Home » বড় গল্প » বন্যা ত্রাণের অতিথি

বন্যা ত্রাণের অতিথি

।। দুই ।।

হোস্টেলে তখন বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেকেই বাড়ি চলে গেছে – যারা চলে গেছে তারা যতটা না বাড়ীর কোন দুঃসংবাদ পেয়ে তার চেয়ে বেশী নিজে ডুবে যেতে পারে – এই ভয়ে। কেউ কেউ আবার অর্ধেক পথ থেকে ফেরত এসেছে – বাস আর এগোতে পারে নি – দুই-এক দিন আগে বা হয়ত আগের রাতেই বন্যার জলে রাস্তা ভেঙ্গে ধুয়ে নিয়ে গেছে। সেখান দিয়ে তখন হুহু করে জল বইছে। এই সময়ে রাতের খাওয়ার পরে হোস্টেলের রান্নাঘরে বন্যা ত্রাণের জন্যে আমরা পালা করে প্রতি রাতে কয়েক হাজার রুটি তৈরি করতাম। প্রতিদিন সকালে দুই বা তিন খানা সরকারি গাড়ী আসত হোস্টেলে। সেই গাড়ি করে কলেজের টিচার, স্টাফ, ছাত্র এবং অন্য সরকারি অফিসের লোকজনদের কয়েকটা দল রুটিগুলো ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে যারা তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে বিলি করে আসত। এর মধ্যে পালা করে জনা দুয়েক হোস্টেলের ছাত্র থাকত সেই বিলি করার দলে।

সারাদিন কোন কাজকর্ম নেই, কলেজ প্রায় বন্ধের মত। আমরা সারাক্ষণ জল বাড়ার খবর নিচ্ছি, মাঝে মাঝে এদিকে সেদিকে জল দেখেতে যাচ্ছি, আর রোজ নিত্যনতুন গল্প শুনছি। অন্যের দুর্দশার কথা শুনলে দুঃখ হয়, আবার না শুনলে কৌতূহল মেটে না। তাই বিকেলের দিকে এরা ফিরে আসার পরে এদের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত যে কিছু একটা হয়েছে। চূড়ান্ত ক্লান্ত দেখাত – যতটা না যাত্রা কষ্টে তার চেয়ে অনেক বেশী মানসিক বিপর্যয়ে। ফেরার পরে অনেকেই প্রায় দুই-একদিন ঠিক মত করে কথা বলত না। প্রায় সকলেরই মোটামুটি দিন দুয়েক লাগত মানসিক ধকল থেকে বের হয়ে আসতে।

বন্যায় বাড়িঘর ডুবে গেছে, জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, সব ছেড়ে রাস্তার ধারে তাঁবুর মধ্যে অন্যের দয়ায় দিন কাটাচ্ছে, উপরে নিচে ডাইনে বাঁয়ে সর্বত্র জল আর জল অথচ খাওয়ার জল নেই, এই তো বন্যার দৃশ্য। তার মধ্যে জ্বরজ্বালা, আর নানান রকম অসুখ তো লেগেই আছে। যখন খাওয়ার জন্যে শুধু ভাত, ভেজা রুটি, অথবা এক গ্লাস পরিষ্কার জল পাওয়া যায় না, তখন জ্বর, পেট খারাপ – এইসবগুলোকে বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ মেনে নিয়েই জীবন কাটাতে হয়। এইসবেরও যে একটা প্রতিকার করার ব্যবস্থা আছে সে ভাবনার স্থান অন্তত হাইওয়ের ধারের তাবুতে নেই। একটুকরো শুকনো কাপড় সেখানে মহামূল্য। ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে যারা তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তারা গরীব হলেও তাদের আত্মসম্মান বোধ ছিল। তারা কেউ ভিখারি নয়, অথচ তখন ভিখারির থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারত না – এই আত্মসম্মান বোধ এবং খিদের জ্বালায় এরা প্রায় জীবন্মৃত।

এই সব দেখে এবং সেই সব মানুষের সাথে কথা বলার পরে একটা কুড়ি বছরের ছেলের মানসিক অবস্থা কি হতে পারে তা না দেখলে সেটা কল্পনা বা অনুমান করার ক্ষমতা অন্তত আমার ছিল না। একদিন নানু গিয়েছিল সেই স্বেচ্ছাসেবকের দলের সাথে রুটি বিলি করতে; ফেরত আসার পরে নানু সেই যে গুম মারল তো মারলই। আমরা অনেকেই লক্ষ্য করেছিলাম, ভেবেছিলাম কিছু একটা হয়েছে, দুই দিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। দিন তিনেক এইরকম যাওয়ার পরে ওর রুমমেট এসে বলল, নানুর মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে; ঘরের মধ্যেও সে কারুর সাথে কোন কথা বলছে না। সে সময়ে প্রেমে পড়া অথবা সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে বা ল্যাঙ খেয়ে বেরিয়ে আসা এক নিয়মিত ব্যাপার। আমরা ভাবলাম হয় সেরকম কিছু হয়েছে, অথবা ওর বাড়ীতে কোন সমস্যা হয়েছে। সে যাই হোক, এ নিয়ে কথা না বললেই নয়। বন্ধুর যেকোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের থেকে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই, সন্ধের পরে নানুকে নিয়ে কয়েকজন মিলে বসলাম। কিছুক্ষণ চাপাচাপি করার পরে নানু যা বলল তা শুনে আমাদেরও দিন দুয়েক কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন ত্রাণের রুটি বিলি করার সময়ে নানুদের দলে ড্রাইভার ছাড়া দুইজন ছিল জিপের ভিতরে আর নানু ছিল রাস্তায়। জিপের ভেতরের দুই জন চারটে করে রুটি আর তার উপরে কিছুটা করে গুড় ঢেলে নানুর হাতে দিত, আর নানু সেটা ওদের হাত থেকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের হাতে তুলে দিত। এইভাবে চলছিল রুটি বিলি করার কাজ। সরকারি গাড়ি তার কিছুক্ষণ আগে সেখানে বলে গেছে যে ত্রাণের রুটি নিতে হলে সবাইকে নিজের তাবুতে থেকে নিজেকে নিতে হবে। কেউ অন্যের হয়ে রুটি নিতে পারবে না। নানু বলল, সরকারি লোক নিজেদের কাজ করছিল, আমার এত দেখার সময় ছিল না কে নিচ্ছে বা নিচ্ছে না। বাচ্চা, বুড়ো, ছেলে, মেয়ে, সবাইকে পাইকারি হারে চারটে রুটি আর গুড়। জিপের দিকে হাত বাড়িয়ে রুটি নিচ্ছি আর সামনে যে হাত বাড়াচ্ছে তাকে দিয়ে যাচ্ছি। একজনের হাতে দিতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল যেন সে রুটিগুলো ধরতে পারল না। তাকিয়ে দেখলাম, দুইজন মাঝ বয়সী মহিলার মাঝখান দিয়ে একজন যেন পিছন ঘুরে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে আছে। হাতটা কোন মেয়ের সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। যে মহিলা দুইজন তাকে আড়াল করে রেখেছে তাদের ছেড়া শাড়ি জলে ভিজে যে অবস্থা, তাতে নামেই তাদের লজ্জা নিবারণ হয়েছিল। তাকিয়েই আমার মুখটা নিচু হয়ে গেল। কিন্তু রুটিগুলো যাতে ঠিকমত ধরতে পারে তাই আবার চোখ ফেরাতে হল সেদিকে। ততক্ষণে এই দুইজন মহিলা একটু সরে গেছে। রুটিটা ঠিক মত সেই বাড়ানো হাতে দিতে গিয়ে তাদের মাঝখান দিয়ে এক মুহূর্তে যা দেখলাম। বলে নানু চুপ। আমরা বুঝলাম নানু সাংঘাতিক কিছু দেখেছে। কিন্তু কি তা? মৃত কেউ বা অন্য কিছু? এইখানে এসে কি থামলে হয়?

আমাদের মধ্যে বসা, নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখার জন্যে যে সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে, সেই রণধীর বলল, কি দেখলি? সেইটে বল।

নানু বলল, পরিষ্কার দেখলাম সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটা মেয়ে তখন পেছন ঘুরে হাতটা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। আমি আস্তে করে চারটে রুটি ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।

এরপরে কথা খুঁজে পাওয়া সত্যি মুশকিল। খানিকক্ষণ আমরাও চুপ। সেটা আরো অস্বস্তিকর। নীরবতা ভাঙ্গার জন্যে আমি নানুকে বললাম, শুনেই আমাদের এই অবস্থা; তোর মধ্যে দিয়ে কি গেছে তা বুঝতেই পারছি। তাই বলে, তুই এইরকম হয়ে আছিস কেন? মেয়েটার এই অবস্থার জন্যে তুই তো দায়ী নস।

নানু বলল, আমি ওকে পুরো দেখতে পেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বয়স পঁচিশ মত হবে। মুখটা ঠিক দেখতে পাই নি, কিন্তু বাকি সব কিছু। কিছু ছিল না ওর শরীরে।

বুঝলাম, হয়ত জীবনে প্রথম উলঙ্গ মেয়ে দেখে কিংবা তার দুঃখে নানুর এই অবস্থা। আমরা যারা শুনছিলাম তাদেরও ওরই মত অবস্থা। দুঃখ না শিহরণ – তাই বুঝতে পারছিলাম না। রণধীর আমাকে চোখের ইশারায় বোঝাল, এগিয়ে যা, আমাদের উদ্দেশ্য নানুর এই অবস্থা থেকে ওকে বের করে আনা।

আমি বললাম, সব বুঝলাম, কিন্তু তোর কথাতে যেন মনে হচ্ছে এর জন্যে তুই নিজেকে দোষী ভাবছিস।

নানু প্রায় কান্না ধরা গলায় বলল, একদম ঠিক ধরেছিস। সেই চিন্তা থেকে আমি বের হতে পারছি না যে।

আমরা সকলেই ভাবছি, এ আবার কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা। তখন নানু বলল, একবার ভাবলাম, মেয়েটাকে গোটা কুড়ি রুটি দিয়ে দেই, যাতে ওকে এই অবস্থায় অন্তত আর কিছুদিন না পড়তে হয়।

আমরা প্রায় সমস্বরে বললাম, ঠিকই তো ভেবেছিলি। দিলি না কেন? কে তোকে আটকাত?

নানু বলল, আমি পরের রুটিটা নিতে দেরি করায় জিপের উপর থেকে ওরা প্রথমে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর ওই মহিলা দুইজনকে আর মেয়েটাকেও দেখেছিল। আমার মনে হল ওরা যেন ভাবছে আমি এই সব দেখার জন্যে ওদের হাত থেকে রুটি নিতে দেরি করেছি। পরের রুটিগুলো নিয়ে নিয়ম মত তারপরের লোকদের দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম। আর প্রতিবারই ভাবলাম ওরা যা ভাবে ভাবুক, বেশ কিছু রুটি নিয়ে ওই মেয়েটাকে দিয়ে আসি।

রণধীর বলল, একদম ঠিক ভেবেছিলি। সেইটেই তোর করা উচিত ছিল। তুই তো সরকারি লোক নস, আর এই রুটিগুলো আমাদের কলেজের আর হোস্টেলের টাকায় বানানো। তোকে সরকারি নিয়ম পুরপুরি মানতে হবে কে বলেছে?

নানু তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি যে কেন সেটা করলাম না, সেই জন্যেই আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না, রণধীর-দা। সারাক্ষণ ভাবছি, তাহলে হয়ত ওই মেয়েটা কিছুদিন খিদে আর লজ্জার হাত থেকে বাঁচত। কেন যে করলাম না? আমার নিজের বানানো লজ্জা ওই মেয়েটার লজ্জার থেকে বেশী হয়ে গেল সেই সময়ে! না হয় ভাবত, যে আমি একটা ন্যাংটো মেয়ে দেখার জন্যে ওর কাছে আবার গিয়েছিলাম – তাতে আমার কি আসে যায়? কেন যে করলাম না, রণধীর-দা।

এই বলে রণধীরের কোলে মাথা দিয়ে নানু কাঁদতে শুরু করে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7