তখন আমরা দশম শ্রেণীতে পড়ি। মালদহের রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের সিনিয়র ইয়ারের ছাত্র। সুতরাং দায়িত্ব পালন এবং পাকামি করার সুযোগ এর আগে কখনো সেভাবে আসে নি, আর এর পরেও আর আসবে না। তাই সবেতেই আমাদের উত্তেজনা একটু বেশী।
সেদিন মিশনে কুমারী পূজা। সকাল থেকেই ভীষণ ভিড় আর সেই ভিড়ের মধ্যে সমবয়সী সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি। আর প্রায় তাদের সকলের সাথে আছে তাদের মা-গার্ডজিয়েন। এইসব মা-গার্ডজিয়েনদের অন্যতম প্রধান কাজ হল তাদের মেয়েদের অকারণ গার্ড করে রাখা।
আমারা তখন মিশন গেটের বাইরে দাতব্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয়ের প্রাচীরে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় জমিয়ে আড্ডা মারছি। এর মধ্যে গোটা মিশন চত্বর দু-একবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা হয়ে গেছে – কে কে এসেছে – বিশেষ করে যাদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে।
দুপুরের কাছাকাছি একটা সময়ে কুমারী পূজা শেষ হল। এরপর প্রসাদ বিতরণ, প্রসাদ খাওয়া এবং তারপরে বাড়ী যাওয়া। এমন সময়ে দেখি ওই মা-গার্ডজিয়েনদের মধ্যে যার প্রভাব ও প্রকাশ সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করত সেই ভদ্রমহিলা মিশনের মণ্ডপ থেকে নেমেই আমাদের বন্ধু ‘হরিপদ মার্কা’ এক ছেলেকে একটা টেনিস-বল সাইজের রাজভোগ একদম মুখে ঢুকিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। দেখে তো আমাদের সব পাকামি বেরিয়ে গেছে। সেই ঘটনার আর একটু পরে আমাদের সবার সামনে দিয়ে হরিপদ – হ্যাঁ, সব ঠিক আছে; না না, ওনিয়ে আপনি একদম ভাববেন না, আমি আছি তো; তবে ওই কথাই থাকল, … ইত্যাদি বলতে বলতে অত্যন্ত সতর্কভাবে আমাদের দিকে না-তাকিয়ে তাঁর সাথে চলে গেল।
আমরা একদল ছেলে, যারা সব জায়গায় পাকামি করি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম – মাঝে গার্ডজিয়েন, একপাশে হরি এবং অন্যপাশে একটি সুন্দরী মেয়ে আমাদের সকলের চোখের সামনে দিয়ে গল্প করতে করতে চলে গেল। তখন সবাই বিনা তর্কে এক কথায় মেনে নিলাম যে – এই রকমই হয়। আমরা কেউ পরীক্ষার খাতায়, কেউ খেলার মাঠে, কেউ স্টেজে, কেউবা এসবের অনেক কিছুতেই প্রচুর ডম্ফাইগিরি করি, এদিকে পদা চুপচাপ নিজের কাজ হাসিল করে গেছে। তবু খটকা থেকেই যায় – তাই বলে হরিপদ? কেসটা কি? সেদিনের পর্ব মোটামুটি এইখানেই শেষ।
নবমী গেল শুধু আড্ডা মেরে। হরিপদর কথা অনেকবারই উঠল – তবে কোন কিনারা হল না।
দশমীর দিন আবার সবাই জমায়েত হলাম। মিশনের আড্ডার শেষ পর্ব। সেই দিন হরিপদ এসে আমাদের দলে ভিড়েছে। সবার মনে একই প্রশ্নও, কিন্তু কেউই সেটাকে গুছিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। এরকম অবস্থায় একজন জিজ্ঞেস করেই বসল। পদার কাছ থেকে উত্তর এলো – ছাড় তো, ওসব কথা।
এর কিছুক্ষণ পরে দেখি সেই মহিলা পাশ দিয়ে চলে গেলেন। কোন কথা বলা তো দূরে থাক, একবার তাকালেন না পর্যন্ত হরিপদর দিকে – যাকে দুদিন আগে কি আদর করেই না রাজভোগ খাইয়েছিলেন।
এই রকমটা দেখার পরে সেটা আর কোন ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না। সবাই তখন হরিপদর খুব কাছের বন্ধু। ব্যাপারটা জানতেই হবে। এরকম অবমাননা গোটা গোষ্ঠীর অবমাননা। সবাই মিলে হরিপদকে ঝড়ের মত তেইশখানা প্রশ্ন করার পরে আমরা একটু দম নিচ্ছি, আর এই চাপে পরে পদার চোখ আর গাল ফুলে লাল হয়ে গেছে।
এদিকে উৎপল এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার সে পেছন থেকে উঠে ধীরে ধীরে এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর রহস্যের সমাধান করল। উৎপল ওদের পাড়ায় থাকে। বলল, ক্লাবে গানের প্রতিযোগিতায় সেই মেয়ের গানের সাথে হরিপদ তবলা বাজিয়েছিল নবমীর দিন সকাল বেলায়। কিন্তু সে প্রথম পর্যায়েই বাদ পরে গেছে।
— শেষ —