।। ছয় ।।
হেডমাস্টারের সাথে কথা বলার পর থেকে সারা সকাল আমার মন একটা ক্লান্তিতে ভরে থাকল। নিজের মনে একটা করে প্রশ্ন করি আর বানিয়ে বানিয়ে তার একটা উত্তর তৈরি করি। খানিকক্ষণ সেইটা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করি। আবার আর একটা প্রশ্ন এসে হাজির হয়। অজানা অনেক কিছুই আছে – তাতে কোন ক্লান্তি আসে না বরঞ্চ জানবার আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু এতদিন যা জানি ভেবে এসেছি এখন দেখছি তার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। এই গরমিলটাই ভাবনার ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিচ্ছিল, আর তার থেকেই ক্লান্তি।
কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল তার খেয়াল রাখি নি। এর মধ্যে সুশান্ত আমাদের সরিয়ে রাখা রুটিগুলো একটা ছেলেকে দিয়ে বিলি করে দিতে বলল। কিছুটা হলেও নিজেদের অনুদার মনোভাব আড়াল করার জন্যে ও বলল, এই রুটিগুলো ব্যাগের মধ্যে থেকে গিয়েছিল, রাতের অন্ধকারে তখন বুঝতে পারি নি।
আগের রাতের মতই দুপুরেও বেশ ভালোই খেলাম। সকাল থেকে কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বিকেলে যে এ কি রূপ নেবে তার কোনরকম আন্দাজ করা অসম্ভব। এদিকে ফেরত যাওয়ার পাকাপাকি একটা উপায় বের না করা পর্যন্ত আমাদের সে নিয়ে উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে।
দুপুরে খাওয়ার পরে হেডমাস্টারের ছেলে এবং তার দুই বন্ধুর সাথে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা করে গেলাম সেই মাঝির বাড়ি। সেখানে পৌছিয়ে যা দেখলাম তাকে গোপাল ভাঁড়ের গল্পের দৃশ্য বলব না সার্কাসের মঞ্চ বলব তাই ভাবছি। মাঝির সারা বাড়ি জলের তলে। খানকয়েক বাঁশ জলের মধ্যে পুতে জল থেকে ফুট দুয়েক উঁচুতে একটা চৌকি বাঁশগুলোর সাথে বেঁধে একটা বিছানা বানিয়েছে সেই মাঝি। তার উপরে একদিকে তার বিছানা গুটিয়ে রাখা আর অন্য দিকে বসে সে একটা ভাঙ্গা উনুনে কয়েকটা আধা ভেজা কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে একটা কালো হয়ে যাওয়া অ্যালুমিনামের হাঁড়িতে ভাত ফোটানোর চেষ্টা করছে। সে উনুনে আগুনের থেকে ধোঁয়াই বেশী। অন্য পাশে আরেকটি বিছানার ব্যবস্থা। একটা চটের ছালার চারটে কোনা চারটে বাঁশের সাথে বেঁধে তার মধ্যে একটা ছোট্ট শিশুকে শুইয়ে রেখেছে। তার গায়ে নাম মাত্র একটা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। আর এই গোটা ব্যবস্থার উপরে খান কয়েক ছেড়া ত্রিপল সেলাই করে ছাউনি দিয়ে রাখা। এই হল সেই মাঝির বাড়ি।
আমাদেরকে মাঝির বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় হেডমাস্টারের ছেলে বারবার করে সাবধান করে দিয়েছিল যে চাচা খুব বদমেজাজি লোক। আপনারা কোন কথা বলবেন না। আমার বাবাকে ছাড়া ও কাউকে পাত্তা দেয় না। মাঝির বাড়ীর এই ব্যবস্থা দেখে তাকে অর্ধ-পাগল বললে একটু বেশী ভালো বলা হয় বলে আমার মনে হল। মাঝি লোকটি খুব গম্ভীর। কিছু বললে তাকায় না এবং উত্তরও দেয় না; উত্তর দিলেও তা মিনিট দুয়েক পরে। হেডমাস্টারের ছেলে অনেক করে বলল কিন্তু কোন পাকাপাকি উত্তর পাওয়া গেল না তার কাছ থেকে। আমাদের দিকে দেখিয়ে ও আরও বলল, এনারা কাল রাতে এখানে রুটি দিতে এসেছিলেন, আমাদের সবাইকে কাল রুটি খাইয়েছে, তোমার গ্রামেও দিয়েছে। তিনি কি বুঝলেন কে জানে। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শহরের লোকদের গ্রামে আসার কি দরকার এই বানের সময়ে? আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। হেডমাস্টারের ছেলে নিজের ঠোটের উপর আঙ্গুল চেপে আমাকে ইশারা করল চুপ করে থাকতে। অবশেষে মাঝি কয়েকজনের নাম বলে বলল যদি তারা যায় তবেই সে নৌকা নিয়ে যাবে। আর বিশেষ একজন ছাড়া সে একা ওই নৌকার দায়িত্ব নিতে পারবে না।
অতএব এবার চলো তাদের কাছে। দেখলাম, সেই বিশেষ একজন মাঝিরই বয়সী, আর বাকিরা সব কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলেছোকরা। এদের রাজি করাতে কোন বেগ পেতে হল না। তারপরে মাঝিকে সেই খবর দিয়ে আমরা ফেরত এলাম। মনটা তখন বেশ হালকা লাগছিল, কিন্তু মাথা থকে মাঝির বাড়ীর ওই দৃশ্য কিছুতেই যাচ্ছিল না। শেষে না পেরে আমি হেডমাস্টারের ছেলেকে মাঝির এই রকম ভাবে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, চাচার অনেক জমি আছে। আব্বা ওকে বলেছিল, আর দেরি করোনা এই বছর, ফসল তুলে নেও। কথা শোনে নি। তিস্তা বাঁধের জল ছাড়তেই পরের দিন আমাদের গ্রামে জল চলে এলো। তখন সবাই ঘর বাঁচাবে না জমির ফসল তুলবে। আর কয়েকদিনের মধ্যে গোটা গ্রামটাই জলের তলে চলে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেটা বুঝলাম; কিন্তু ও ওখানে ওইভাবে থাকে কেন? হেডমাস্টারের ছেলে বলল, চাচার খুব দেমাগ। পেস্টিজ, বুঝলেন না। আব্বা, আরও কত লোক ওকে বলেছে আমাদের সাথে থাকতে। কিন্তু চাচার দেমাগের জন্যে আমাদের সাথে থাকবে না। ওর নিজের জমিতে কেমন মাচা বানিয়েছে দেখলেন না।
বুঝলাম, আত্মসম্মান বোধটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অনুভূতি। একে সার্বজনীন মাপকাঠিতে মাপা আমার কম্ম নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ওই যে বাচ্চাটাকে শুইয়ে রেখেছিল। সেটা কি ব্যাপার? হেডমাস্টারের ছেলে বলল, চাচার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ওরা সবাই ছোট, ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে থাকে এখন। এখানে জায়গা নাই তো, তাই। চাচির অনেকদিন ধরে জ্বর ছিল। যেদিন চাচার বাড়ীতে দরজার উপর অবধি জল উঠল সেইদিন চাচিকে নিয়ে ম্যাটাডোরে করে রায়গঞ্জ হসপিটালে নিয়ে গেল। তারপরের দিন চাচি মরে গেল। তারপর থেকে চাচা ছোট মেয়েটাকে কারুর কাছে ছাড়ে না। আমার আম্মা অনেকবার বলেছে, মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে যাও জল না কমা পর্যন্ত। কিন্তু বললাম না, চাচার দেমাগ। ওর থেকে আমাদের বেশী জমি আছে। আর আব্বা সব ফসল ঠিক সমেয়ে তুলে নিয়েছে। তাই আমাদের উপর চাচার খুব রাগ।
কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা যে একটা বড় নৌকার কথা বলছিলেন, সেইটে কার? হেডমাস্টারের ছেলে বলল, নৌকাটা চাচার। চাচার অবস্থা ভাল। অনেক জমি আছে। মাঝে মাঝে ওই নৌকা করে চাচা কালিন্দীতে মাছ ধরত। কখনও চাচি আর ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুরতেও যেত। এমনিতেই সব সময় খুব দেমাগ তার উপর চাচি মরে গিয়ে চাচার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ভাবলাম, মাথার আর কি দোষ? বাড়িঘর, ধনসম্পত্তি, বউ সব এক বন্যার জলে চলে গেলে, শুধু মাথা কেন, কোন কিছুই কি ঠিক থাকে?