খাঁটি সোনা দিয়ে যেমন অলঙ্কার বানানো যায় না, নীরস ঘটনা কোন গল্প হয়ে ওঠে না। গল্প রসের খাতিরে গল্পের গরুকে মাঝে মাঝে মাটি ছেড়ে আকাশে উড়তে হয়। গল্প বলার সময়ে গল্পের কথককে পাইলট হয়ে গল্পের সাথে সাথে উড়তে হয়, নাহলে গল্পের ঘটনার সত্যতা নিয়ে শ্রোতার মনে সন্দেহ এসে যায়। এই উড়ে যাওয়া ততটা কঠিন না, যতটা কঠিন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসা। এসব কাজে সহকারীর সমান গুরুত্ব থাকে। সহকারীদর কাজ প্রথম দিকে গল্পকে সমর্থন করে চলা। গল্পের পিছনে হাওয়া করে যাওয়া, যাতে গল্পের গরু সহজেই উড়তে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল কোন একটা শুভ মুহূর্তে গল্প কথককে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসা। গল্প যখন নানান পাকেচক্রে ঘুরতে ঘুরতে শ্রোতার সামনে পরিবেশন করা হয় তখন কোনটা সত্য ঘটনা আর কোনটা বানানো তা বোঝার যো থাকে না।
শিল্পটি এমনিতে খুব সোজা যদি এর তাক বোঝা যায়। অনেকটা গনগনে আঁচে রুটি সেঁকার মত। শ্রোতার কৌতূহলের আগুনে গল্প বানিয়ে যেতে হয় সজাগ দৃষ্টিতে। গল্পের রুটি ফুলছে, ফুলছে – ব্যাস তাক বুঝে টুক করে নামিয়ে ফেল। যদি তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলো তো গল্পের রুটি কাঁচা থেকে যায়। আবার বেশীক্ষণ ধরে রাখলে হয় সে রুটি পুড়ে এক-আধটা ফুটো হয়ে সব বাষ্প বেড়িয়ে যাবে। সে বাষ্প কথকের মুখ পুড়িয়ে দিতে পারে। গল্পের এই তাক না-বোঝার জন্য অনেক গল্প মাঝ পথে মারা যায়।
হোস্টেলে আমাদের একটা প্রোটোকল ছিল। গল্প বলার সময় কথক যদি তার হাতের কাছে যা আছে, বা যেখানে বসে বলছে তাতে আস্তে করে হাত রাখে বুঝতে হবে এবার গল্পের গরু আকাশে উড়তে শুরু করল। এরপরে সে যা বলবে তা হচ্ছে তার মনের উদ্ভাবনী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র – অর্থাৎ, সহকারী বন্ধুগণ প্রস্তুত থেকো তাকে সময়মত মাটিতে নামিয়ে আনবার জন্যে।
এই প্রোটকলের উপরে ভরসা করে বৈদ্যা একদিন একটা গল্প শুরু করল। তার কিছুক্ষণের মধ্যে অকারণে একটা হাত ওর বিছানার উপর রাখল। যারা প্রোটকলটা জানেনা তাদের কিছুই মনে হল না। তারা গল্প শুনে যাচ্ছে। গল্পটা মারাত্মক কিছু না। মোটের উপর গল্পটা এই – রাস্তায় একটা বাস একটা বাচ্চা ছেলেকে চাপা দিয়ে পালিয়েছিল। পালাতে পালাতে মাইল খানেক দূরে সেই বাসটা একটা রিক্সাকে ধাক্কা মারে। তাতে রিক্সার বৃদ্ধ যাত্রী মারা যান। এই বৃদ্ধটি নাকি সেই ছেলেটার দাদু।
গল্পের গরু তখন গাছ ছেড়ে আকাশের দিকে উঠছে। এদিকে বৈদ্যার অপারদর্শিতা দেখে সবাই মুচকি মুচকি হাসছে – বোঝা গেছে, বৈদ্যা গুল মারছে। বৈদ্যা কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে ঘটনার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। এবার আর শুধু গল্প নয়, গল্পের সাথে নিজেকেও উড়তে হবে।
বৈদ্যা বলল, সেখানে অমুক ছিল, তমুক ছিল; ওরাও জানে।
শ্রোতারা বলল, আহাহা – তাই বুঝি?
বৈদ্যা বলল, আচ্ছা আমি এখানেই বসে থাকছি। তোরা গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে আয়। মিথ্যে হলে আমি তোদের সবার রিক্সা ভাড়া দিয়ে দেব।
শ্রোতারা বলল, আমাদের ঘটে অল্প হলেও কিছুটা বুদ্ধি এখনো আছে।
বৈদ্যা তার রেট বাড়ালো। রিক্সা ভাড়ার সাথে সবার জন্যে বাপির দোকানের পরোটা-মাংস যোগ হল। আর বলল, যদি সত্যি প্রমাণ হয় তাহলে সবাই মিলে সে’মাসের ওর মেস-চার্জ দিতে হবে। এই হল চ্যালেঞ্জ।
সহকারীরা এইবার পড়ল বিপদে। ভাবল, গল্পের প্রথমদিকেই বৈদ্যা বিছানায় হাত রেখে ছিল – সুতরাং ইঙ্গিত পরিষ্কার যে এইবার গল্পের গরু উড়তে শুরু করবে। কিন্তু, বৈদ্যা এটা কি চাল চাললো? এতো অনেক টাকার ব্যাপার! ওর আসল মতলবটা কি? সে যা হোক, নিয়ম অনুযায়ী এবার তাদের কাজের পালা – টাইম ফর অ্যাকশন। সবাই হুজুগে পরে যদি গল্পের সত্যতা যাচাই করতে যায় তাহলে তো বেচারার অকারণে অনেকগুলো টাকা গচ্ছা যাবে।
এদিকে সহকারীদল যতই গল্পের গুরুত্ব লঘু করার চেষ্টা করে বৈদ্যা ততই জোর দিয়ে বলে। অনেক কথার পরেও বৈদ্যা যখন দেখল যে কোনকিছুতেই তাদের বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না তখন ওর পড়ার টেবিলে যে সরস্বতীর ফটোটা ছিল, সেইটে ছুঁয়ে বলল, আমি সরস্বতী ছুঁয়ে বলছি, এবার বিশ্বাস হল তো।
সহকারীদল বুঝল বৈদ্যা বেজায় বিপদে পরেছে। এবার হাত রেখেছে ছোটখাটো কিছু নয় একেবারে সরস্বতীর ছবিতে – মরিয়া হয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে – ওরে এবার আমাকে বাঁচা। এরপরে তাদের যা করণীয় তাই করলো – গল্পের আসর ভেঙ্গে সবাইকে সেই ঘর থেকে বের করে দিল। এদিকে বৈদ্যা রেগে বোম। বলল, তোরা কমপক্ষে কুড়ি টাকা দে। অন্তত আমার লসটা মেকআপ কর।
– কিসের লস? তোমাকে যা বাঁচান বাঁচালাম আজ!
বৈদ্যা বলল, লস না? বাস স্ট্যান্ডের পাশে এক্সিডেন্ট দেখে ওখানকার ছেলেদের পরোটা-মাংস খাইয়ে ফিট করে রেখে এসেছি। সেই খরচাটা তো অন্তত দে।
সহকারীদল এইবার বৈদ্যার পুরো পরিকল্পনাটা বুঝল। জিজ্ঞেস করল, ওই সরস্বতী ছুঁয়ে বলাটা? সেটা থেকে কি করে বুঝবো?
বৈদ্যা বলল, সে নাহলে তো কেউ বিশ্বাসই করছিল না। আর, আজ সত্যি একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
সহকারীদল জিজ্ঞেস করল, আর প্রথমের দিকে বিছানার উপরে হাত রাখাটা? তা দেখে আমরা নিয়মমত যা করার তাই করেছি।
বৈদ্যা বলল, হাত কোথায় রাখলাম? সে তো মশা মাড়ার জন্যে।
ওই যে বলছিলাম, গল্পের তাক না-বুঝতে পারা। আবার সেই গল্পের তাক না-বুঝতে পারায় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া এবং গল্পের গরু মাঝ আকাশে ফেলে দিয়ে মুখ চুন করে ফেরত আসা।
তখন তৈরি হল আরেকটা প্রোটোকল, এই রকম কোন ঘটনা ঘটলে একই যায়গায় পরপর দুবার হাত রাখতে হবে – তাতে বোঝা যাবে আগেরটা হয় কোন সঙ্গত কারণে; ইঙ্গিত নয়।
এতে সমস্যার কিছুটা নিষ্পত্তি হলেও পুরোটা নির্মূল হয় নি। এক-একটা এইরকম অঘটন ঘটত আর এক জায়গায় হাত রাখার সংখ্যা বারত। এখন বুঝি, জননেতাদের ব্যক্তিতার সময়ে তাদের সাকরেদরা কিছুক্ষণ বাদে বাদে অত হাততালি দেয় কেন।
— শেষ —