পাটুর সাথে তখন আমার বছর তিনেকের আলাপ – ঠেকের বন্ধু। অন্যদের তুলনায় একটু চুপচাপ গোছের ছেলে। কিছু একটা দিতে সেদিন প্রথম ওর বাড়ীতে যাই। ওর পাড়ায় বেশ কয়েকজনকে জিগ্যেস করার পরে ওর বাড়ীটা পাওয়া গেল – সে এক বিশাল বাড়ী। সাধারণত পাড়ায় ওইরকম বাড়ীর প্রতি কারণে বা অকারণে প্রতিবেশীদের অনেক উৎসাহ থাকে – সবার এক ডাকেই চেনার কথা। তবু এত লোককে জিগ্যেস করতে হল? মনের মধ্যে একটা খটকা থেকে গেল। কে জানে বড় বাড়ীর বড় ব্যাপার – কিছু হবে হয়ত। পেল্লাই সাইজের লোহার গেটের সামনে গিয়ে ডাক দিলাম – পাটু, পাটু। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা – কোন সারা না পেয়ে আবার ডাক – পাটু, পাটু। বার তিনেক এইরকম ভাবে ডাকার পরে পাটু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, আমার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে বলল, ঠিক মত কথা না বলতে পারলে কথা বলিস না। বলেই, মুখের উপর গেটটা লাগিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেল।
ওর এই অকারণ অপমানজনক ব্যবহারে আমি স্তম্ভিত। কি হল, কেন ও এই কথা বলল – কিছুই বুঝতেই পারলাম না। বোকার মত কয়েক সেকেন্ড সেখানে দড়িয়ে থেকে আমার সাইকেল যেদিক মুখ করা ছিল সেদিকেই চলে গেলাম। পথে কামালের বাড়ী, যেতে যেতে ভাবলাম একটু কামালের বাড়ী ঘুরে যাই। পাটুর নিশ্চয় কিছু হয়েছে – এটা উদ্ধার করতে হবে। কামালের সাথে বসে এটা-সেটা দু’চার কথার পরে কামালকে গোটা ব্যাপারটা বললাম। শুনে কামাল বলল যে পুরোটা ও জানে না, তবে পারমিতা, টুয়েলভ এবং চুমু – এই তিনটে মিশিয়ে নামটা প্রথমে ছিল পাটুচু – সেটা সংক্ষেপে হয়েছে পাটু। পারমিতা পাটুর বাড়ীর আশেপাশের কোন একটা বাড়ীতে থাকে। আমি জিগ্যেস করলাম, পাটু কি প্রেম করে? কামাল বলল, ঠিক জানি না, যতটুকু শুনেছি, নামের যে অংশটা খসে পরেছে – সেটা নিয়েই কিছু একটা বিপত্তি হয়েছিল।
কেমন যেন একটা দুঃখ হল ওর জন্যে, রাগটাও কমে গেল। মনে মনে বাকিটা ভেবে নিয়ে আমি আর এ নিয়ে কথা এগোয়নি।
এবার বলি জাগার কথা। জাগা যখন হোস্টেলে এসেছিল ওর নাম ছিল অরূপ মৈত্র। অরূপ বেশ রসিক, বুদ্ধিমান এবং স্বাস্থ্যবান ছেলে। একবার অরূপ বাড়ী গেল ওর ঠাকুরদা মারা যাওয়ার খবর শুনে। যখন ফিরে এলো টাক মাথা চোখে কালো চশমা পরে – অনেকটা হিন্দি সিনেমার গুণ্ডা-রোলের জাগগুর মত দেখতে লাগত – সেইখান থেকে জাগগু – আদরে জাগা। অত্যন্ত নির্বোধ না হলে হোস্টেলের বন্ধুদের দেওয়া এরকম আদরের নাম নিয়ে কেউই আপত্তি করে না, কারণ তার ফল যে কি ভয়াবহ হতে পারে সে দিকে না যাওয়াই ভালো। অরূপ নির্বোধ নয় – হয়ত ভেবেছিল জাগগুর থেকে জাগা নামটাই ভালো, বা ওর হয়ত নামটা সত্যি পছন্দ হয়েছিল – যে কারণেই হোক নিজেকে জাগা নামেই পরিচয় দিত। কিছুদিন পরে সবাই এমন কি টিচারেরাও ওকে জাগা বলেই ডাকতেন।
জাগা তখন কলেজের সিনিয়র ইয়ারের ছাত্র। ওর বাবা অফিসের কোন কাজে রায়গঞ্জের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে ছেলের সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে হোস্টেলে আসেন। তখন বেলা দুটো মত হবে। হোস্টেলে কয়েকজন ছাড়া কেউই নেই। ভদ্রলোক একজনকে দেখতে পেয়ে বললেন, একটু অরূপ মৈত্রকে ডেকে দেবে?
সে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, পরিষ্কার বলে দিল – ও নামে এখানে কেউ থাকে না।
ভদ্রলোক যখন আরো একটু বিবরণ দিলেন, ছাত্রটি বলল – আপনি কি অরূপ ঘটককে চাইছেন? তবে সে তো কেমিস্ট্রির ছাত্র।
ভদ্রলোক বললেন, না না, অরূপ ঘটক না। অরূপ মৈত্র, ফিজিক্সে পড়ে।
ছেলেটি তার উত্তরে বলল, অরূপ মৈত্র বলে এই হোস্টেলে কেউ থাকে না, আর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে তো ওই নামে কেউই নেই।
ভদ্রলোক বললেন, অরূপ কি তাহলে হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে? আচ্ছা, ওকে কি তাহলে এখন কলেজে পাওয়া যাবে? ও ফিজিক্সের সিনিয়র ইয়ারের ছাত্র।
ছেলেটি উত্তরে বলল, আমিও ফিজিক্সেরই ছাত্র, ওই ডিপার্টমেন্টে অরূপ মৈত্র নামে কেউ নেই।
সিনিয়র ইয়ারের একজন কোন একটা ঘরে ঘুমচ্ছিল। এরকম নানান কথায় ওর ঘুম ভাঙ্গাতে ব্যাল্কনিতে এসে জিগ্যেস করে, আপনি কাকে খুঁজছেন?
ভদ্রলোক বেশ সম্ভ্রান্ত এবং উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার – সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। হোস্টেলের গেটের বাইরেই একটা সাদা অ্যাম্বেসাডর ও একটা বড় ভ্যান দাড়িয়ে আছে। ভদ্রলোকের দুহাত পিছনেই ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওনার অ্যাটাচি ও একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের বাইরে পুলিসের পোশাকে একজন গার্ড। নিজের ছেলে শুধু হোস্টেল নয় এমনকি কলেজ থেকেও উধাও, অথচ মাসে মাসে টাকা নিয়ে যাচ্ছে – এনিয়ে দুশ্চিন্তা, নাকি অধস্তন কর্মচারীর সামনে এইরকম হেনস্তা – কোনটার আঘাত সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছিল তাঁকে, তা উনিই জানেন – তবে ভদ্রলোক তখন কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
সিনিয়র ইয়ারের ছাত্রটি আবার জিগ্যেস করে, আপনি কাকে খুঁজছেন?
অ্যাসিস্ট্যান্টটি দু’পা এগিয়ে এসে উনাকে বলল, স্যার, উনি আপনাকে কিছু বলছেন।
ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, উনি ফিজিক্সের অরূপ মৈত্রকে খুঁজছেন।
সিনিয়র ইয়ারের ছেলেটা ব্যাপারটা বুঝতে পারে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটাকে বলে, যা জাগাকে ডেকে নিয়ে আয়, বল ওর বাবা এসেছেন।
ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটা তখন বলে, আপনি বলবেন তো যে আপনি জাগাদাকে খুঁজছেন। অরূপ বললে, কি করে বুঝবো?
ছেলের হদিস পাওয়ার আনন্দের থেকে অরূপ নামের এই অবনতি দেখে ভদ্রলোক এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে তারপরে বেশী কোন কথা বলেন নি। পরে হয়ত এই নিয়ে অরূপের সাথে ওর বাবার কোন কথা হয়েছিল, কারণ এর পর থেকে অরূপ নিজেকে অরূপ নামে পরিচয় দেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু, অরূপ নামে ডাকলে ওর কাছ থেকে এক ডাকে সারা পাওয়া যেত না, জাগা বলে ডাকলে যা পাওয়া যেত।
— শেষ —