Home » বড় গল্প » বন্যা ত্রাণের অতিথি

বন্যা ত্রাণের অতিথি

।। পাঁচ ।।

সকাল বেলায় যে চা মুড়ি দিতে এলো তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মাচায় তো কেউ শোয় রোজ রাতে, তারা কাল রাতে কোথায় ছিল?

সে আঙ্গুল দিয়ে পাকা বাড়ীর ছাদের কার্নিশের নিচের দিকে দেখিয়ে বলল, ওই দেওয়ালের পাশে বসে রাত কাটিয়ে দিয়েছে।

আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সারা রাত? রাতে তো বৃষ্টিও হয়েছিল!

সে বলল, এছাড়া এখানে আর কোন জায়গা নেই। না হলে, রাতে আব্বা কি আপনাদের এইখানে শুতে দিত?

রাতে খুব ভালো করে ঘুমের পরে শরীর ও মনে যে আমেজটা আসে এক মুহূর্তে সেটা উবে গেল। মনে হল, আমরা কি সত্যি এদের কোন উপকার করতে পারলাম!?

কিছুক্ষণ পরে সেই হেডমাস্টারের সাথে দেখা। আমি বললাম, আপনাদের কি বিপদের মধ্যেই না ফেললাম? তবে আপনি কি কোন উপায় বের করতে পারেন যাতে আমরা ফিরে যেতে পারি বা আমরা যে এখানে আটকে পড়েছি সেই খবরটা পৌঁছে দেওয়া যায় বিডিও-র অফিসে।

উনি বললেন, সেই চেষ্টাই করছি সকাল থেকে। তবে বিকেলের আগে কিছু হবে বলে মনে হয় না। আবার যেরকম মেঘ করেছে, বিকেলের দিকে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে যে কি করবো তাই ভাবছি।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, উপায়টা কি সেইটে একটু বলবেন।

তিনি যা বললেন মোটের উপর তা এই যে, পাশের গ্রামে যেখানে আমরা গতকাল রুটি দিতে গিয়েছিলাম সেখানে একটা বড় নৌকা আছে। যেটা নিয়েই কেবলমাত্র এতটা জলপথ পার হওয়া যায়। সেটা দু-তিন পরপর একবার করে যায় গ্রামের লোকদের হাইওয়ে ছাড়তে এবং সেখান থেকে লোক নিয়ে আসতে। এই নৌকা গতকাল অনেক রাতে ফিরেছে। এখন সে মাঝি কিছুতেই যাবে না। সে ছাড়া ওই নৌকার হাল অন্য কেউ ধরবে তাতে উনি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না।

হাল দিয়ে নৌকার দিক ঠিক রাখা হয় – তা বইয়ে পড়েছি এবং মহানন্দার উপর ভেসে যাওয়া অনেক নৌকা দেখছি। ভাবতাম, ওটা বেশ সুখের কাজ। আরাম করে বসে হাল ধরে থাক আর মাঝে মধ্যে এক-আধটু এদিক ওদিক নাড়িয়ে নৌকার দিকটাকে ঠিক রাখো। গতকাল আমাদের বোটের দিক ঠিক রাখতে আমাদের যে হাল হয়েছিল তারপরে নৌকার হাল ধরা যে কতটা শক্ত কাজ হতে পারে তার একটা আন্দাজ ততক্ষণে আমার হয়ে গেছে। তাই সে নিয়ে বেশী কথা বাড়ালাম না। তবে এই কথায় এইটুকু জানলাম যে এরা এই জলপথ পারাপার করতে পারে। অর্থাৎ, এমনটা ভাবা ঠিক নয় যে এদের কাছে কোন খাবার পৌছায় না। উনি আরো কিছু বললেন, তবে আমি এই চিন্তায় এত মগ্ন গিয়েছিলাম যে উনি আর যা বললেন আমার কানে ঢুকলেও মগজ অবধি পৌঁছল না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা যখন হাইওয়ে অবধি যেতে পারে তাহলে এরা এখানে পরে আছে কেন? কষ্ট তো এখানেও কিছু কম নয়। হাইওয়ের ধারে থাকলে অন্তত রিলিফের খাবার, ত্রিপল – এসব পেত। সেটা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে, কিন্তু কিছু তো পেত। এখানে তো কিছুই নেই।

বুঝলাম হয় উনি এই প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন অথবা এই প্রথমবার এই প্রশ্নের উত্তর উনি দিচ্ছেন না। একটু হেসে বললেন, এ অনেক জটিল ব্যাপার, তবে এইটুকু জানুন যে এই অবস্থায় এইটাই আমদের জন্যে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা।

আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বুঝলাম না। তার মানে?

উনি তখন মাস্টারমশাইয়ের ভঙ্গিতে বললেন, সবাই যদি হাইওয়ের ধারে গিয়ে থাকে, তাহলে গ্রাম রক্ষ্যা কে করবে?

আমি খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বললাম, তার মানে? সারা গ্রাম তো জলের তলে এই তিনটে বাড়ি ছাড়া।

উনি আরও ধীর গতিতে বললেন, এবার জল হঠাৎ করে আসে নি। তাই যে যার দামী জিনিস – যার যতটুকু আছে – সব এই তিন বাড়িতে এনে রেখেছে। চোর ডাকাতেরা সেই খবরও রাখে। তাই গ্রাম পাহারা না দিলে কি চলবে? আর হাইওয়ের ধারে গিয়ে না থাকলে রিলিফের কিছুই পাওয়া যাবে না। আমার কাছে যা আছে তাতে গোটা তিনেক পরিবারের বেশী খাওয়াতে পারব না।

শুনে আমার মাথা বোঁ বোঁ করতে লাগল। সবই দেখছি, শুনছি, কিন্তু কোনটাই যেন ঠিক বুঝতে পারছি না – কেবলই ভাবছি, এও সম্ভব এই পৃথিবীতে! চুরি ডাকাতি হয় এই অবস্থার মধ্যেও। তবে বুঝলাম, এই পরিবেশ আমার বোধের বাইরে। যেখানে অতিথিকে সত্যই নারায়ণ রূপে দ্যাখে, নিজেরা সারারাত বৃষ্টিতে বসে অযাচিত অচেনা অতিথিকে নিজের একমাত্র থাকার জায়গা ছেড়ে দিতে একটুও ভাবে না, সেইখানে চুরি ডাকাতিও হয়। এরপরে যদি আমাকে মানুষ কাকে বলে এবং তারা কয় প্রকার ও কি কি – এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, আমি কিছুই বলতে পারব না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7