Home » বড় গল্প » বন্যা ত্রাণের অতিথি

বন্যা ত্রাণের অতিথি

।। সাত ।।

সেখান থেকে ফেরত এসে সবাইকে সুখবর জানালাম। মন থেকে মাঝির বাড়ির দৃশ্যটা সরিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করলাম। গ্রামের অনেকের সাথে কথাও বললাম। এই করে অনেকটা সময় চলে গেল। তারপরে একসময় হেডমাস্টারমশাই এসে বললেন, আপনারা সবাই তৈরি হয়ে নিন। নৌকা একটুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। বলা মাত্র আমরা কাঁধে ঝলা ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত।

আকাশে ঘন মেঘ। তবে বৃষ্টি নেই তখন। মনে হল বিকেল গড়িয়ে গেছে। আমাদের বোটটা নৌকার উপর তোলা হল। পাশের গ্রামগুলো থেকে বেশ কিছু লোক নৌকার মধ্যে রয়েছে। এই গ্রাম থেকেও বেশ কয়েকজন এবং আমরা সাতজন উঠলাম সেই নৌকায়। সামনে ছোট হাল, সেটা মাঝির বয়সী লোকটার নিয়ন্ত্রণে আর পেছনের বড় হালটা মাঝির। সারা গ্রামের লোক এলো আমাদের বিদায় জানাতে। অনেক ভালো ভালো কথা বলল এবং অনেক আশীর্বাদ করল আমাদের। গত বাইশ ঘণ্টায় কত কি দেখলাম, জানলাম। মনে হল, এইরকম বিপাকের মধ্যে না পড়লে আরও কয়েকদিন থাকলে ভালো হত। আমি এদের কাউকেই চিনি না, হয়ত আর কোনদিন আসবও না সেই গ্রামে। অথচ প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার সময় যেরকম দুঃখ হয় সেইরকম একটা দুঃখে মনের মধ্যে একটা অবসাদ চেপে বসল।

বাঁশের লগি ঠেলে নৌকা ছাড়ল। ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল। আমি অনেকক্ষণ সেই দ্বিপের মত গ্রামটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আকাশে মেঘ আরো ঘন হতে লাগল। ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়ল। তখন গ্রামটা আর দেখা গেল না – যেন কালো মত কিছু একটা রয়েছে সেখানে।

আমার বন্ধুরা সবাই গুম মেরে বসে আছে। ওদের মনের অবস্থা বুঝতে কোন অসুবিধে হল না। ওদের সাথে কথা না বাড়িয়ে, আমি গেলাম মাঝির কাছে। তখন সে এক অন্য ব্যক্তিত্ব। প্রচণ্ড দায়িত্বের সাথে হাল ধরে আছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে আর সবাইকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে সামনে যে ছোট হাল ধরে আছে, তাকে। আর মাঝির পায়ের কাছে একটা ছেলে মাঝির ছোট মেয়েটাকে একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে কোলের মধ্যে নিয়ে বসে আছে। মনে হল, এর বউ মরে গেছে কিন্তু এর প্রাণ ভোমরাটা সে রেখে গেছে – একে তো বাঁচতেই হবে।

আমি বললাম, চাচা অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের জন্যে যা করলেন তা কোনদিন ভুলব না।

উনি এর উত্তর দিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, ইটাহার থেকে যাবেন কি করে?

আমি বললাম, বিডিও অফিস থেকে নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করবে। যদি অফিস বন্ধ হয়ে যায় তাহলে, কোন বাস বা ট্রাকে ধরে চলে যাব। আর একদম কিছু না পেলে, রাতটা ওখানে বসে কাটিয়ে দেব। এইটুকু তো আসা গেল, তাই অনেক। বাকিটারও কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এই বলে আমি চলে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে ডাকল, শুনুন।

আমি বললাম, কি হল। বলুন।

মাঝি বলল, বিডিওর কাছ থেকে রিলিফের একটা ত্রিপল যোগার করে দিতে পারেন?

আমি বললাম, নিশ্চয় পারব। আপনি আমাদের এতদূর পৌঁছে দিলেন আর আমরা বললে উনি দেবেন না, তাই কখনো হয়। দরকার পড়লে চাপ দেব।

মাঝি বলল, আমার জন্যে না। সামনের হাল যে ধরে আছে ওর জন্যে। আমার কাছে থাকলে আমি চাইতাম না।

তখন ঘোর অন্ধকার। আকাশে ঘন মেঘ। চাঁদ তারার আলোটুকুও নেই। আমার মানস চোখে সত্যি এক জ্বলজ্বলে দেমাগি মানুষ দেখলাম। মনে হল, একি অহংকার না আত্মসম্মান বোধ? ওর অবস্থা তো নিজের চোখে দেখে এসেছি। ওর পায়ের কাছে নিজের মেয়ে অন্যের কোলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে – বড়জোর ছয় মাস বয়স হবে – এই জল বৃষ্টিতে বাঁচবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সেই লোকটা নিজের জন্যে চায় না। চায় তার বন্ধুর জন্যে।

আমি খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করা যাবে। বলে ওখান থেকে সরে পড়লাম।

শেষের দিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নৌকার মাঝখানে একটু খানেক মাথা গোঁজার মত জায়গায় ছিল। অনেকেই ছুটল সেই দিকে। আমি যেতে গিয়ে ভাবলাম, যারা আমাদের অনুরোধে এতটা কষ্ট করছে, এই অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে তারা তো সেখানে যেতে পারবে না। এই সুযোগে তাদের মত করে না হলেও, আমি আমার নিজের মত করে এই বৃষ্টিটা উপভোগ করি না কেন? প্রথম কয়েক মিনিটের পরে বৃষ্টির জল গা সওয়া হয়ে যায়। শেষের দিকে একটু ঠাণ্ডা লাগা ছাড়া বেশ ভালোই লেগেছিল। যারা ছাউনির নিচে গিয়েছিল তাদের অবস্থা আমার থেকে খুব একটা ভালো ছিল বলে তো মনে হল না।

সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েক লাগল আমাদের ইটাহার পৌছাতে। নেমেই সোজা চলে গেলাম বিডিওর অফিসে। আমাদের খুঁজতে যাওয়া হয় নি কেন – সেই নিয়ে প্রথমেই বেশ কিছু বাকবিতণ্ডা হল। বিডিও বললেন, স্পিড বোট নিয়ে আমাদের খুঁজতে দুইবার গিয়েছিল এমনকি যে গ্রামগুলোতে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেও গিয়েছিল। তারা কেউ আমাদের কোন হদিস দিতে পারে নি ইত্যাদি ইত্যাদি।

সত্য মিথ্যা যাচাই করে কোন লাভ হবে না দেখে, মাথা মোছার জন্যে তোয়ালে গোছের কিছু একটা চাইলাম। পাওয়াও গেল। তারপরে বললাম, হোস্টেলে ফেরত যাওয়ার জন্যে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেন। বিডিওর অফিসে কতগুলো কন্ট্রাক্টর গোছের মোসাহেব লোক বসে ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, স্যার আমি এখন রায়গঞ্জেই যাব, আমি ওনাদের হোস্টেলে পৌঁছে দেব।

এই ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পরে বিডিওকে বললাম, আপনি এই লোকটাকে একটা রিলিফের ত্রিপল দিন। বলে, পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে ওনাকে বললাম।

বিডিও বললেন, কাল সকালে আসতে বলেন। দেখব কি করা যায়।

তা নিয়ে আবার একপ্রস্ত চিৎকার চেঁচামিচি হয়ে গেল। বিডিও বললেন, আপনারা যত যাই বলেন আমি এখন সেটা করতে পারব না। কেন জানেন? দিন দশেক আগে, অনেকটা এইরকম এক ঘটনায় আমি নিজে গিয়ে গোডাউন খুলে ত্রিপল দেওয়ার পরের দিন সকালে লোকাল পেপারে বের হল যে আমি নাকি রাতের অন্ধকারে ত্রিপল পাচার করেছি। এই নিয়ে আমাকে এসডিওকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আমি জানি এদের দরকার। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। বলুন, রাতে এখানে শুয়ে থাকতে, কাল সকালে দেখব কি করা যায়।

বলব কি? সেই সামনের হাল ধরা চাচা তো আমদের পেছনেই দাঁড়িয়ে। সব শুনেছেন। বললেন, আপনারা সাবধানে যান। আমাদের নিয়ে ভাববেন না।

আমাদের তিন বন্ধুর কাছে সব মিলিয়ে বারো টাকা ছিল। অনেক পিড়াপিড়ি করে তার হাতে সেই কটা টাকা দিয়ে আমরা জিপে উঠে বসলাম। আর বললাম, কাল সকালে যদি ত্রিপল না পান, আপনি সোজা আমাদের হোস্টেলে চলে আসবেন, যেভাবে হোক একটা ব্যবস্থা করে দেব।

চাচা শুধু বললেন, আপনারা সাবধানে যাবেন, আমাদের নিয়ে ভাববেন না।

— শেষ —

Pages: 1 2 3 4 5 6 7