Home » ছোট গল্প » অন্যান্য » হাসির মন্ত্র

হাসির মন্ত্র

সে অনেকদিন আগেকার কথা। ঠিক পৌরাণিক না হলেও প্রায় তার কাছাকাছি বলে ভাবা হয়।

এক রাজ্যে এক অপরা সুন্দরী রাজকন্যা ছিল। সারাদিন হাসিতে মাতিয়ে রাখত সারা রাজবাড়ি। কি হল? কে জানে? একদিন সকাল থেকে রাজকন্যার হাসি বন্ধ। কথা বন্ধ। সারাদিন একা একা বসে থাকে। সাজে না, বাগানে যায় না, দাসিরা ঘরে ঢুকলে তাদের তাড়িয়ে দেয়। আস্তে আস্তে তার খাওয়া দাওয়া কমতে থাকল। চখের তলায় কালি জমল। রোগা হয়ে গেল।

মহারাজ, মহারানি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখলেন না। রাজবদ্যি, রাজবিদূষক, তান্ত্রিক, জলফুক, ঝারফুক, জাদুকর, সাধুবাবা, কে না চেষ্টা করল। কিন্তু কোন ফল হল না। দিন দিন মেয়ের স্বাস্থ্য একটু একটু করে ভাঙতে লাগল। দুশ্চিন্তায় মহারাজের রাজপাঠ মাথায় উঠল।

রাজবদ্যি একদিন মহারাজকে বললেন, রাজকন্যাকে আগের মত হাসি খুশি না করতে পারলে কোন ওষুধ পথ্যিতে কিছু কাজ হবে না। মহারাজ মহামন্ত্রিকে ডেকে আদেশ দিলেন, সব জায়গা থেকে যত পণ্ডিত, মূর্খ, জোকার, বুজরুক, নেতা, অভিনেতা, কৌতুকাভিনেতা, যাকে পার নিয়ে আসো। বলো, রাজকন্যাকে হাসাতে হবে। আমি সবাইকে তাদের দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দেব। তখন তো আর টিভি ছিল না, আর মেগাসিরিয়ালও হত না। যাত্রাপালা করেই এদের পেটের ভাত জোগাড় হত। দ্বিগুণ পারিশ্রমিকের কথা শুনে পরেরদিন সকাল হতে না হতেই রাজ দরবারের বাইরে লোকের লম্বা লাইন পরে গেল। তার যা চেহারা, বাংলাদেশ যুদ্ধের আগে রেশন দোকানেও কেরোসিন তোলার জন্যে এত লম্বা লাইন পরে নি।

সে যা হোক, একেকজন করে রাজবাড়ীতে ঢোকে আর কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এইরকম চলল কয়েকদিন। কোন ফল হল না। রাজকন্যা আরো শীর্ণকায় হয়ে গেল এই কয়দিনের ধকলে। আশেপাশের রাজ্য থেকেও অনেক লোক এসেছিল। কেউই কিছু করতে পারল না। রাজবদ্যি প্রমাদ গুনলেন। বললেন, এইভাবে আর কিছুদিন গেলে, আমরা হয়ত রাজকন্যাকেই হারাব।

এবার মহারাজ বললেন, যে আমার মেয়েকে হাসাতে পারবে, তাকে আমি অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দেব। এই শুনে কয়েকটা লোভী এই পথ মাড়াল বটে, কিন্তু কোন কাজ হল না।

একদিন প্রায় সন্ধ্যা তখন। সূর্য অস্ত গেছে বেস কিছুক্ষণ আগে। মহারাজ রাজকন্যাকে নিয়ে বাগানে দোলনায় বসে আছেন। রাজকন্যা চুপচাপ। কোন কিছুতেই তার কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। দুশ্চিন্তায় মহারাজের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। এমন সময়ে, রাজ দরবারের এক কোনে একটা হট্টগোল শুনে উনি উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে দেখেন, খালি পায়ে, ছেঁড়া জামা পরা, চুলে ধুলোমাটি লাগা একটা যুবক কি একটা বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর প্রহরীরা তাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে।

মহারাজ বললেন, থামো সবাই। ওই ছেলেটা কি বলছে?

প্রহরী সর্দার বললেন, মহারাজ এ হল মন্টু মাতাল। সারাদিন মদ খেয়ে পরে থাকে। এখনো ওর মুখ থেকে পচানির দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ও বলছে, ও নাকি রাজকন্যাকে হাসাতে পারবে।

মহারাজ একটু থমকে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন। এই ফাঁকে মন্টু এক প্রহরীর কাছ থেকে বল্লমটা টেনে মাটির মধ্যে গেঁথে দিয়ে বলল, আমি যদি এক মিনিটের মধ্যে রাজকন্যাকে না হাসাতে পারি, তোমরা আমাকে এই শুলে চড়িয়ে মেরে ফেল। তবে মহারাজ, আমি যদি রাজকন্যাকে হাসাতে পারি, তাহলে আপনাকেও আপনার প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।

মহারাজ ভাবলেন, এত যার আত্মপ্রত্যয় তার মধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ব্যাপার আছে। কত লোক তো কত চেষ্টা করল। লম্বা চওড়া ফিরিস্তি নিয়ে এসেছিল সবাই। কাজের কাজ তো কিছুই হল না। এ ছেলেটা এত সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে? যে, না হাসাতে পারলে মরতে রাজি আছে। আরও ভাবলেন যে, তাঁরও তো আর কোন উপায় নেই।

মহারাজ বললেন, নিয়ে এসো ওকে রাজ দরবারে।

ডাকা হল রাজবিদুষক, মহামন্ত্রি, রাজবদ্যি, আরো অনেককে। সবাই বসলেন নিজের নিজের জায়গায়। রাজকন্যাকে ধরে বসান হল তাঁর আসনে। যুবক এগিয়ে গেল রাজকন্যার কাছে। তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে কি একটা বলল বা, বলল না, মনে হয়। রাজকন্যার কি হাসি! হাসতে হাসতে বিষম খাওয়ার জোগাড়। দাসিরা তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল দিল রাজকন্যাকে। রাজকন্যা এক ঢোঁক জল গিলে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, আর?

ছেলেটা আগেরবারের মতই কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল মনে হয় বা, হয়ত কিছুই বলল না। রাজকন্যা আর বসে থাকতে পারল না। হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে গেল। সে হাসি আর থামেই না। রাজকন্যার এই হাসি দেখে দরবারের সকলে কিছু না জেনেই হাসতে শুরু করল। আনন্দে তখন মহারাজ আর মহারানির দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

হাসতে হাসতে রাজকন্যা ছেলেটার বুকের উপর এসে পরল। কোনরকমে ওর ছেঁড়া জামাটা খামচে ধরে টাল সামলে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু?

ছেলেটা আগের বারের মতই কানে কানে কিছু একটা বলল মনে হয়। রাজকন্যা আরো জোরে হাসতে হাসতে বলল, আমি আর পারছি না। আমি চললাম নিজের ঘরে। এই বলে, ঘাঘরাটা একটু তুলে, খিল খিল করে হাসতে হাসতে অন্দরমহলে চলে গেল। ওর দাসীরা পিছন পিছন ছুটল।

সারা দরবারে তখন আনন্দের একটা মহল শুরু হল। সবাই একে অপরকে কোলাকুলি করছে। যুবক তখন মহারাজের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, মহারাজ, আমি আমার কথা রেখেছি। এবার আপনার কথা রাখার পালা।

মহারাজ বললেন, নিশ্চয়ই। তবে আমি জানতে চাই তুমি আসলে কে? তুমি নিশ্চয় ছদ্মবেশে এসেছ। তোমার আত্মপরিচয় দাও। আমি নির্ভয় দিলাম।

যুবক বলল, আমাকে সবাই মন্টু মাতাল বলে। সেটাই আমি। কোন ছদ্মবেশে আসি নি।

মহারাজ আর কথা বাড়ালেন না। অর্ধেক রাজ্যের দানপত্র দলিলে সই করে মন্টু মাতালকে দিয়ে দিলেন।

সে যুগে গিফট ট্যাক্স ছিল না। মন্টু দলিল নিয়ে রওনা দিল। ও যখন দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবাই ওঁকে ছেঁকে ধরল যে, কি মন্ত্র ও রাজকন্যার কানে কানে বলল যে রাজকন্যা হেসেই বাঁচে না?

মন্টু সবাইকে একই কথা বলল। বলল, এটা গুপ্ত মন্ত্র। বলা যাবে না। এ কেবল একজনকেই বলা যায়। দ্বিতীয় কেউ শুনলেই, শোনামাত্র তার মৃত্যু হবে। এই শুনে একে একে সবাই পিছিয়ে গেল।

মন্টু সবাইকে কাটিয়ে দরবারে শেষ দরজা পার হবে। এমন সময়ে বৃদ্ধ রাজবদ্যি এসে দাঁড়ালেন মন্টু মাতালের সামনে। বললেন, বংশ পরম্পরায় আমরা বদ্যি। অনেক ওষুধের আবিস্কার করেছি লোকজনকে সুস্থ রাখার জন্যে। আমি আমার নিজের স্বার্থে চাইছি না বাবা। তুমি তো এবার রাজা হয়ে যাবে। তোমার পক্ষে তো এই কাজ করা আর সম্ভব হবে না। অসুখে পড়লে লোকে আমার কাছে আসবে। এই মন্ত্রটা জানা থাকলে অনেকের উপকার হবে।

মন্টু চারিপাশে তাকিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ আর নেই। বলল, আমি মাতাল হলেও কৃতঘ্ন নই। আপনি একদিন আমার অসুখ সারিয়েছিলেন তাই কেবল আপনাকে বলব। তবে বিনা কারণে আপনি এটা সবাইকে বলতে পারবেন না।

রাজবদ্যি বললেন, প্রতিজ্ঞা করলাম।

মন্টু তখন কানে কানে সেই তিনটে মন্ত্র রাজবদ্যিকে বলল। আর অমনি রাজবদ্যির হাসি শুরু হল। হাসতে হাসতে এমন হোঁচট খেলেন যে, পরেই তাঁর মৃত্যু হল।

মন্ত্র তিনটে বলার পরে মন্টু একটুও দাঁড়ায় নি সেখানে। রাজবদ্যির হোঁচট খাওয়া সে দেখে নি। পরে লোক মুখে শুনেছিল এই দুঃসংবাদ।


তারপর মন্টু মাতাল শ্রী মন্টু মহারাজ হয়ে নিজের রাজ্য শাসন করে জীবনের শেষদিন অবধি ভালোভাবেই কাটিয়েছিল।

এদিকে প্রথম মহারাজের কানে সব কথাই গিয়েছিল। মহারাজ একবার দুত পাঠিয়ে মন্টু মাহারাজকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি আমাদের রাজবদ্যিকে মন্ত্রটা বলে মারলেন কেন?

মন্টু তখন সমান মাপের রাজা। উত্তরে মন্টু বলেছিল, আমার যদি সেই অভিপ্রায় থাকত তাহলে সেইদিন রাজ দরবারের সবাইকেই মারতে পারতাম। এমনকি আপনাকেও। তা তো করি নি। রাজবদ্যি আমার পথ আটকে ধরেছিলেন। আর আমি ভেবেছিলাম, উনি বিচক্ষণ মানুষ। হয়ত উনি মন্ত্রটা জানেন। আমার কাছে যাচাই করছেন মাত্র।

এই ঘটনার পরে, কেউ আর শ্রী মন্টু মহারাজের কাছে মন্ত্রটা শুনতে চায় নি।


এদিকে যাই হোক, মন্টুর মনের মধ্যে কিন্তু একটা খচখচানি লেগেই ছিল যে, ওর মৃত্যুর পরে এই মন্ত্রটা না হারিয়ে যায়। তাই সে মরার আগেই নিজের স্মৃতিসৌধ তৈরি করে একটা ফলকের গায়ে সংকেতে এই মন্ত্র তিনটা লিখে গিয়েছিলেন।

সবাই সে কথা জানত। এটা কোন গোপন কথা ছিল না সেই সময়ে। কিন্তু এর ভয়ঙ্করতার কথা ভেবে কেউ ওটার দিকে তাকাতও না অবধি।

কয়েক যুগ কেটে গেছে এইভাবে। এখন লোকের মন্ত্র-টন্ত্রের উপরে আর বিশ্বাসও নেই ভয়ও নেই। হাল আমলের গবেষকরা এই সংকেতলিপির অর্থোদ্ধার করে প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ যায়। সরকার গবেষকদের পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে, এ যেন কোন মতেই সাধারণ লোকের কাছে না যায়। সেইমতই চলছিল এতদিন।

তারপর সরকার বদল হল। আগের সরকারের অনেকেই দল বদল করলেন। সব মিলেয়ে এতদিন যেটা গোপন ছিল সেটা লোকে জেনে গেল। প্রথম দুটো নিয়ে লোকে বলে। তৃতীয় মন্ত্রটা বর্তমান নিয়ে। তাই তার উপর নিযেধ আজ্ঞা এখনো বজায় আছে।

সকালের লাফিং ক্লাবেও অনেক সময়ে ব্যাবহার হয়। সকালে যেদিন ট্রেনারের হ্যাং ওভার কাটে না। প্রথম মন্ত্রটা একবার জোরে বলে দেয়। তারপর সারা সেসনে আর কিছু করতে হয় না। ওই একটাতে সবাই সারা সকাল হাসতে থাকে।


প্রথম মন্ত্র হলঃ সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে বিপ্লব করবে।

দ্বিতীয় মন্ত্র হলঃ সেটা আবার অনেকে বিশ্বাস করে।

তৃতীয় মন্ত্র (যার উপরে এখনো নিষেধ আজ্ঞা আছে) হলঃ তৃণমূল কংগ্রেস নাকি পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি ঘটাবে।

— শেষ —