।। তিন ।।
বিনির কলেজ পর্ব শেষ গেছে তখন। বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। বিনি বাচ্চাদের একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করে। তাতে তার সকালটা কেটে যায়। তারপর সারাদিন এটা-সেটা, আর অন্য ভালো চাকরি পাওয়ার চেষ্টা এবং তার প্রস্তুতি নিয়ে ওর দিন কাটে।
এদিকে বাড়ি থেকে বিনির বিয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিনির মা একদিন বিনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কি কাউকে ভালো লাগে? আমরা তাহলে তাদের বাড়ির লোকের সাথে কথা বলব।’ বিনি বলল, ‘সেরকম কেউ থাকলে তোমরা জানতেই পারতে, আমাকে জিজ্ঞেস করতে হত না।’ বিনির মা আর কোন কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন, ‘তোর বাবার কাছে কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে। এই কয়দিন রোদে ঘোরাঘুরি একটু কম করিস।’ এই বলে উনি সেইখান থেকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ আগে নতুন বর্ষার এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া একটু ঠাণ্ডা হয়েছে সেদিন। বিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল, আকাশে সব মেঘ উড়ে বেড়ায় কেবল বৃষ্টি হয়ে মাটির কাছে ধরা দেবে বলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের উপর বসে জানালা দিয়ে লেবু গাছটার দিকে তাকিয়ে একটা কাঠবিড়ালির ওঠানামা দেখতে দেখতে ভাবতে থাকল, রোদে না-ঘুরে যদি গায়ের রঙ বদলানো যেত তাহলেই বুঝি সব সমাধান হয়ে যেত।
তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে একটা সানন্দা টেনে পাতা ওলটাতে লাগল – ত্বকের সৌন্দর্য, মাথার চুল পরা বন্ধ, দিনের কখন কিভাবে কি প্রসাধনী ব্যবহার করতে হয়, ব্যক্তিগত চিঠি – ওলটাতে ওলটাতে একসময় বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পরে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। কালো মেঘগুলো ততক্ষণে জল ঝরিয়ে অনেক পাতলা হয়ে গেছে। সূর্যের আলো তার ফাঁক দিয়ে চকচকে ফলার মত হয়ে সোজা লেবু গাছের উপরে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিনির চোখের কোণে একটু ছলছলে হয়ে উঠল; এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে উপরে। কারো ঘরে ঢোকার পায়ের শব্দে বিনি উঠে বসল। বিনির মা দুই কাপ চা নিয়ে এসেছে। বিনি সানন্দাটা পাশে সরিয়ে রেখে মায়ের হাত থেকে একটা চাপের কাপ নিয়ে সোজা হয়ে বসল।
বিনির মা পাশে বসে চায়ে দু-এক চুমুক দিয়ে বললেন, ‘এবারের ছেলেটি বেশ ভালো, বেশ সম্ভ্রান্ত, অবস্থাপন্ন ঘর। তোর বাবা খুব আশায় আছে। তোর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে আগে থেকে বলে দে। এই সম্পর্কটা লেগে গেলে আমরা সকলেই খুব নিশ্চিন্ত হই।’ এই বলে চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা ফোটো নিয়ে এসে বিনির কাছে দিলেন। বললেন, ‘ভালো করে দেখে জানাস।’ এই বলে নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে ঘরের লাইটা জ্বেলে দিয়ে ঘর থেকে উনি বেড়িয়ে গেলেন।
বিনির পাশে তখন পরে রয়েছে ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের রঙিন ছবি। বিনি সেটাকে না-তুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মনে হল ফটোটা বলে উঠল, ‘আমাকে চিনতে পারছ না?’
বিনি মুখ তুলে চারিদিকে দেখল; ঘরে কেউ নেই। তারপরে ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক চিনতে পারছি না, তবে কেমন চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছে।’
ছবিটা বলল, ‘আমি তোমার সেই অনেক কালের পরিচিত। তোমাকে কবে থেকে শ্রাবণের কালো মেঘের মতো দেখছি। জল হয়ে একদিন আমার উপর ঝরে পড়বে বলেই আমি অপেক্ষা করে আছি।’
কোনো কথা না বলে বিনি ছবিটা তুলে নিল, একটু হাসল। ছবিটা বলল, ‘আমার নাম সূর্য। দেখলে না? কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে আমি কেমন তোমার কাছে চলে এসেছি?’
বিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সূর্যের আলো সরে গেছে। সন্ধের অন্ধকারে লেবু গাছটাকে তখন সাদা-কালোয় আঁকা একটা স্থির ছবির মত দেখাচ্ছে আর বাইরে মিটমিট করে কয়েকটা আলো জ্বলছে। ছবিটা বলল, ‘আমার দিকে ফের। বাইরে পাবে না আমাকে। আমি একান্তই তোমার।’ এমন সময় মাথার উপরে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করতে পারল। বিনির হাত থেকে ফোটোটা পরে গেল ওর কোলের উপরে। বিনি চমকে তাকিয়ে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। মা বললেন, ‘কিরে চা খাওয়া হয়নি এখনো?’ বিনি তাড়াতাড়ি করে ফোটোটা সানন্দার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা ওর মাকে দিল। উনি কিছু বললেন না, কাপটা নিয়ে চলে গেলেন।