Home » প্রবন্ধ » সৌমিত্র মিত্রের লেখা বই “আপন আমি” এবং আমি

সৌমিত্র মিত্রের লেখা বই “আপন আমি” এবং আমি

— প্রাপ্তি —

ছোটবেলায় আমি অনেক লেখকের বই প্রথম পড়েছি হয় পুরস্কার পেয়ে নতুবা উপহার পেয়ে। এদেশে কেউ কারুর বাড়িতে এলে হাতে করে কিছু একটা নিয়ে আসা এখানকার একটা বাঙালি রীতি। তাই অহরহ উপহার পেয়ে থাকি – থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ থেকে শুরু করে জামা, প্যান্ট, জুতো, মায় পায়ের মোজা পর্যন্ত উপহার পেয়েছি। তবে উপহার হিসেবে বই – এখানকার বাঙালিরা সচরাচর দেয় না। প্রায় বাইশ বছর এদেশে আছি। মনে পরে না কেউ আমাকে বই উপহার দিয়েছে। এমন ঘটনা ঘটলেও দু-একটার বেশি হবে না।

তাই কেউ বই উপহার দিলে প্রশ্বাসে কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা অনুভব করি। সে যদি লেখক নিজেই তাঁর লেখা বই উপহার দেন তাহলে সে এক অন্য মাত্রার পরিতোষ এনে দেয়।

ন্যাশভিলে BPACON 2019 অনুষ্ঠানে তিনদিন লাগাতার আড্ডার হল সৌমিত্রদার সাথে। শেষ দিন ওনার একক নাটক ছিল – একলা সম্রাট। সেটা শেষ করে গ্রিনরুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলেন। হাতে ওনার লেখা বই, “আপন আমি”। বইটা আমাকে উপহার দিলেন। এইরকম এক অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে হয়ত আমার কথা হারিয়ে গিয়েছিল। তখন ওনাকে কি বলেছিলাম মনে নেই এখন আর।

— অপ্রাপ্তি —

শেষ দিনে আমরাও (Atlanta Theater Workshop, Inc. ) একটা নাটক করেছিলাম। এখানে যেমন হয় – সব কাজ নিজেদের করতে হয় – সেট, মেকআপ, লাইট, সাউন্ড, সবই – বাক্স খোলা থেকে বাক্স বন্ধ করা পর্যন্ত। আমরা বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “পাথর” নাটকটি করেছিলাম। আমি যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম তার নাম হল, হরেন মণ্ডল – গ্রামের অশিক্ষিত গরিব একটি লোক। সুতরাং সেই মত ধুতি, গেঞ্জি ও ফতুয়া পরে তৈরি হয়ে সেটের নানান জিনিষপত্র রেডি করছি এবং ক্রস চেক করছি।

এমন সমেয়ে সৌমিত্রদার সাথে দেখা হল। উনি বললেন, চলো তোমার মেকআপটা করে দেই। আমার কাছে মেক আপ বাক্স আছে।

আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলাম, Thank you দাদা। দরকার নেই, এই তো হয়ে গেছে। এই বলে, মাথার দিকটা দেখালাম। আমার মাথায় সাদা রঙের স্প্রে দিয়ে কালো চুলের উপরে সাদা রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিল একজন।

উনি এক ঝলক আমার চুলের দিকটা দেখে, আমার মুখের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে একটু মুচকি হেসে, আর কিছু বললেন না।

তখন আমার কিছু মনে হয় নি। মনে হল কয়েকদিন পরে। ওনার লেখায় যখন পড়লাম, “নান্দীকারে যখন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে দেখছি, মেলামেশা করছি, কাজ করছি এবং যে কাজটা প্রধানত অভিনয়ের কাজ নয় প্রধানত শেখা – ওই স্লিপ লিখে দেওয়া, কেউ হয়তো বলল, তুমি শক্তিবাবুর পাশাপাশি থেকে মেকআপটা শেখ – মানে অনেকের মনে হতে পারে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয় এবং এখানেই আমার আসল শিকড়টা কিন্তু প্রোথিত হল। আমি থিয়েটারের প্রাথমিক কাজগুলো জানতে পারলাম।”

উনি আমার মেকআপ করে দিলে আমার অভিনয়ের মান এক চিলতে বদলাতো না সেটা সেদিনও যেমন জানতাম, আজও জানি। নিজের অজ্ঞতার জন্যে এই অপ্রাপ্তিটা থেকে গেল যে, ওই সুযোগে মেকআপের কিছু শিখে নিতে পারতাম। এইসব জিনিষ ঠিক স্কুলে শেখা যায় না। আর্টের অনেকটা নিজের ভিতর থেকে আসে আর বাকিটা গুরুমুখী।

— ওনার হৃদয়জ কথা এবং আমার অনুভূতি —

বইটা আসলে ওনার ডায়েরীর অতি সংক্ষিপ্ত আকার মাত্র। আমাদের অনেকেরই অনেক জানা কথার উদ্ধৃতি আছে সেখানে। যেমন, কে কখন “অন্য শক্তি” হয়ে যেতেন। বইটাতে কোন বাগারম্ভর নেই। কোন গুঢ় তত্ত্ব নেই। আছে বাস্তব। আছে ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যর্থতা, পতন, সংগ্রাম, বিবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা, মৃত্যুর কথা। এটা পড়লে বোঝা যায়, একটা সফল কাজ করতে কত অসফলতার অভিজ্ঞতা দরকার পরে। তারপরেও উনি বলছেন, “যে কোন নাট্যদলে ভাঙন অনিবার্য।” অভিমান করে বলেছেন, “…… থিয়েটার যে বিশ্বাস নিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে এগিয়ে চলে, তার অভিঘাত বোধহয় এই ক’জন বোঝেন নি, বা অবিশ্বাসের কোনও সংজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল।”

আর স্বীকারোক্তি? তা অকপট এবং অনবদ্য। “কিন্তু এর মধ্যে কি কোন নৈরাজ্য ছিল না? প্রেম-ভালোবাসা ছিল না? এক পরিশীলিত জীবনযাপন আমি করেছি? নিশ্চয় নয়। ……”

— শেষ —