চাপা দিয়ে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে রুমাল সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা একটা সত্যি কথা আমাকে বলবি?’ ‘কি বল?’ ‘মা কি তোকে পাঠিয়েছে আমাকে কিছু বোঝানোর জন্যে?’

শঙ্কর হকচকিয়ে গেল। বলল, ‘তুই পাগল হলি নাকি? তোর মা জানে না যে, আমি তোকে সিনেমা দেখতে আসতে বলেছি। তুই বলেছিস না কি?’

বিনি বলল, ‘না। কিছু বলিনি।’ তারপরে শঙ্করের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তুই এই সব নিয়ে জিজ্ঞেস করছিস কেন?’

শঙ্কর বলল, ‘কেন করছি তা আমি নিজেও জানি না। তবে সেইদিন থেকে তোর কথাগুলো আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। তারপর গত সপ্তাহে তোর আর তোর মায়ের অনেক কথা শুনে ফেলেছিলাম। তারপরে থেকে…’। শঙ্কর আর কিছু বলতে পারল না।

বড় রকম ঝড়ের আগে সারা আকাশ বাতাস যেমন থমথমে হয়ে আসে। শঙ্কর দেখল বিনির মুখের অবস্থা অনেকটা সেইরকম। তারপর চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়াতে না-গড়াতেই বিনি ঝেঝিয়ে বলে উঠল, ‘আমি কালো হতে পারি, তবে আমি কোন বাজারের মেয়ে নই যে একজন করে আসবে আর দেখে চলে যাবে। তোরা নিজেদের কি ভাবিস?’ বলেই ফিউ ফিউ করে কাঁদতে লাগল।

শঙ্কর তাকিয়ে দেখল পার্কে আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তখন অনেক সাহস জোগাড় করে বিনির হাতদুটো ধরে বলল, ‘আমি বুঝছি তোর মনের অবস্থা। তবে সবাই এক রকম না। দেখিস এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বিনি একটা হাত ছাড়িয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘ঠিক হয়ে যাবে মানে? আমি কি দেখতে সুন্দরী হয়ে যাবো, না আমার বাবা লটারিতে অনেক টাকা পেয়ে যাবে?’

শঙ্কর বিনির অন্য হাতটা ধরেই রাখল। বলল, ‘লটারির কথা হচ্ছে না। তবে তুই সুন্দরী না, একথা কে বলল তোকে? গায়ের রঙেই শুধু মেয়েরা সুন্দরী হয় নাকি?’

বিনি অন্য হাতটা শঙ্করের হাতের ভিতর থেকে টেনে ভালো করে নিজের চোখ মুছে শঙ্করের দিকে এমন এক ধারালো দৃষ্টিতে তাকাল যে শঙ্কর এক রকম ভয় পেয়ে গেল। তারপর ক্রুর দৃষ্টিতে শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বিনি বলল, ‘মেয়ের মুখখানা যদি এত কালো হয়, তাহলে ওর সারা শরীর তো আরো কালো হবে। পাত্রের মা সবার সামনে এই কথা বলেছিল। ভাবতে পারিস! বিয়ে হলে তিনি আমার শাশুড়ি হতেন। বাজারের মেয়েদেরও এর থেকে বেশী সম্মান আছে। এরপরেও বলিস গায়ের রঙে সুন্দরী হয় না। আবার আমাকে আর এক ছেলের বাড়ির লোকের সামনে বসতে হবে – যে তারা আমাকে পছন্দ করে কি না? এই অবস্থায় নিজে না-পরলে বুঝতে পারবি না।’

শঙ্কর চুপ করে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পরে বিনি বলল, ‘তোরা ছেলেরা কি বুঝবি? ক্রীতদাস কেনার সাথে এর কোন পার্থক্য নেই।’

শঙ্কর নিচু স্বরে বলল, ‘তাহলে আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ। তোর তো অত ভালো রেজাল্ট আছে, একটা চাকরি আছে। পরে আরও ভালো চাকরি পেয়ে যাবি। আমার তো কিছুই নেই। আমার তো আরও নাজেহাল অবস্থা হবে।’

বিনি তাচ্ছিল্যের সাথে একটা “হুঃ” শব্দ করে বলল, ‘তোর আর কি? ওইরকম ভাবে যাবি, আর মেয়ে পছন্দ না-হলে একটা মন্তব্য করে চলে আসবি। বুঝবি না একটা মেয়ে কিভাবে মানসিক বিপর্যস্ত হয় তাতে।’

শঙ্কর এইবার বিনির মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি বুঝছি তোর মানসিক অবস্থা। তাই বলে, ওই দলে আমাকে ফেলে অপমান করছিস কেন?’

বিনি বলল, ‘ওঃ! এইটুকুতেই অপমানবোধ হচ্ছে। পারবি তুই আমাকে বিয়ে করতে? তুই তো আমাকে কত দিন ধরে জানিস।’

শঙ্কর হা-করে বসে থাকল। মুখ থেকে কোন শব্দ বের হল না। বিনি বলল, ‘হয়ে গেল তো? কালো মেয়ের সাথে সিনেমা দেখা যায়। পার্কে এনে গল্প করা যায়। পারলে আরও অনেক কিছু ফষ্টিনষ্টি করা যায়। তাকে বিয়ে করা যায় না। তখন ওই গায়ের রঙ বা বাবার টাকা এসে যায় সবার আগে।’

শঙ্কর আর বিনি দুজনে তারপরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। মৌনতা ভাঙল শঙ্কর। বলল, ‘আমি যদি বলি, আমি রাজি। তুই কি আমাকে বিয়ে করবি?’ বিনি ঘুরে তাকাল শঙ্করের দিকে। শঙ্কর বলল, ‘আমার তো তোকে বিয়ে করার মত কোন যোগ্যতাই নেই।’

বিনি বলল, ‘কথাটা তুই যেভাবে বললি, আমার ভালো লাগল। তবে আসল জায়গায় এসে দেখলি তো তোরা সব সমান।’

– ‘তার মানে?’

– ‘মানে, মেয়েদের কালো হাওয়ার মত অযোগ্যতা অন্য সব যোগ্যতাকে ঢেকে দেয়। তুই ও কায়দা করে কাটিয়ে দিলি।’

– ‘আমাকে তোর বাড়ি থেকে কি মেনে নেবে?’

– ‘তুই যে আমাকে অপমান না-করে এতগুলো কথা বলেছিস, তাতেই আমি খুশী। কষ্ট করে তোকে আর কোন নতুন বাহানা বের করতে হবে না।’

শঙ্কর বলল, ‘বিনি তোকে বিয়ে করার মত কোন যোগ্যতা আমার নেই। তোকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেও পারি নি কোনদিন। তবে তুই যদি ভাবিস, আমি এটা এড়ানোর জন্য বলছি, তা হলে জেনে রাখ, তোকে বিয়ে করতে পারলে তার চেয়ে বেশী আমি কিছু চাই না। বিশ্বাস কর।’

বিনি অন্য দিকে মুখ করে চুপ করে বসে থাকল। অনেকক্ষণ পরে শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ইয়ার্কি মারছিস না তো আমার সাথে?’ ‘এইটে কোন ইয়ার্কি মারার বিষয় হল, বিনি? এই সময়ে?’ ‘তুই সত্যি বলছিস?’ বিনি শঙ্করের হাতটা ধরল।

শঙ্কর থুতনি ধরে বিনির মুখটা নিজের দিকে তুলে বিনির চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, ‘আমি এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করতে করে বলতে পারি। তবে তুই পরে আক্ষেপ করিস না যেন।’ তারপরে বলল, ‘অনেকক্ষণ হল। এবার বাড়ি চল। ভেবে জানাস।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9