Home » ছোট গল্প » প্রেম-পর্ব » প্রতিযোগিতা

প্রতিযোগিতা

।। এক ।।

শীতের দুপুরে কলেজের মাঠে বসে চীনেবাদামের খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্যে যারা ক্লাস ফাঁকি দেয় অপর্ণা তাদের কখনো ভালো বলে মেনে নিতে পারে নি। অপর্ণার মতে, এইসব বখাটে ছেলেমেয়েদের জীবনে কিসসু হবে না। তাই অপর্ণা সচরাচর এইসব ছেলেমেয়েদের এড়িয়ে চলত। অপর্ণার চিন্তাধারায় ক্যারিয়ার বানানোর জন্যে প্রথম কাজ হল মন দিয়ে প্রফেসারদের ক্লাস ফলো করে যাওয়া। আর এইরকম মনোভাবাপন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে অপর্ণা একটা দল বানিয়ে ফেলেছিল, যারা রোজ নিয়মিত ক্লাস করে, আর প্রফেসার যা যা বলে খাতায় তারা হুবহু তাই লিখে ফেলে।

কলেজে সবাই যে যার মত বন্ধু গোষ্ঠী বানিয়ে চলে। যারা রোজ নিয়মিত ক্লাস করে অপর্ণা তাদের সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করে, একসঙ্গে অঙ্ক শলভ করে, তাদের সাথে অপর্ণার নোটের আদান প্রদান চলে, কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এদিকে বাউণ্ডুলে ছেলেরা এদের নিয়ে দূর থেকে হাসাহাসি করে। সুবিমল এই বাউণ্ডুলে গোষ্ঠীর মধ্যে পরে। সুবিমল অল্প কিছু ক্লাস করে, কিছু প্রক্সি দিয়ে চালায়, আর বাকিগুলো বেমালুম খরচের খাতায়।

সুবিমল ক্লাসে থাকলে অনেকেই বিব্রত বোধ করে। ওর প্রশ্নের কোন বাধ্য বাধকতা থাকে না। একদিন বায়োলজি ক্লাসে প্রফেসার ডায়জেস্টিভ সিস্টেম পড়ালেন। ক্লাসের শেষের দিকে সুবিমল উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা স্যার, মাংসাশী প্রাণীরা যে প্রক্রিয়ায় মাংস হজম করে সে প্রক্রিয়ায় তাদের পেটের নাড়িভুঁড়ি কেন হজম হয়ে যায় না? সেগুলোও তো একরকম মাংস দিয়েই তৈরি। অপর্ণা আর তার দলের কয়েকজন কটমট করে সুবিমলের দিকে তাকাল। ভাবখানা এমন যে, প্রশ্নটা ভালো, তবে এটা তো পরীক্ষায় আসবে না। এইসব অবান্তর প্রশ্ন করে ক্লাসের সময় অযথা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। প্রফেসার সুবিমলকে বসতে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন।

সুবিমলের চিন্তা-ভাবনার ধরন-ধারন কেমন যেন গন্ডি ছাড়া। কেউ কেউ এই দেখে সুবিমলেকে একটু বেশী পছন্দ করে, আবার কেউ কেউ ভাবে এ একটা আঁতেল ছেলে। সেদিন অনেকে ভাবল, সুবিমলের নিশ্চয় বায়োলজি ভালো লাগে, ও এই ক্লাসে রোজ আসবে। সুবিমল কিন্তু যেমন ছিল তেমনি থাকল। ক্লাস করা সুবিমলের অ্যাজেন্ডার মধ্যে নেই। আর ক্লাসে এলে এমন সব প্রশ্ন করে বসত যে, হয় প্রফেসার নতুবা ছাত্ররা, কখনো বা সকলেই বিব্রত বোধ করত। অপর্ণার নেতৃত্বে যে দল তৈরি হয়েছিল, তারা সব সময়েই ভাবত এরা আসে শুধু ক্লাসের সময় নষ্ট করার জন্যে। বার কয়েক তারা এনিয়ে প্রতিবাদও করেছে। যে দু-একজন প্রফেসার এদের কথা শুনে সুবিমলকে চুপ করে বসিয়ে দিয়েছে, সুবিমল তাঁদের ক্লাস করা প্রায় ছেড়েই দিল।

সবই ভালো চলছিল মিড-টার্ম পরীক্ষা না-হওয়া অবধি। মিড-টার্ম পরীক্ষার রেজাল্টে দেখা গেল, শুধু সুবিমল নয়, ওই বাউণ্ডুলে দলের অনেকেই পড়ুয়া দলের অনেকের থেকে ভালো নম্বর পেয়েছে। কয়েকজন কোন কোন সাবজেক্টে হাইয়েস্ট নম্বরও পেয়েছে। এই ঘটনার পরে পড়ুয়া দলের ছেলেমেয়েরা পাইকারি হারে ক্লাস না-কাটলেও অনেকেই ক্লাস না-করার দলে এসে জুটল। তাদের বেশিরভাগের আসল উদ্দেশ্য ছিল, ক্লাস না করে ভালো নম্বর পাওয়া – এই রহস্যের মূল চাবিটা কি – সেইটে উদ্ধার করা। অপর্ণা যদিও এতটা মাথা মোটা না, তবে এনিয়ে যে তার কোন ওৎসুকতাও নাই, তাও নয়।

অপর্ণার আঁটোসাঁটো দলের তখন একটা ছন্নছাড়া অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। একদিন অপর্ণা গুটিকয় সাগরেদ নিয়ে বসে আছে। এমন সময়ে সুবিমলকে একা যেতে দেখে অপর্ণা সুবিমলকে ডেকে এটা-সেটা প্রশ্ন করা শুরু করল। অপর্ণার খাপছাড়া প্রশ্ন আর সুবিমলের সেইরকম ট্যাঁরা-বাঁকা উত্তর শুনে একে একে সবাই উঠে পড়ল। অপর্ণার সাগরেদগুলো সবাই যখন চলে গেল, অপর্ণা তখন আসল কথাটা বলল, তোর তো সবই পড়া হয়ে গেছে। এখন তোর কোন কাজ নেই, আড্ডা মারা ছাড়া। বস না একটু।

এক মুহূর্ত কিছু একটা ভেবে সুবিমল অপর্ণার পাশে বসল। অপর্ণা জিজ্ঞেস করল, তোর কি সব পড়া হয়ে গেছে?

সুবিমল উল্টে জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয়?

অপর্ণা বলল, আমার তো তাই মনে হয়। তোর পুরোটা পড়া হয়ে গেছে, আর তাই তুই শুধু আড্ডা মারিস, এদিকে ভালোই নম্বর তুলিস।

সুবিমল যেন দূরে কিছু একটা দেখছে সেইরকম ভাবে সামনে তাকিয়ে বলল, তাহলে তাই। বিশ্বাসে মিলায় যা, তর্কে তা বহু দূর।

হেঁয়ালিতে অপর্ণা বিরক্ত হলেও একইরকম ভাবে বলল, বল না। বললে কি তোর কিছু কমে যাবে?

সুবিমল চিরাচরিত ভাবে পাতলা গোঁফের নিচে হালকা হাঁসি বজায় রেখে বলল, এতো আর ধন-সম্পত্তি নয় যে দিয়ে দিলে কমে যাবে; এ হল knowledge, অর্থাৎ জ্ঞানের কথা, যত বিলাব ততই বাড়বে।

অপর্ণা অধৈর্য হয়ে বলল, তাহলে বলই না।

সুবিমল অপর্ণার কেমেস্ট্রি প্রাক্টিকাল নোটবুকের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বলল, তোর যেটা প্রায় শেষ, আমার সেটা শুরু করা তো দূরের কথা, এখনো কেনাই হয় নি। তারপরে একটু কি ভেবে বলল, চল, একটু চা খেয়ে তোকে আরও বলছি।

অপর্ণা সুবিমলের পেছন পেছন চলল। কলেজের দেওয়ালের পাশে একটা চায়ের দোকান। সুবিমল অপর্ণাকে নিয়ে কোনার দিকের একটা টেবিলে বসে, অপর্ণা না করা স্বত্বেও দুটো চায়ের অর্ডার দিল। বলল, আচ্ছা, তুই না খেলে আমি খেয়ে নেব।

মন্টু মুহূর্তের মধ্যেই দুই গ্লাস চা দিয়ে গেল। আবার টোস্ট বিস্কুটের অর্ডার হল। তাও এলো। সুবিমল অপর্ণাকে বলল, জানিস বার্লিন ইউনিভারসিটির ক্যান্টিনে দেখা যেত এইরকম চায়ের টেবিলে কেউ কোন প্রব্লেম শলভ করতে করতে আটকে গিয়ে অর্ধেক করে চলে গেছে, অন্য কেউ এসে সেটা শলভ করে দিয়ে গেছে। সেই জন্যে ওইসব টেবিলের কোন চকের লেখা মোছা হত না।

অপর্ণা ভাবল, কোথায় এই চায়ের দোকান? আর কোথায় বার্লিন ইয়ুনিভারসিটির ক্যান্টিন! কার সাথে কার তুলনা। সুবিমলের সব পড়া হয়ে গেছে, তাই ও এইসব করে আর ক্লাস ফাঁকি দেয়। মনে মনে ঠিক করে নিল, আজ ওর কাছ থেকে পুরোটা না জেনে ও ছাড়বে না।

তখন মনে হল, কয়েক ঘণ্টা আগে অবধি এই চায়ের দোকানের দিকে ও তাকাত না পর্যন্ত, আর এখন সেখানে চায়ের গ্লাস নিয়ে বসে আছে। যাকে বলে একরকম আড্ডা মারছে। নিজের অবস্থাটা ঠিক বোঝার চেষ্টা করছে এমন সময়ে সুবিমল অপর্ণাকে বলল, জানিস, এই মন্টু আমার থেকে তাড়াতাড়ি যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারে। ওকে বল, তিনটে চা, দুটো বিস্কুট, আর দুটো টোস্ট চারজনের মধ্যে ভাগ করে দিতে, তোর ভেবে ওঠার আগে ও বলে দেবে। তার সাথে কারো কিছু এক্সট্রা থাকলে সেটাও ঠিকঠাক যোগ করে দেবে।

অপর্ণার সুবিমলের এইসব কথাবার্তা ভালো লাগলেও চায়ের দোকানে বসে গল্প করতে ভালো লাগছিল না। বলল, এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে। তুই তো ওদিকেই যাবি, চল না আমার সাথে।

সুবিমলের কথায় অপর্ণা চায়ের দোকানে এসেছিল, তাই পালটা কথা রাখতে সুবিমলকেও অপর্ণার সাথে যেতে হল। রাস্তায় যেতে যেতে, অপর্ণা ওর ভালোলাগা, না লাগার কথা বলল, কোন প্রফেসরের পড়ানো ভালো লাগে তাও বলল। বাড়ি পোঁছে অপর্ণা বলল, আমাদের বাড়িতে চা খেয়ে যেতে হবে কিন্তু। সুবিমলকে এক রকম জোর করেই ওর বাড়িতে টেনে আনল। যদিও সুবিমল অপর্ণার বাবা-মাকে চিনত, অপর্ণা তাও তাঁদের সাথে সুবিমলের আলাপ করিয়ে দিল। যখন ওর মা বললেন, তুমি নাকি পড়াশুনো করো না, কিন্তু ভালো রেজাল্ট করেছো, সুবিমল বুঝল, অপর্ণা সুবিমলের অনেক কথাই বাড়িতে বলেছে। সুবিমল আর কি করে? বোকার মত হেঁসে বলল, তাই নাকি?

অপর্ণা বলল, বুঝলে মা, আসলে ওর সব পড়া হয়ে গেছে, কিন্তু ও কাউকে বুঝতে দেয় না।

অপর্ণার মা আর কিছু না বলে ভিতরে চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পরে দু-কাপ চা আর একটা প্লেটে এটা-সেটা টুকিটাকি নিয়ে ওদের সামনে রেখে গেলেন।

সুবিমল দু-চুমুক চা খেয়ে অপর্ণাকে বলল, তুই এত যত্ন করে এত ভালো চা খাওয়ালি, তখন আসল কথাটা বলতেই হয়। তারপরে আরও এক-চুমুক চা খেয়ে সুবিমল বলল, একটা কাঠি দিয়ে ঢাকের চামড়ায় মারবি তো শুনবি কত জোরে শব্দ হয়, পাথরের উপরে মারবি তো দেখবি নিজেও শুনতে পারবি না। আমরাও সেই অবস্থা।

সুবিমল কাকে ঢাক আর কাকে পাথর বলল এই কথায় অপর্ণা ধন্দে পড়ে কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কয়েকটা অঙ্ক হচ্ছে না, তুই একটু দেখে দিবি।

সুবিমল বলল, তুই লিখে কাল কলেজে নিয়ে আসিস। দেখি কি করতে পারি। আমি না পারলেও কাউকে না কাউকে দিয়ে শলভ করিয়ে দেব।

অপর্ণা বলল, তুই নিজেই পারবি। করে আমাকে একটু বুঝিয়ে দিস।

সুবিমল অপর্ণার গোয়েন্দাগিরি থেকে বের হওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি চা শেষ করে উঠে পড়ল। বলল, আজ আসি, কাল নিয়ে যাস, দেখব।

Pages: 1 2 3