সেই ছোটবেলা থেকে যখনই কাউকে প্রণাম করেছি, প্রায় সবাই বলেছেন – বড় হয়ে মানুষ হ’য়ো। একেক সময় তো রীতিমত ধন্দে পরে যেতাম যে আমি এবং আমার মত ছোট ছেলেমেয়েরা অন্য কোন জীব না তো? সেই মানুষ হওয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষা নিয়ে প্রতিদিন একদিন একদিন করে বড় হতে হতে হঠাৎ দেখলাম পাড়ার মেয়েগুলো অন্যরকম হয়ে গেল। বিকেল হলে আমাদের সাথে আর খেলতে আসে না। একদিকে ভালোই হয়েছিল – যে দলে ওদের সংখ্যা বেশী হত তারাই হারত – তাই কেউই ওদের নিতে চাইত না। আবার ওদের না-নিলে ওরা বড়দের কাছে গিয়ে নালিস করত এবং তা নিয়ে নানান বিপত্তি তৈরি হত। অন্তত, সেই ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়া গিয়েছিল। তবে বিপদ হয়েছিল দুটো। পাঁচজন বা সাতজনের দুটো টিম করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। সেটা যদিও বা ম্যানেজ করা যেত, দ্বিতীয়টা খুবই অসুবিধাজনক ব্যাপার – তারই একটা নমুনা দেই।
বিকেল হলেই সবগুলো এক জায়গায় জড়ো হয়, নিজেদের মধ্যে কি সব ফিসফাস করে বলাবলি করে আর ফিক ফিক করে হাসে। তারপর একটু খানেক চুপ করে থাকে, আবার হাসে; তারপর কি সব বলাবলি করে, আবার হাসে। আমি তখন ব্যাট করতে নেমেছি। পটা বল করতে আসছে। হঠাৎ নজর গেল ওই মেয়েদের দলটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কুটিকুটি। ভাবলাম, নিশ্চয়ই কেউ আমার পিছনে ল্যাজ লাগিয়েছে, আর আমি যেভাবে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়েছি, তাই -। ভাবনাটা পুরো শেষও হয়নি – পটার বল আমার ব্যাট আর পায়ের মাঝখান দিয়ে গলে মিডল স্ট্যাম্প ফেলে দিল। ফার্স্ট বলে, জিরো রানে আমি আউট! রাগে গজগজ করতে করতে প্যান্টের পেছনে হাত দিলাম। না, সব পরিষ্কার – কোন ল্যাজ নেই। মাথার পেছনে হাত দিলাম। কোন টিকি নেই। ডান দিক, বাঁ দিকে মোচড় দিয়ে দেখলাম। সব যেমন কার তেমন আছে। আমার এই অবস্থা দেখে ওরা আবার হাসে, আর ফিস ফিস করে কিসব বলে। বুঝলাম, হেভি উল্লু বানিয়েছে আমাকে। যেহেতু ওরা কিছু করে নি তাই চার্জশিটটাও ধরাতে পারলাম না। একবার ভাবলাম এসব পটার প্ল্যান। ও ব্যাটা যা স্পীডে গাছে ওঠে! খেলতে আসার আগে নিশ্চয় পেয়ারা চুরি করেছে এবং ওদেরও ভাগ দিয়েছে। তার সাথে এই প্ল্যান করেছে।
সেইদিন গেল। পরে দেখলাম ওরা এমনি হাসে, ওদের হাসির সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এদের হাসির এত রসদ কোথা থেকে আসে সেটা না জানা পর্যন্ত মনে কোন শান্তি নেই। ছুতোনাতা করে কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করলেই সবাই চুপ – অনেকটা গোটা পাড়া ঝুপ করে লোডশেডিং হওয়ার মত। তারপরে যেই ওখান থেকে সরে যাও, আবার হাসি। খেলাধুলোর পরে মাঝে মাঝে আমরা বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করতাম। সেইসময় আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, এই মেয়েগুলো সারাক্ষণ এইরকম হাসে কেন রে? উত্তরটা মোটামুটি আসত এই – ‘ও তুই বুঝবি না।’ ‘আরে, জানিনা বলেই তো জিজ্ঞেস করছি’, আমি বলতাম। তার উত্তরটা আসত – ‘আমরাও জানি না।’
তখন থেকে মেয়েরা আমার কাছে একটা রহস্য হতে শুরু করল। কয়েকবার ওদের পাস দিয়ে যাওয়ার সময় – হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, কিরে হাস এবার – এমনও বলেছি। ভাবলাম, কেমন একটা জব্বর ভাঙালাম! ও মা, দেখি তাতেও হাসে। লাফিং গ্যাসের বিষয়টা আমার তখন জানা ছিল না। তা না হলে, আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতাম যে এরা রাস্তায় দল বেঁধে বের হওয়ার আগে সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে লাফিং গ্যাস শোঁকে।
এই অবধি, ঠিক ছিল। মেয়েরা আমাদের সাথে খেলেনা, সবসময় হাসে – আমার মধ্যে মেয়েদের নিয়ে বেশ একটা রহস্য তৈরি হয়েছিল। এই রহস্য উদ্ঘাটন করার সময় নিজেকে একটা খুদে ডিটেকটিভ মনে হত, যদিও আজও সে রহস্য আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে। সে যাহোক, যেটাতে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম, তা হল –
দুর্গা পূজার পরে একাদশীর দিন সন্ধের ঠিক পরেই আমরা দল বেঁধে পাড়ায় বাড়ী বাড়ী যেতাম। সেখানে ছট-বড়-মেজো যাকে সামনে যাদের পেতাম ঢিপ ঢিপ তাদের করে প্রণাম করতাম, আর নাড়ু-মোয়া খেয়ে বেড়াতাম। সেই সময়ে মেয়েরা ভুতের ভয়ে আমাদেরই পিছন পিছন আসত।
আমি এক বাড়ীতে বয়স্ক একজনকে প্রণাম করলাম, তিনি বললেন, বড় হয়ে মানুষ হ’য়ো। আর আমার ঠিক পরেই একটা মেয়ে তাঁকে প্রণাম করল, পরিষ্কার শুনলাম, উনি বললেন, বড় হয়ে সুখী হ’য়ো। মানেটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেল – এরা মানুষ হয়ে গেছে। এই পরাজয়ের দুঃখে নাড়ুগুলো খেতেও আমার তেতো লাগল তারপরে।
— শেষ —