Home » ছোট গল্প » প্রেম-পর্ব » একদিন সিনেমা হলে

একদিন সিনেমা হলে

দীপা একটু সোজা হয়ে বসতেই ওর ডান দিকের সিটে বসা লোকটার হাতের সাথে ওর ডান হাতটা একটু ছুঁয়ে গেল। দীপা হাতটা টেনে নিয়ে কোলের উপর রাখা ব্যাগটা নাড়াচাড়া করতে করতে একটু আড় চোখে দেখার চেষ্টা করল লোকটাকে। কোন বিকার নেই – লোকটা ঘুমোচ্ছে নাকি? সিনেমা শুরু হয়ে গেছে, পর্দার আলোতে আড় চোখে যতটুকু দেখা যায় তা থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। দীপা চটিটা ঠিক করে পরার ভান করে বাঁ পা-খানা একটু সামনে বাড়িয়ে কোমর থেকে ঝুঁকে পায়ের চটিটা ঠিক করল। সোজা হয়ে বসার সময় আবার দেখার চেষ্টা করল। লোকটা নির্বিকার। ব্লু-জিনসের উপর কালো রঙের টিশার্ট পরে আছে মনে হল, বেশ ফিটফাট মনে হচ্ছে।

পাশে বসা একটা মেয়ে এত নড়াচড়া করল অথচ লোকটার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ভদ্রতা করেও তো ওনার কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত বা বিরক্তিতে যদি একটু ওপাশে সরেও বসে – তাতেও কাজ হয়। লোকটা ডান দিকের হাতলটা পুরোটাই দখল করে বসে আছে। বাঁদিকে ঝুঁকে বসে থাকতে থাকতে দীপার বাঁদিকটা ব্যথা হয়ে গেছে। দীপা এবার অল্প উঠে, শাড়ীর আঁচলটা সামনে টেনে একদম সোজা হয়ে বসল। তবুও লোকটার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, ভাবখানা এমন যেন নিজের বাড়ির সোফায় বসে আছে – বিরক্তিকর, কোন ভদ্রতা জ্ঞান নেই! দীপা ঠিক করল, ওই হাতলে ওরও অর্ধেক অধিকার রয়েছে। যতই অপরিচিত লোকের হাতের সাথে হাত লাগুক, ও নিজের ভাগ ছাড়বে কেন? আস্তে করে সে সেখানে হাত রেখে একটু ঠেলে দিল লোকটার হাতটাকে। এবার লোকটা একটা ক্ষীণ বিরক্তি প্রকাশ করে হাতটা একটুখানি নিজের দিকে টেনে নিলো, কিন্তু একবারের জন্যে তাকাল না পর্যন্ত। দীপার অসহ্য লাগল লোকটার এই উদাসীনতা, মনে হল, লোকটা একটা অভদ্র, পাগল বা ঘুমাচ্ছে হয়ত। দীপা সেভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে মোটামুটি বা-দিকে কাত হয়েই ইন্টারভ্যাল অবধি কাটিয়ে দিল।

দীপার বাঁদিকে দীপার ছেলে। ইন্টারভ্যাল হওয়া মাত্র সে কিছু খেতে চাইল। তার সাথে কথা বলে যখন ডান দিকে তাকিয়েছে, লোকটা তখন উধাও – নিশ্চয় সে ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। দীপার মনে হল অদ্ভুত বেআক্কেলে, জড়ভরত হয়ে ছিল এতক্ষণ আর ইন্টারভ্যাল হওয়া মাত্র কেটে পড়ল! ছেলেকে নিয়ে দীপা বের হল। পপ কর্ণ, চিপস, কোক কিনে এসে বসল নিজের সিটে। লোকটা অন্য দিক দিয়ে যখন এলো সিনেমা তখনো শুরু হয় নি তবে হল অন্ধকার হয়ে গেছে। এসেই আবার ঠিক আগের মতই বসে পড়ল। লোকটা একাই ছোটদের এই সিনেমা দেখতে এসেছে – সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার। সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে ঠিক আগের মতই বার কয়েক দীপার হাতের সাথে ওর হাত লাগল। শেষের দিকে দীপা পুরোটাই বাঁদিক ঘেঁসে ছেলের সাথে পপ কর্ণ খেতে খতে লোকটার উপস্থিতি একরকম ভুলেই গেল।

সিনেমা শেষ। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। লোকটা ঠাই বসে আছে। দীপা ছেলে নিয়ে লাইন ধরে এগোচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে ডাক, এই দীপা। পিছনে ঘুরতেই লোকটা বলল, দীপা না? ভুত দেখার মত চমকে দীপা দাঁড়িয়ে পরল। পাশের লোকটা ওর থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে। দীপা হাঁ করে দেখতে লাগল। ছেলেটা ততক্ষণে প্রায় শেষ চেয়ারের কাছে পৌঁছে গেছে। ডাক দিল, – মা। লোকটা বলল, তোমার ছেলে তোমাকে ডাকছে, চল বাইরে গিয়ে কথা বলা যাবে। বাধ্য মেয়ের মত দীপা কোন কথা না বলে আদেশ পালন করার মত তাড়াতাড়ি কয়েক পা এগিয়ে ছেলের হাত ধরে ভিড়ের সাথে এগোতে থাকল। পেছনে পেছনে লোকটা আসছে। দীপার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে, কান গরম হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে পরে যেতে পারে। একজন বড় কেউ পাশে থাকলে ভাল হত। কাউকে না পেয়ে ছেলের কাঁধ এত জোরে চেপে ধরল যে, সে চিৎকার করে বলল, মা লাগছে। দীপার মনে হল, লোকটা হাসছে, ওর এই কাণ্ড দেখে। সিনেমা শেষের ভিড়ে যে সে তাড়াতাড়ি করে চলে যাবে তারও উপায় নেই। নিজের অজান্তেই কখন যে ছেলেটাকে ঠেলে দিয়েছে, সে বেশ জোরে বলল, ঠেল না মা, পরে যাব।

ততক্ষণে তারা হলের দরজার বাইরে এসে গেছে, অনেক আলো সেখানে, ভিড়টা হঠাৎ করে পাতলা হয়ে যায় সেখানে, লোকজন চারিদিকে ছড়িয়ে পরে একটু ফাঁকায় দাঁড়ানর জন্যে। দীপা ভাবল, এই ভিড়ের সাথেই সে একেবারে বাইরে বেরিয়ে যায়, ঠিক সেই সময়ে লোকটা আবার ডাকল, দীপা এইদিকে এসো, এইদিকটায় ফাকা আছে। গলাটা খুব চেনা, তবে সে কি করে এখানে আসবে? দীপা না শোনার ভান করে, সোজা এগিয়ে যাবে ভাবল। কিন্তু ছেলে বলল, মা তোমাকে উনি ডাকছেন। দুই দিকের চাপে আর পালানো যায় না। এবার দীপা মুখ তুলে ভাল করে দেখল, যা ভেবেছিল সেই – বিকাশজ্যোতি। যুবক থেকে লোকের দিকে গড়ানোর ঠিক আগের চেহারা হয়েছে বিকাশজ্যোতির। আলোয় দেখলে একবারেই চেনা যেত। তাহলে বিকাশজ্যোতি এতক্ষণ তার পাশে বসে ছিল। বলল, তাহলে, তুমি আমার…।

– হ্যাঁ, আমি তোমার পাশের সিটটায় বসেছিলাম এতক্ষণ।

বিকাশজ্যোতির এই এক বদ অভ্যাস। দীপার সব প্রশ্ন এবং তার উত্তর ওর জানা। দীপা কখন কি করবে, কি বলবে – সব ওর জানা। ওর সামনে দীপার নিজেকে কেমন যেন অস্তিত্বহীন মনে হয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতিটা আবার ওকে এক মুহূর্তে ঘিরে ফেলল বিকাশজ্যোতির এই এক কথায়। দীপা জিজ্ঞেস করল, তুমি জানতে যে আমি…?

বিকাশজ্যোতি বলল, একদম না। তবে সিনেমা হলে সিটের দুই হাতল অধিকার করে বসার প্রবণতা থেকে একটু আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। ইন্টারভ্যালে তুমি তোমার ছেলের দিকে ঘুরে ছিলে, তাই দেখতে পাই নি। অপেক্ষা করছিলাম সিনেমা শেষ হলে দেখব। ঠিক মিলে গেল।

দীপা বলতে গেল যে সেতো তুমিও দুই হাতল দখল করে বসে ছিলে। কিন্তু, বিকাশজ্যোতির সামনে ওর নিজের অস্তিত্বহীনতাটা ওকে অবশ করে দিল। তাছাড়া, বিকাশজ্যোতি যে অন্য হাতলটাতেও হাত রেখেছিল সেটা সে দেখে নি। হঠাৎ করে এই ছেলেমানুষি ঝগড়াটা বেশ ভালো লাগল। তবে কিছু বলল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি কোথায়, এখন এখানে…।

বিকাশজ্যোতি বলল, দুই ধাপে তোমার উত্তরটা দেই। বলেই, পকেট থেকে তার বিজনেস কার্ডটা বের করে দীপার হাতে দিয়ে বলল, এতে তোমার প্রশ্নের প্রথমদিকের উত্তরটা পাবে। আর পরের অংশটা হল, কাজে কলকাতায় এসেছি তিনদিন আগে। কাজটা শেষ হল না, আরো দুই দিন থাকতে হবে। আজ রবিবার, রাস্তায় পোস্টার দেখলাম সুকুমার রায়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। তাই হোটেলে বসে থাকতে পারলাম না। সুরজিতকে বলেছিলাম আসতে, কিন্তু ও এলো না। বলল, রাতে ওর বাড়ীতে খেতে যেতে। ও সেই নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।

প্রশ্নের আগেই উত্তর পাওয়াটা দীপার এক সময়ে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন পরে সেটা একটু অস্বস্তিতে ফেললেও, বেশ ভালো লাগছে। জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগল তোমার?

বিকাশজ্যোতি বলল, এখনও বাঙালী ঠিক করে উঠতে পারল না যে সুকুমার রায় ছোটদের গল্প বড়দের জন্যে লিখেছিলেন, না বড়দের গল্প ছোটদের জন্যে লিখেছিলেন। তাছাড়া, বাকি সব ভালো।

বলেই বিকাশজ্যোতির নজর গেল দীপার ছেলেটার দিকে। বেচারা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে সব শুনছে। বিকাশজ্যোতি প্রায় হাঁটু গেড়ে বসে ওকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?

ছেলেটা বলল, দিপ্তারক বসু।

– চলো। বলেই বিকাশজ্যোতি ওর হাত ধরে পাশে যে আইসক্রিম স্ট্যান্ডটা ছিল সেখানে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোন আইসক্রিম ভালো লাগে।

ছেলেটা বলল, চকোলেট।

বিকাশজ্যোতি দুটো চকোলেট আর একটা ভ্যানিলা আইসক্রিম নিয়ে ফেরত এলো।

দীপা, করো কি? করো কি? – বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। সে জানে – এই হচ্ছে বিকাশজ্যোতি। বিকাশজ্যোতি দীপাকে ভ্যানিলা আইসক্রিমের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?

দীপার ছেলে তখন আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। মাথা কাত করে নাড়িয়ে জানাল – ভালো। আর বলল, থ্যাঙ্ক ইয়ু।

বিকাশজ্যোতি বলল, তোমার ছেলেটা খুব মিষ্টি, অনেকটা তোমারই মত।

দীপা একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আইসক্রিম খেতে খেতে ভাবল, তোমার পাল্লায় পরলে কি কারো কিছু করার বা বলার উপায় আছে? মিষ্টি লাগবে নাতো কি লাগবে? বিকাশজ্যোতি, তুমি তো একাই দুই পক্ষ।

দীপার কাছে তখন সময় হারিয়ে গেছে। ভাবল, বিকাশজ্যোতির কি এখনো সব মনে আছে? ওর সিনেমার সিটের দুই হাতল ধরে বসা, ভ্যানিলা আইসক্রিম। সব কিছু?! বিকাশজ্যোতি একান্তে দীপার সাথে বাড়াবাড়ি করলে দীপা ওকে যে নামে ডাকত – আইসক্রিমের কাপ থেকে মুখ তুলে দীপা ডাকল, বিকাশজ্যোতি কুকর্মকার।

এখন সে বয়স বা সুযোগ কোনটাই নেই। ওই নামে আমাকে আর কেউ ডাকে না – বিকাশজ্যোতি গম্ভীর ভাবে বলল।

দীপা নিজের অজান্তেই এক পা এগিয়ে গেল বিকাশজ্যোতির কাছে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানো দীপার ছেলেটা একটা হাঁচি দিয়ে আইসক্রিমটা নিজের জামাপ্যান্ট আর কিছুটা দীপার শাড়ীতে লাগাল। বিকাশজ্যোতি দৌড়ে গিয়ে আইসক্রিম স্ট্যান্ড থেকে কিছু টিসু পেপার আর এক গ্লাস জল নিয়ে এসে ওকে পরিষ্কার করে দিল, তারপর দীপার শাড়ীও ঝেড়ে দিল। দীপার অস্বস্তি লাগলেও কে শুনছে? এ যে বিকাশজ্যোতি। দীপার মনে পরল একটা ঘটনা। বলল, মনে আছে? কলেজের ক্যান্টিনে হাঁচি দিয়ে চা ফেলে তুমি আমার শাড়ী নষ্ট করেছিলে?

বিকাশজ্যোতি বলল, “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”, – বড় দাদুরও সেই অভিমত।

দীপা জানে বিকাশজ্যোতি কাকে বড় দাদু বলে। বলল, রবীন্দ্রনাথ তোমার এত মুখস্থ!

বিকাশজ্যোতি বলল, ঠিক তা নয়, যাকে ভালোবাসি নিজের অজান্তে তার সবটাই নিজের হয়ে যায়। মুখস্থ রাখতে হয় না।

— শেষ —