।। তিন ।।
বন্যা ত্রাণ বিলি করে ফেরত আসা ছেলেদের কাছে যখন মানুষের দুর্দশার কথা শুনে আমদের কারুরই সবার সামনেই চোখের জল মুছতে কোন লজ্জা হত না। বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে সবার প্রায় একই কথা – এই ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে যারা আছে তাদের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে ভালো, আর যারা জলে আটকে আছে তাদের অন্য কিছু তো বাদই দাও, সেখানে কেউ খাবারও দিতে যায় না।
এই এক কথা শুনতে শুনতে একদিন ঠিক করলাম, আমরা আলাদা করে সেইসব গ্রামগুলোতে যাব। ওইসব অঞ্চলের কয়েকজন ছেলেদের কাছ থেকে গ্রামগুলোর বিবরণ এবং সেই বন্যার মধ্যে সেখানে কিভাবে যাওয়া যেতে পারে তার বিশদ বিবরণ জেনে এক সকালে হাজার খানেক রুটি নিয়ে রওনা দিলাম। প্রথমে বাসে করে ইটাহার বিডিও-র অফিস। বিডিও লোকটি একজন যুবক গোছের। হয়ত আমাদের ভিড় এড়ানোর জন্যে বা আমাদের উৎসাহে খুশি হয়ে আমাদের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলতে এবং হোস্টেলের কাগজপত্র দেখাতে তিনি দুই জন সিভিল ডিফেন্সের লোক আর একটা লাইফবোট দিলেন।
আমরা যখন বোটে উঠতে যাব, অচেনা দুইজন ভদ্রলোক আমাদের খুব অনুনয়-বিনয় করে বললেন, জলপথে আমাদের রাস্তাতে একটা গ্রাম পড়বে – ওনাদের সেখানে নামিয়ে দিতে। তা না হলে ওনাদের সেখানে যাওয়ার কোন সহজ উপায় নেই। সিভিল ডিফেন্সের লোক দুজন প্রথমে আপত্তি করলেও, আমাদের চাপাচাপিতে মেনে নিলো শেষকালে। আমরা তিন বন্ধু, সিভিল ডিফেন্সের দুইজন আর দুই অচেনা লোক বোটে চরলাম। মোটরের দড়ি টেনে মোটর স্টার্ট করে মিনিট পঁচিশের মধ্যেই আমরা প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে এলাম। অচেনা দুই ভদ্রলোক বারবার করে আমাদের ধন্যবাদ জানালেন যে আমরা ওনাদের না নিলে তাদের অনেক ঘুর পথে সেখানে যেতে সন্ধে হয়ে যেত, হয়ত আজ নাও পৌছাতে পারতেন। সিভিল ডিফেন্সের লোক দুজনের বিভিন্নরকম অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে আমরা ভালোই যাচ্ছিলাম। এমন সময় ঘর ঘর করে লাইফবোটের মোটরটা গেল বন্ধ হয়ে।
সাতজন মিলে পালা করে প্রায় ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করেও সেটাকে কিছুতেই চালানো গেল না। মোটরের দড়ি টেনে টেনে সবার হাত ব্যথা। সিভিল ডিফেন্সের দুইজন বলল, এই অবস্থায় ওই গ্রামে আর যাওয়া যাবে না, বৈঠা বেয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে যাওয়া যাক। তারপরে দেখা যাবে কি করা যায়। সেখান দিয়ে অনবরত অফিসের গাড়ি যায় – তাদের মারফত একটা খবর দিলে বাকি সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিতর্কও হল। বিশেষ করে সেই দুই অতিথি – তাদের বক্তব্য সেইখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ের প্রায় সমান দূরত্বেই ওদের গ্রাম। বৈঠা বেয়ে সেই দিকেই বা না যাওয়া কেন। তাহলে আমাদের সাথে এসে তাদের কি লাভ হল? মাঝখান থেকে তাদের সময় নষ্ট হল। মনে মনে ভাবলাম, একটু আগে কত ধন্যবাদ, ওনাদের ওখানে একটু চা না খেলে চলবেই না, আর এখন আমরাই তাদের সময় নষ্টের কারণ হয়ে গেলাম। সিভিল ডিফেন্সের দুইজনের একই গোঁ – তারা ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকেই যাবে। সবাই মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হলেও এছাড়া আর কোন উপায় নেই, ওনাদের কথায় যুক্তি আছে। অবশেষে ঠিক হল, তাই চলো।
সবাই এমনভাবে বসলাম যাতে বোটে দুইদিকের ভার সমান থাকে। চারিদিকে জল আর জল। অনেকটা মাঝ সমুদ্রের মত – তফাত হল, মাঝে মাঝে গাছের মাথাগুলো জলের উপরে জেগে আছে, তার থেকে জলের গভীরতা কিছুটা অনুমান করা যায়। তখন অল্প ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আর সকালের নিস্তেজ রোদ মেঘের ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। একদিকে অনেকটা দূরে ন্যাশনাল হাইওয়ে অন্য দিকে বহু দূরে দ্বিপের মত কয়েকটা গ্রাম – যার কোন একটার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হয়েছিলাম। সিভিল ডিফেন্সের দুইজন বেশ কিছুক্ষণ বৈঠা টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আমরাও পালা করে বৈঠা চালানোর চেষ্টা করলাম। তাতে উপকারের থেকে অপকারই বেশী হল। সবাই যখন চূড়ান্ত ক্লান্ত হয়ে একটু থেমেছি তখন দেখা গেল আমরা যেইখান থেকে বৈঠা বাওয়া শুরু করেছিলাম ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে যাওয়ার জন্যে তার থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। বাতাস এবং জলের স্রোত আমাদের ঠিক উল্টো দিকে বইছে।
এত শত কাজ করার একটা সুফল ছিল, ততক্ষণে আমরা নিজেদের ক্ষমতার পরিমাপ বুঝে গিয়েছিলাম। সুতরাং কম বিতর্কেই পরের সিদ্ধান্তে আসা গেল এবার। ঠিক হল, বোটটা একটা গাছের সাথে বেঁধে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবদিক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তার মধ্যে যদি অন্য কোন বোট কোন কারণে আশপাশ দিয়ে যায় তাহলে তো সব সমস্যাই মিটে যাবে।
অনেক কায়দাবাজি করে বোটটা একটা গাছের সাথে বাঁধা হল। ঠিক সেই মুহূর্তেই সিভিল ডিফেন্সের একজন একটা পরিত্রাহি চিৎকার করেই গোঙাতে শুরু করলেন। তার হাতের ইশারা বরাবর চোখ নিয়ে দেখি গাছের উপরের দিকে গোটা তিনেক সাপ সেই গাছের একটা ডাল জড়িয়ে ঝিমচ্ছে। কেউ একটা কিছু বলতে শুরু করেছিল। সিভিল ডিফেন্সের লোকটা গোঙাতে গোঙাতেই বলল, আপনারা যদি বোট না ছাড়েন, আমি জলে ঝাপ দেব। বলেই, বোটের এক ধারে চলে গেল। একজন তাড়াতাড়ি দড়িটা আলগা করতেই জলের টানে বোট আবার এগোতে শুরু করল। তিনি তখনও গোঙাচ্ছেন, কথা জড়ানো। লোকটি এমনিতে ভালো, তবে তার প্রায় সব কথায় ‘আমাদের কলকাতায়’ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশী ব্যবহার করতেন। এই সুযোগে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের কলকাতায় আপনি কি সাপুড়িয়ার সাপ খেলাও দেখেন নি কোনদিন? তিনি কি বুঝলেন তিনিই জানেন। আমাকে বললেন, দেখুন সাপ নিয়ে আমাকে ভয় দেখাবেন না।
ঠিক হল, ন্যাশনাল হাইওয়ে নয়, জল আর বাতাসের দিকে একটু কোনাকুনি ভাবে বৈঠা বাইলে ওই গ্রামগুলোর কোন একটাতে পৌঁছানো যাবে। সেইগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে কাছের বলে মনে হল সেইটের দিকে যাওয়া শুরু হল এবার। জলের স্রোতের অনেকটা অনুকূলে যাওয়ার জন্যে তেমন বেগ পেতে হল না। বোট তখন ভালোই এগোচ্ছিল – আমরা চেষ্টা করছি যাতে জলের স্রোতের সাথে কোনাকুনি ভাবে এগোনো যায়। ওদিকে সুযোগ পেলেই আমাদের অতিথি দুইজন তাদের আক্ষেপ শুনিয়ে যাচ্ছেন। বোট থামিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার কথা অনেকবার উঠেছিল। কিন্তু সিভিল ডিফেন্সের লোকটার আপত্তিতে সেটা আর করা হয় নি। একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল – আকাশে মেঘ থাকায় বেলা বোঝার কোন উপায় নেই। কারুরই আর এত শক্তি নেই যে জোরে বৈঠা চালিয়ে তাড়াতাড়ি বোট চালাবে। জলের স্রোতের উপরেই ভরসা করে চলছি। তার মধ্যেও দেখলাম কোন জায়গাটা আসলে রাস্তা, কোনটা জমি, কোথায় পুকুর – জলে ডুবে গেলেও বেশ বুঝতে পারা যায় – জলের রঙ দেখে, গাছের মাথা দেখে – সে যেন এক মজার আবিষ্কার।
তখন আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। কিন্তু যে দ্বীপের মত গজিয়ে থাকা গ্রামটার উদ্দেশ্যে আমরা যাচ্ছিলাম সে দিকে আর যাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক যে কারণে প্রথম চেষ্টায় ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে যাওয়া যায় নি। কখন হাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে আমরা কেউ বুঝতে পারি নি। এবার অন্য একটা লক্ষ ঠিক হল – অন্য একটা গ্রাম। সারা আকাশে মেঘ ঘন হয়ে আসছে। হাতে কারুর ঘড়ি নেই – আর থাকলেও কোন লাভ হত না – কটা বাজে জেনে কি হবে। সূর্যের আলো যেন তখন হঠাৎ করেই কমতে শুরু করল। এর আগে পর্যন্ত সবার দুশ্চিন্তা থাকলেও প্রাণ ভয় কারো তেমন ছিল বলে অন্তত আমার মনে হয় না। তখন আর হাতে বেশী সময় নেই। সবাই উঠে পরে লাগলাম বৈঠা বাইতে – কিন্তু সেতো মাত্র দুইখানা। উত্তেজনায় আমরা হাত দিয়েই জল কাটতে লাগলাম – যতটুকু হয়, তাই সই। আর সবার দৃষ্টি সজাগ – কোনমতেই এই পরের গ্রামটা ফস্কানো যাবে না। ততক্ষণে আমাদের এইটুকু বোঝা হয়ে গেছে যে – জল বা বাতাসের সাথে পাল্লা দেওয়ার মত ক্ষমতা আমাদের নেই, হাতে বেশী সময়ও নেই এবং গায়ের জোর আর বেশিক্ষণ থাকবে না। সুতরাং প্রতিটি মুহূর্ত, বৈঠার প্রতিটি চাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালে তাল মিলিয়ে চলা – জলের স্রোতের সাথে তাল, বাতাসের জোরের সাথে তাল, নিজেদের মধ্যে তাল – প্রাণে বাঁচার তাগিদে সবার সাথে তাল মিলিয়ে এক একমুখী প্রচেষ্টা।
সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে তখন, গ্রামটার বেশ কাছাকাছি এসে গেছি। আর একটু পরেই পৌঁছে যাব – এবার আর সেটা ফস্কানোর কোন সুযোগ রাখি নি আমরা – তবু হাওয়ার ভাবগতিকের উপর কোন ভরসা করা যায় না। তাই পুরো সতর্কতার সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা বৈঠা বাইছি। হঠাৎ পেছন থেকে সুশান্ত বলল, জীবনানন্দও নিশ্চয় এই রকম কোন বিপদে পড়েছিলেন। না হলে, বনলতা বুড়িটাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ওইটা কেন বললেন? আমি বললাম, কোনটা? বলেই, বুঝতে পারলাম ও কি মনে করতে চেষ্টা করছে, বললাম – ‘হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’? সুশান্ত বলল, হ্যাঁ ওই লাইনটার কথাই ভাবছিলাম। বলতে যাচ্ছিলাম, তোকে তো কাঠখোট্টা তিন কাঠি বলেই চিরকাল জানি, এই এসময়ে এই কথা মনে এলো তোর! কিন্তু মুখ থেকে আমার কিছু বের হল না। কেমন যেন একটা ভালো লাগল – একটা অকারণ ভালো লাগা – কাকে ভালো লাগল বা কি ভালো লাগল তা জানি না – হয়ত সুশান্তকে, হয়ত নিজেকে, হয়ত পরিস্থিতিকে, হয়ত ‘সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর’ – তাকে। সত্যিকারের মৃত্যু ভয়ের খুব কম দূরত্বে মানুষের বুদ্ধিভ্রম হয় শুনেছিলাম, কিন্তু তার যে এইরকম একটা দিকও হতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। বুকের ভিতর আটকে থাকা বাতাসটা বের হয়ে গেল – বেশ হালকা লাগল নিজেকে। আবার একটু বিরক্ত হলাম যে বনলতা সেন বলে অন্তত গোটা দশকে অনুষ্ঠান করেছি বা দেখেছি – তাকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে সুচিত্রা সেন গোছের কাউকেই আঁকতাম – মনে মনে এবং পোস্টারে। এই তিন কাঠি ওকে বুড়ি বানিয়ে ফেলল।