Home » বড় গল্প » বন্যা ত্রাণের অতিথি

বন্যা ত্রাণের অতিথি

।। চার ।।

গ্রামটার কাছাকাছি পৌছাতেই দেখা গেল জলের ধারে লোকের ভিড় জমছে, বেশ একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সিভিল ডিফেন্সের একজন আমাদের বলল, আপনারা দুম করে খাবার বের করবেন না, মারামারি লেগে যাবে তাতে। ওখানে উঠে সবার সাথে কথা বলে তারপর যা করার করবেন। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ডাঙ্গার কাছে আসতেই কয়েকটা ছেলে জলে নেমে এলো। বোট থেকে দড়িটা ছুড়ে দিতে তারা দড়িটা ধরে আমাদের বোটটা টেনে প্যাচপ্যাচে কাদার ডাঙ্গায় তুলে নিয়ে গেল। সেখানে নামা মাত্র সবার নানান প্রশ্ন। এক প্রবীণ ব্যক্তি সবাইকে থামিয়ে, আমারা কারা, কি করতে সেখানে এসেছি ইত্যাদি সব জিজ্ঞেস করলেন। সিভিল ডিফেন্সের একজন তাঁকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে পুরো ঘটনাটা বুঝিয়ে বললেন; শুধু খাবারের বিষয়টা বাদ দিয়ে।

তারপর সেই প্রবীণ ব্যক্তি আমাদের নিয়ে গেলেন অন্য একজনের কাছে। আমাদের হয়ে তিনিই তাঁকে সব বললেন। জানলাম সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি সেই গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। তাঁকে আমি তখন বললাম, আমরা কলেজের ছাত্র, হোস্টেলে থাকি। আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরই তৈরি রুটি আর গুড় এই রকম প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে সরকারি সাহায্য পৌঁছায় না সেইখানে বিতরণ করা। আমরা আর কি বা করতে পারি? এই দুর্দিনের সময় যতটুকু পারি তারই চেষ্টা। আর বাকিটা তো আপনি আগেই শুনলেন।

হেডমাস্টারমশাই বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের রুটি গুড় কি বোটেই আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। অমনি চারিদিকে একটা গুঞ্জন শুরু হল। উনি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে দুইজনকে ডেকে বললেন, তোরা এনাদের সাথে গিয়ে এনাদের সব জিনিস পত্র এখানে নিয়ে আয়। তারপরে কয়েকজনকে ডেকে উনি কি সব বলে অন্য দিকে চলে গেলেন।

বোট থেকে রুটি গুড় আর আমাদের ঝোলা ব্যাগ সব এলো। গ্রামের সব লোকজন দুটো লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুশান্ত আমাকে ফিসফিস করে বলল, তুই আমাদের খাওয়ার মত কিছু সরিয়ে রেখে তারপরে বিলি করিস। না হলে, রাতে খাবো কি? খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা, সারাদিন কেউ কিছু খাই নি। নিজেদের জন্যে গোটা তিরিশেক রুটি আর গুড় একটা ঝোলা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে, সবাইকে মাথাপিছু ছয়টা করে রুটি দিয়েও বেশ কিছু থেকে গেল। তখন ঠিক হল পাশের এক গ্রামে গিয়ে বাকি রুটিগুলো বিলি করতে যাব। এই সময় গ্রামের একজন বললেন, আপনারা ওই কাঁদায় চটি পরে যেতে পারবেন না; চটি কাঁদায় ডুবে যাবে, অন্ধকারে খুঁজেও পাবেন না। তখন আমাদের যা অবস্থা, চটি বা কি আর খালি পা-ই বা কি। চটি ছেড়ে খালি পায়েই গেলাম এবং একটু খানেক গিয়েই লোকটার কথার যথার্থতা পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। রুটি বিলি করে ফিরে এসে দেখি আমাদের চটিগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা আর সিভিল ডিফেন্সের লোক দুইজন এবং আমাদের অতিথি দুইজন বসে চা খাচ্ছেন। আমরা আসতেই একজন আমাদের এক বালতি জল আর গামছা এনে দিল। হাত-পা ধুতে না ধুতেই আমাদের জন্যে চা হাজির।

তখন পুরো অন্ধকার, আকাশে ঘন মেঘ। আলো বলতে আশেপাশে কয়েকটা হ্যারিকেন আর দু-তিন খানা কুপির আলো। তারই মধ্যে যা বুঝলাম তা হল, পাশে একটা বড় বাড়ি – সেটা ওই হেডমাস্টারের বাড়ি – কিছুটা ইটের দেওয়াল আর বাকিটা মাটির, আশেপাশে গোটা দুয়েক মাটির বাড়ি আছে এই দ্বিপের মত গ্রামটাতে। গ্রামের এই অংশটা সবচেয়ে উঁচু, তাই সবাই এইখানে এসে জমা হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটা বাঁশের মাচান বেঁধে তার উপর খড়ের ছাউনি দেওয়া হয়েছে। সেইসব মাচানের উপরে লোকজন থাকে। কথা বলে জানলাম, এই গ্রামের বেশির ভাগ লোকই ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে থাকে, আর যারা গ্রামে আছে, হয় তাদের সেখানে স্থান সঙ্কুলান হয় নি নতুবা গ্রাম পাহারা দেওয়ার জন্যে সেখানে আছে।

আমাদের বসতে দেওয়া হল বড় সাইজের মাচানের উপরে। দেখতে তেমন বাহারি না হলেও ওতে বশে বেশ আরাম। বাঁশের বাত্যা দিয়ে প্লাটফরমটা বানানো, তার উপর পুরু করে খড়ের গদি, চটের ছালা এবং সবার উপরে বিছানার চাদর। চাদরগুলো যে তখনি পাতা হয়েছে পরিষ্কার বোঝা যায় তার ভাজের দাগ দেখে। ভালো করে হাত-পা ধুয়ে সেখানে বসে একটাই আলোচনা কি করে কাল সকালে ফেরত যাওয়া যায়। আর বাকিটা অনুমান করা, যে হোস্টেলে না ফেরায় তখন কি কি হতে পারে। ভয় একটাই যে বাড়ি অবধি খবরটা পৌঁছে গেলে বাড়ীর লোক সঙ্গত কারণে দুশ্চিন্তা করবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম যে সেই হেডমাস্টারের বাড়ীর দিক থেকে কয়েকজন আসছে আমাদের মাচার দিকে, সাথে দুইখানা হ্যারিকেন। তারপরের মুহূর্তে যা হল তা এইরকম। মাচায় আংটা লাগিয়ে হ্যারিকেনগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে তার আলো বাড়িয়ে দিল। একটি ছেলে মাচার উপরে উঠে প্রথমে একখানা চৌকো মত ধপধপে সাদা চাদর পেতে আমাদের গরম গরম তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত, ডাল এবং মুরগির মাংস পরিবেশন করে খাওয়াল। নিচে কাঁদায় প্যাচপ্যাচ করছে, বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। যারা মাচার নিচে ভাতের হাঁড়ি, ডালের বাটি, মাংসের গামলা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আমাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা অল্পস্বল্প ভিজল। চারিদিকে দুর্দশার অন্ত নেই। এরা যে দুবেলা খাবার পায় না সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। সেখানে আমরা হলাম কিনা তাদের অতিথি।

আতিথেয়তার অবমাননা করা সেই মুহূর্তে শুধু অশোভন নয়, রীতিমত অন্যায় হত। তাই বিশেষ কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করলাম। বিস্ময়ে আমাদের কথাও হারিয়ে গেছে তখন। সম্ভাব্য মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দূরত্বে থাকলে, গায়ে ব্যথা, মাথা ধরা, খিদে পাওয়া – এইগুলো হয় না। আমি ভাবছি, এও কি সম্ভব! গৃহস্থ ছেলেটি জানালো, আব্বা খুব দুঃখিত যে এর বেশী আর কিছু খাওয়াতে পারলেন না এই রাতে। ঘরে আর কিছুই নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই ভালো চাল আর মুরগি কোথায় পেলে? সে জানালো, বান আসার আগেই তারা জমির ধান তুলে ফেলেছিল, আর মুরগিটা তাদের পোষা। সে তো রাতের খাওয়া নয় – সে এক অমৃতাহার। আমাদের খওয়া শেষ হতেই বালিশ, চাদর, কাঁথা ও লেপ নিয়ে এসে হাজির। বলল, আব্বা খুব দুঃখিত যে আপনাদের ঘরের মধ্যে শুতে দিতে পারলেন না। সেখানে গ্রামের মহিলারা সব আছেন। চমকের আরো যে কি বাকি আছে ভাবতে ভাবতেই লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7