Home » বড় গল্প » প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান

।। এক ।।

সকাল বেলায় র-চা দেখেই রমেনবাবুর মেজাজ গরম। গিন্নিকে বললেন, ‘আজও বুঝি দুধ আসে নি এখনো?’ গিন্নি ঝাজিয়ে উত্তর দিলেন, ‘দুধ এলে কি কোনদিন র-চা দিয়েছি তোমাকে?’ রমেনবাবু দু-তিনবার চায়ে চুমুক দিয়ে বাজারে বের হলেন। ভাবলেন, মোড়ের মাথার চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নেবেন।

বাজার সেরে রমেনবাবু যখন ফিরে এলেন সারা বাড়ি তখন থমথমে। সব কাজকর্ম বন্ধ করে গিন্নি বসে আছে। আর তার পেছনে কাজের মহিলা খুট-খাট ঠুক-ঠাক এটা-সেটা করছে। কারুর মুখে কোন কথা নেই। রমেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’

গিন্নি হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমার আহ্লাদে-আশকারায় মেয়ের এত বার বেড়েছে। এখন দ্যাখো, তার কাণ্ড।’ এই বলে, এক টুকরো কাগজ রমেনবাবুর হাতে দিলেন। তাতে কথা সামান্যই, তবে ব্যথা অনেক। মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

রমেনবাবু ধপ করে বসে পড়লেন। তারপরে বারান্দায় ঝোলানো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, সবাই মিলে ওনার সাথে মজা করছে – এপ্রিল ফুল করছে। রমেনবাবু উঠে মেয়ের ঘরে গেলেন; বিছানার চাদর সরিয়ে দেখলেন; বারান্দায় উঁকি মারলেন; আলমারি খুলে দেখলেন; ছাতে গেলেন; সব শেষে বাথরুমের সামনে গিয়ে ডাক দিলেন, ‘বিনি।’

গিন্নি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘মেয়ে যেন ওনার একারই, আদর দিয়ে মাথায় তোলার সময় কতবার বলেছিলাম। এখন কেমন সবার মুখে ঝাঁটা মেরে সে পালিয়ে গেল। এখন সামলাও। কি করে এখন আমি মুখ দেখাবো?’ বলেই আবার কাঁদতে শুরু করে দিলেন।

এদিকে রমেনবাবু তখনও খোঁজা চালিয়ে যাচ্ছেন – প্রথমে রান্নাঘর, তারপর চিলেকোঠা ঘর, খাটের তল, এমনকি নিজের বিছানা – সব খুঁজলেন। শেষে মেয়ের ঘরে গিয়ে মেয়ের একটা লেখার খাতা খুলে এই চিঠির হাতের লেখা মেলালেন। নোটটা আরও একবার পড়লেন, … তোমরা আমার বিয়ের জন্য আর চিন্তা কোরো না, আমি ভালো থাকব।

কাজের মহিলা বিনির ঘরে এসে ঘরটা গোছাতে লাগল। রমেনবাবু তখন একটা চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রয়েছেন, আর গিন্নি কাটা রেকর্ডের মত একই কথা বলে চলেছেন। এমন সময় বিনির দাদা, বিকাশ, বাড়িতে ঢুকে দুধের ক্যানটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম মনে হচ্ছে সেইটাই ঠিক। শঙ্কর বাড়িতে নেই। ওদের বাড়িতে কেউ কিছু বলতে পারল না।’

মায়ের চিৎকার চেঁচামিচিতে বিকাশ ঘুম থেকে উঠে চিৎকারের কারণটা জানতে পেরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘শঙ্কর কি আজ সকালে দুধ দিয়ে গেছে?’ তারপরে দুধের ক্যানটা নিয়ে গিয়েছিল শঙ্করের বাড়িতে।

রমেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিনি কি তাহলে শঙ্করের সাথে গেছে?’

বিকাশ বলল, ‘জানি না। তবে, আমার তাই মনে হয়। আমার বন্ধুরা বিনিকে মাঝে মাঝে রাস্তায় শঙ্করের সাথে দেখেছিল।’

রমেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে একটা কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘একটু ভালো করে খোঁজ নে তো যে শঙ্কর এখন কোথায় আছে? কাউকে কিছু বলিস না এখন।’

রমেনবাবুর মনে হল, এই সন্দেহটা অমূলক নয়। ওনার চোখেও পড়েছিল। বাড়িতেই দুজনকে কয়েকবার কথা বলতে দেখেছিলেন। আবার ভাবতে লাগলেন, তাই বলে শঙ্করকে পছন্দ হল বিনির। বিনির অর্ধেক বিদ্যেও নেই শঙ্করের পেটে, আর না আছে অর্থ। ছেলেটা দেখতেও সাদাসিধে।

পাশে গিন্নির ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে বিরক্ত হয়ে রমেনবাবু বললেন, ‘শোনো, এত কেঁদো না তো। মেয়ের কিছু হয় নি। আজেবাজে প্রচার যাতে না-হয় সেদিকে খেয়াল রেখে রান্না বসাও এখন।’ ইঙ্গিতটা কাজের লোকের দিকে। তারপরে বললেন, ‘দেখি আমি কি করতে পারি। প্রথমে জানা দরকার বিনি কোথায় আছে এবং কেমন আছে।’ তিনি বিকাশকে বললেন, ‘তোর ঠাণ্ডা মাথা দু-একজন বন্ধুকে সাথে রাখিস। বলা যায় না কোত্থেকে কি হয়ে যায়!’

গিন্নি বললেন, ‘তার মানে তুমি কি আরো খারাপ কিছুর কথা ভাবছ না কি?’

রমেনবাবু কোন উত্তর না-দিয়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে মেয়ের খাটে বসে অনেকক্ষণ দেওয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের দিকে তাকালেন। গিন্নি তখন চা নিয়ে এসে রমেনবাবুর পাশে বসলেন। রমেনবাবুর চোখের কোনার সাদা দাগগুলো নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বললেন, নাও, ‘এবার চা-টা খেয়ে নাও। সবই অদৃষ্ট। দেখি বিকাশ কি খবর নিয়ে আসে? মেয়েটার উপর দিয়েও তো কম যায় নি।’

রমেনবাবু আর পারলেন না। গিন্নির কাঁধের উপর মাথা রেখে এবার কেঁদে ফেললেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9