Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। চার ।।

পরেরদিন বিনির সম্মতি পেয়ে রমেনবাবু বেশ তোড়জোড় করে পাত্র পক্ষের সাথে কথাবার্তা চালালেন। কিছুদিন পরে পাত্র পক্ষের বাড়ির লোকজন এল কন্যা দেখতে। সবই কাটল ভালোয় ভালোয়। কিন্তু, শেষ পর্বে পাত্রের বাবা রমেনবাবুকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে এমন একটা অঙ্কের টাকা চাইলেন যে, রমেনবাবুর মাথায় হাত পড়ল।

খবরটা যখন বিনির কানে পৌঁছল, বিনি জানিয়ে দিল সে এই বিয়েতে একেবারে নারাজ। রমেনবাবু মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ বিনি বলল, ‘ব্যবস্থা যে একটা হয়ে যাবে সেটা জানি। তবে তার জেরটা তোমাদের উপর কিভাবে পড়বে সেটা ভেবে তো আর আমি সুখী হতে পারব না।’ রমেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন, তারপরে উঠে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেলেন।

বিনি সানন্দা থেকে ফোটোটা বের করে একবার ভালো করে দেখল; তারপরে মুখ তুলে চারিদিকে দেখল, ঘরে কেউ নেই। আবার তাকাল ফোটোটার দিকে। আজ ফোটোটা কোন কথা বলল না আর। ফোটোটার উপর একবার ভালো করে হাত বুলিয়ে বিনি মার কাছে দিয়ে এল। বলল, ‘ওরা হয়ত এটা চেয়ে পাঠাতে পারে। ভালো করে রেখে দাও।’

সেদিন অনেক রান্না হয়েছিল বাড়িতে, কিন্তু সে রাতে কেউই ভালো করে খেতে পারল না। খাবার টেবিলে সবাই যেন কথা হারিয়েছে।

বর্ষা তখন শেষের দিকে, জ্যোৎস্না রাতে ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। বিনি জানালা খুলে শুয়ে শুয়ে মেঘের ভিতর চাঁদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক রাতে হঠাৎ বুকটা ব্যথীয়ে ওঠে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল চাঁদ তখন মেঘের আড়ালে তলিয়ে গেছে। ঘন মেঘে চারিদিক অন্ধকার। বিনি বুকটা চেপে ধরে উঠে বসল। মনে হল একটা সাধারণ ইচ্ছে পূরণের জন্যে এত অবমাননা! তাকে ভালো-লাগা বা না-লাগা, তার গায়ের রঙ, বা ওর বাবা কত টাকা দিতে পারবে তার উপর নির্ভর করছে। লেবু গাছের দিকে তাকিয়ে মনে হল কেউ যেন সেখান দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিনি তাড়াতাড়ি করে জানালাটা বন্ধ করে দিল।

কলেজে পড়ার সময় দু-একটা প্রেম নিবেদন সে যে পায় নি, তা নয়। তখন বাবা-মায়ের কথা শুনে মনকে শক্ত করে রেখেছিল। ঠিক করে ছিল, বাবা-মা অখুশী হয় এমন কিছু করবে না। আর আজকাল সেই মা জিজ্ঞেস করছে, ওর কাউকে ভালো লাগে কি না? মানে, ও প্রেম করে কি না? কানটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। বিনি উঠে জল খেল, তারপর শুয়ে পড়ল। মনে হল হাতের নাগালে যা কিছু আছে সব একটানে সব ছিঁড়ে ফেলে। বিনি ঘামতে লাগল। জানালা খুলে দিল। নৈরাশ্য, অবহেলা, অপমানে, একটা অচেনা দুঃখকে চেনার চেষ্টায় বিনির গা গুলিয়ে উঠল। সকাল হতে তখন কত দেরী তা ঠাওর করতে পারল না। ভাবল, একটু কেঁদে ফেললে অন্তত শরীরটা হালকা লাগবে। কিন্তু অভিমানের কান্না কাঁদার জন্যে অভিমান করার মত একজনকে মনের মধ্যে বসাতে হয়, তবেই সে কান্না বের হয়। সেই মানুষটাকেই তো এখনো খুঁজে পায় নি বিনি। কাঁদতেও পারল না। মনে হল ভোর হয়ে আসছে। পাশের বাড়িতে কেউ জেগে উঠল। বিনি আবার শুয়ে পড়ল।

সকালে উঠে বিনি চা নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবল, গতকাল কত কি হয়েছে তার কতটাই বা সবাই জানে। কিছু দুঃখ, কিছু ব্যথা না-হয় নিজের কাছেই থাক, অন্যেরা নাই বা জানল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9