Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। সাত ।।

পরের কয়েকদিন গেল একই রকমভাবে। রতন শম্পার বাড়ি পাওয়া, বা চলে যাওয়া নিয়ে কেউ কোন প্রসঙ্গ তুলল না। রোজ সকালে দুজন বের হয়ে যায়। সন্ধের সময় বাড়ি ফেরে। সারা সপ্তাহ এইভাবে পার হয়ে গেল। রবিবার সকালে চা খেতে খেতে রতন ঠিক করল আজ আর কোন কথা শুনবে না। চা বানিয়ে শম্পা যখন রতনকে দিতে এল, রতন খপ করে ওর হাত ধরে টেনে ওর নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, তুই যে বাড়ি খুঁজে পাসনি এখনো সেটা আমি বুঝেছি। তার চেয়ে ভাল তুই এখানেই থেকে যা।

– যাতে যখন তখন আমার হাত ধরে টানতে পারো। তাই তো?

– ছিঃ। সকাল সকাল তোর মুখে কি কথা। টান মারার হলে অনেক দিন আগেই পারতাম। সেটা তুই ভালো করে জানিস। এই কয়দিনে অনেক ভাবলাম। আমি তোকে বিয়ে করব।

– নিজেকে তো ফর সেল করে রেখেছ। বিয়ে করবে কি করে? আগে ধার মুক্ত হও, তারপরে এসব ভেবো।

শুনে রতনের গুম মেরে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। শম্পাও ওর পাশে বসে চুপচাপ চা খেল। চা খওয়া শেষ করে বলল, ‘কি হল? সব ভালোবাসা শেষ হয়ে গেল?’ – বলে ইচ্ছে করে রতনের গা ঘেসে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চলে গেল। রতন একই জায়গায় বসে শম্পার কথাগুলো ভাবতে লাগল। টাকা ধার নেবার সময় কনট্রাক্টে সই করেছিল যে যতদিন না ধার শোধ করতে পারছে ততদিন এই কারখানায় কাজ করবে আর প্রতিমাসে একটু একটু করে শোধ করে দেবে। এটাই ছিল গ্যারেন্টি-নামা। নিজের অবস্থা, অক্ষমতা নিয়ে মনটা ভারী হয়ে গেল। ওর আর কোন সম্পত্তিও নেই যা বিক্রি করার কথা ভাবতে পারে। জমানো টাকা যা আছে তাতেও কিছু হবে না। ভাবতে ভাবতে আবার শুয়ে পড়ল। কতক্ষন কেটেছে কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ শম্পা এসে ওর পিঠের সাথে ঠেস দিয়ে বসে বলল, ওঠ এবার। জলখাবার খেয়ে নাও।

রতন যতই উঠতে চেষ্টা করে শম্পা ততই একটু করে রতনের দিকে সরে বসে। প্রথম দুবার রতন ঠিক বুঝতে পারে নি, ভেবেছিল শম্পা হয়ত ঠিক মত বসার জায়গা পায় নি তাই সরে আসছে। যখন দেখল ও একবারে দেওয়ালের সাথে লেগে গেছে তখন বুঝল আসল ব্যাপার। ভালোই লাগল। চুপ করে পরে থাকল, ওঠার চেষ্টা করল না আর। শম্পা এবার সরে গিয়ে রতনকে টেনে তুলল। ‘এই যে মিস্টার ফর সেল, খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি’।

রতন উঠে বসে জলখাবারের থালাটা নিয়ে বলল, তুই কি এটা আমার নতুন নাম দিলি নাকি?

– নামে কি হবে? যা তোমার অবস্থা তাই বললাম।

রতন নিজের অবস্থার সাথে ধাক্কা খেয়ে শম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। শম্পা বলল, তোমাকে আর একবার বলছি, আমার কাছে জমানো টাকা আছে। ও দিয়ে তুমি তোমার ধার শোধ করে দাও। এমনি নিতে খারাপ লাগলে ধরে নাও আমার কাছ থেকে।

রতন শম্পার পরিকল্পনাটা বুঝতে না-পেরে জিজ্ঞেস করল, আমার ধার শোধ করা নিয়ে তোর এত চিন্তা কেন? তোর কাছে টাকা আছে, রাখ না। অন্য কাজে ব্যবহার করবি।

শম্পা বলল, আমি এখান থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। আবার নতুন করে সব শুরু করব। তুমি যদি আমার সাথে যাও আমার সুবিধা হবে। তাই বলেছিলাম।

রতন ভাবল, ব্যপারটা মন্দ হয় না। আবার নতুন করে শুরু করা যাবে। তবুও প্রথম থেকে পরিস্কার হয়ে থাকা ভাল। বলল, আমি টাকাটা ধার হিসাবে নেব। রাজি?

– রাজি।

– কোন শর্ত থাকলে আগেই বলে দে।

– আমি তো নিঃশর্তে নিজেকেই দিতে চেয়েছিলাম। টাকার জন্যে কোন শর্ত দিতে যাব কেন?

তারপরে দুজনে মিলে ঠিক করল রতন কারখানা থেকে কয়েকদিনের জন্যে ছুটি নেবে এই বলে যে কিছু সম্পত্তির ব্যাপারে ওকে ভীমপুরে যেতে হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে, দু-একদিন পরে পুরো টাকাটা শোধ করে দেবে। বলবে, পুরানো কিছু জমি মামলাতে আটকে ছিল। সেটা মেটার পরে ওখানে গিয়ে সব বিক্রি করে এসেছে। তাই দিয়ে ধার শোধ করতে পারল। তারপরে মাসখানেক চাকরি করার পরে ঠিক সময় বুঝে ও কাজটা ছেড়ে দেবে। তারপর দুজনে অন্য কোথাও চলে যাবে। পরিকল্পনাটা রতনের বেশ পছন্দ হল।

শম্পা বলল, আর একটা কাজ করতে হবে। আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে আলমারি খুলে কয়েকটা জিনিষ আর দুটো সুটকেস নিয়ে আসতে হবে।

তারপর শম্পা ফ্ল্যাটের ঠিকানা, ফ্ল্যাট নম্বর, সেখানে কিভাবে যাবে, কোথায় লিফ্ট, ঘরের মধ্যে কোথায় কি আছে সব এঁকেঝুকে সব ভালো করে বুঝিয়ে, সব চাবি আলাদা আলাদা করে মার্ক করে রতনকে বুঝিয়ে দিল। আর বারবার সাবধান করে দিল কাউকে যেন কিছু জিজ্ঞেস না করে। কেউ ফলো করছে সন্দেহ হলে যেন অন্য কোথাও চলে যায়।

রতন বুঝল। রাজিও হল। কয়েকদিন পরে রতন কারখানা থেকে ছুটি নিল। পরিকল্পনা মত শম্পার বাড়ি থেকে টাকা আর অন্য সব জিনিষ নিয়ে এল। তার কয়েকদিন পরে কারখানায় জয়েন করল। তার ঠিক দুদিন পরে ওর সব ধার শোধ করে যখন কন্ট্রাক্টের কাগজ সই করিয়ে নিল, মনে হল আজ যে কি শান্তি! এই কয়টাদিন যা উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে। মনে হল, ধারটা যদিও থেকেই গেল তবে সে তো নিজের লোকের কাছে। বাড়িতে এসে খুশীতে কন্ট্রাক্টের কাগজগুলো শম্পাকে দেখিয়ে, ওকে জড়িয়ে ধরল। শম্পাও রতনের বুকে মাথা রেখে একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। একটুও নড়ল না।

রতন যখন শম্পাকে ছাড়ল, শম্পা বলল, সেই লালপুরের মাঠে ভুতের ভয়ে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আর এই প্রথম তুমি আমাকে ধরলে। বলতে পারো, এই প্রথম আমাকে কেউ ভালোবেসে জড়িয়ে ধরল। আমার যে কি ভালো লাগছে।

শুনে রতন আবার এগিয়ে গেল শম্পার কাছে। শম্পা বলল, থাক আর না। এবার খেতে এসো।

রতন তাড়াতাড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে শম্পাকে বলল, এটা যে আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল তুই ভাবতেও পারবি না। মাঝে মাঝে রাতে দুঃস্বপ্নের মত এত কাগজটাকে দেখতে পেতাম। ঊঃ, সে যে কি হতাশা, কি টেনশন হত, কাগজগুলোর উপর এত রাগ হত। মাঝে মাঝে ভাবতাম, কোন রকমে যদি ওগুলো চুরিও করতে পারি, আমি একপাও পিছাব না। টাকা আমি মালিককে শোধ দিয়ে দিতাম। আমার বিপদের দিনে দিয়েছিল। কিন্তু এই কন্ট্রাক্ট-টা আমাকে কৃতদাস বানিয়ে রেখেছিল।

এইসব বলতে বলতে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল। শম্পা সব তুলে রেখে বিছানা ঠিক করতে এগিয়ে গেল। রতনও ধুপ করে সেখানে গিয়ে বসে পড়ল। বলল, আজ মনে হচ্ছে কিছু একটা করি। সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করছে। চল আজ সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দেই।

শম্পা কিছু না বলে বিছানা ঝেড়ে কাপড় বদলে রতনের পাশে এসে বসে বলল, বল? কি বলবে?

– জানি না। শুধু মনে হচ্ছে যদিও ধারটা ধারই থেকে গেল। একটু একটু করে যেমন দিচ্ছিলাম সেরকম করে তোকে দিয়ে দেব। কিন্তু নিজেকে আর কৃতদাস মনে হচ্ছে না।

– কয়দিন আগেও তুমি যে বলছিলে আমাকে বিয়ে করবে। তার কি হল?

– সে তো করবই। বল তো চল কালই বিয়ে করে ফেলি।

শম্পা বলল, ঠিক আছে। সময় হলে করা যাবে অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ধরো, তুমি টাকাটা বিয়ের যৌতুক হিসেবে পেলে। আমার তো আর কেউ নেই, তাই আমার বিয়ের যৌতুক আমাকেই দিতে হল। অত ধার ধার করো না তো।

রতন বলল, আজ আমি এত খুশী যে তুই যা ইচ্ছে বলে যেতে পারিস। আমার কিছু মনে হবে না।

– ঠিক আছে। তাহলে আরেকটা বালিশ টেনে পাশে শুয়ে পরো। কাল সকালে আবার কাজে যেতে হবে।

‘এখানে শোব?’ ‘তাই তো বললাম। আর আলাদা করে মেঝেতে শুতে হবে না। আমার পাশেই শোও। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8