Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। ছয় ।।

পরের দুইদিন সকাল বেলা শম্পা রতনের সাথেই বের হল বাড়ি খোঁজার জন্য। বড় রাস্তা অবধি  একসাথে গিয়ে যে যার নিজের পথে চলে গেল।

সেদিন মঙ্গলবার। রতন কাজ থেকে ফিরে এসে দেখে শম্পা বেশ কিছু জিনিষ আর রাতের খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। রতন ঘরে ঢুকতেই শম্পা বলল, আজ আর আমার রান্না করার কোন শক্তি নেই, তাই দোকান থেকে কিনে নিয়ে এলাম একেবারে।

রতনের ঘরটা এই কয়দিনে অনেক বদলে গেছে। আজ যেন সেটাকে আরও অন্যরকম লাগছে। রতন বলল, সে ভালো করেছিস। কিন্তু এইসব দিয়ে সাজানোর দরকার কি? কে এগুলো পরিষ্কার করে রাখবে? তুই যাওয়ার সময় এসব তোর সাথে নিয়ে যাস।

– আমি এনেছি বলে তোমার পছন্দ হল না। তাই তো?

কথাটা অভিমানের সুরে বললে ভালোই লাগে, অনেক কিছু অনুভব করা যায়। রতনের মনে হল, শম্পার বলায় মধ্যে সেরকম কোন সুর নাই, বরং যেন একটু বিরক্তিই প্রকাশ পেল। ভাবল, হয়ত সারাদিনের ক্লান্তিতে এখন মেজাজ গরম হয়ে আছে। কোন উত্তর দিল না। জামাকাপড় বদলে, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেল। শম্পা ভীষণ রকমের চুপচাপ। খেয়ে উঠে রতন জিজ্ঞেস করল, সারাদিন কোথায় ঘুরলি?

শম্পা পাশ থেকে একটা নিঃস্পৃহ ভাবে উত্তর দিল, এখনো কিছু পাই নি। তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাব।

কথাটা রতনের মনে ছ্যাঁক করে লাগল। এই কয়দিনে বাসায় ফিরে শম্পাকে পাওয়াটা রতনের একটা অভ্যেসের মত হয়ে গেছে এই কয়দিনে। কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাব কথাটা শুনে একটা শূন্যতার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রতনের মনটা ভারী হয়ে গেল। শম্পার কাছে গিয়ে একটু আদরের সুরে বলল, তোকে কি কখনও চলে যেতে বলেছি?

শম্পার মনে কি হল কে জানে। এবার নরমভাবে উত্তর দিল, থাকতেও তো বলো নি কোনদিন। তাছাড়া এ’ভাবে কয়দিনই বা থাকব?

রতন সারাদিন কাজের মধ্যে থাকে। তারপর বাড়ি এসে এতসত ভাববার সময় কোনদিন হয় নি। একার জীবন। কাউকে কিছু জবাবদিহি করার নেই। তাই, এভাবে কতদিন থাকা যায় – সেই কথাটা মাথায় আসে নি। এখন কথাটা শোনার পরে রতন একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। অনেক ভাবনা মাথার মধ্যে আসছে, কিন্তু কোনটাই সে পুরোপুরি মানতে পারছে না।

‘রাত হয়ে যাচ্ছে। কাল আবার যেতে হবে’ – এই বলে শম্পা নিজের বিছানায় চলে গেল। রতনও চেয়ার সরিয়ে মেঝতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল, অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল; কিছুতেই ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কথা, ভীমপুরে কথা মনে পড়তে লাগল। বিকাল বেলা লালদিঘির কাছে একটা ভাঙ্গা বাড়ির কোনায় অনেকবার শম্পার সাথে গল্প করেছে। প্রথমবার কি করে দুজনে সেখানে গিয়েছিল, মনে করতে পারল না। সেখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যেত। তবে কেউ খুব কাছে না-এলে সেখানে কেউ আছে বা নাই তা বাইরে থেকে দেখা যেত না। শম্পা কেন যেত সেখানে, ও নিজেই বা কেন যেত; কেমন করে জানত ওদিকে গেলে শম্পাকে পাওয়া যাবে, তেমন করে কোনদিন ভাবে নি। এই জায়গাটা নিয়ে গ্রামে অনেক রকম গল্প ছিল। সন্ধের পরে কেউ যেত না সেখানে। লালদিঘির অন্যপারে কি এক মাসি থাকত। তার সম্বন্ধে অনেক দুর্নাম ছিল। সবাই তাকে এড়িয়ে চলত। তবে সে কোনদিন রতনদের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। রতন বা ওর বন্ধুরা গ্রামে অন্যদের কাছে মাসির নামে ভালো কিছু বললে, বড়রা বলত, ওসব তোদের হাতে রাখার ফন্দি। ওর থেকে দূরে থাকবি। এইটা মনে হতেই, পাশ ফিরে শম্পার দিকে দেখল। জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে যতটুকু আলো আসছে, তাতে মনে হল শম্পা ঘুমাচ্ছে। মনে হল, ভিমপুরে থাকলে আজ হয়ত শম্পার নামে সবাই সেই রকমই কিছু একটা বলত। এইটা মনে হতে রতনের গা শিরশির করে উঠল। রতন উঠে জল খেতে গেল।

শব্দ শুনে শম্পা উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কি হল তোমার? ঘুমাও নি এখনো?

না। তারপরে কি একটা ভেবে রতন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তোর ভীমপুরের লালদিঘির পাশে সেই ভাঙ্গা বাড়ির কথা মনে আছে?

– হ্যাঁ।

– মনে আছে! আর ওই পুকুর পারের সেই মাসির কথা? কি যেন নাম?

– সোনালি মাসি। এখন ওটাই আমার নাম।

শুনেই রতনের মাথাটা ঘুরে উঠল। গ্লাসটা কোন রকমে টেবিলে রেখে বসে পড়ল। শম্পা তাড়াতাড়ি করে উঠে রতনকে ধরে বিছানায় বসাল।

– হঠাৎ কি হল তোমার? শরীর ঠিক আছে তো!

রতন ইশারায় ওকে চুপ করতে বলে, নিজে চুপ করে বসে থাকল। শম্পা উঠে লাইটা জ্বেলে, ফ্যানটা একটু জোরে করে দিল। তারপরে রতনের পাশে বসে রতনের মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে যাওয়ার পরে রতন বলল, থাক। আর লাগবে না।

তারপর শম্পার কপালের উপর থেকে চুলটা সরিয়ে শম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার যা দুর্দিন গেছে তাতেই আমি ক্লান্ত। এখন আর কিছুই মনে করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তোর উপর দিয়ে যা গেছে আমি তা কল্পনাও করতে পারি না। তাও তোর সব মনে আছে?

শম্পা বলল, আছে। সব মনে আছে। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেন জানো? ওইটুকুই আমার জীবন। বাকিটা যন্ত্রনা। একটু থেমে আবার বলল, আমার প্রতিটা ঘটনা মনে আছে। কেন জানো? সে জীবন আমি আর কোনদিন পাব না – তাই। যার কাছে যেটা দুর্লভ, অসম্ভভ, তার কাছে সেটাই সবচেয়ে দামী।

রতন বলল, কেন সম্ভব না? তুই চাস না – তাই বল।

শম্পা মুখ নিচু করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপরে গম্ভীর হয়ে বলল, এত রাতে এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে এইটুকু বলি, তুমি যদি আমাকে আপমান করতে চাও, বলে যাও। পারবে না। আমাকে যে’সব অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সে’সব সহ্য করার পরে আর কিছুতেই আমার খারাপ লাগে না। যদি আঘাত দিতে চাও, তাও পারবে না। তুমি নিজেই আমাকে যে অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলে তার থেকে এইটুকু নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারো। তবে কথাগুলো তোমার কাছ থেকে এলে খারাপ লাগে – এই যা।

রতন শম্পার একদম কাছে এসে বলল, তুই তো সেদিন বললি, ইচ্ছে থাকলে সাহসটা আপনি চলে আসে। তোর কোনটা নেই? ইচ্ছে না সাহস?

– আমার সেসব থাকা, না-থাকার উপর যদি সবটা নির্ভর করত, তাহলে অনেকদিন আগেই যা করার করে ফেলতাম। মামা জোর করে বিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়ার আগের দিন তোমার কাছে গিয়েছিলাম। কত কি বললাম তোমাকে। শেষে বললাম, চল পালিয়ে যাই, দরকার পড়লে লোকের বাড়িতে কাজ করব। তুমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলে। বললে, বাড়ি যা, পাগলামি করিস না। সাহস করে সেদিন পালিয়ে যেতে পারলে, আজ আমার অবস্থাটা কি এর থেকেও খারাপ হত?

রতন খপ করে শম্পার হাত ধরে বলল, আমার সেদিন সেরকম অবস্থা ছিল না। তখন আমি স্কুলে পড়ি। আর আমি ঠিক বুঝতেও পারি নি। তাছাড়া, তোর যে এই অবস্থা হবে তা কি আমি জানতাম, না তুই জানতিস?

শম্পা শান্ত স্বরে বলল, ভবিষ্যতের কথা ছেড়ে দাও। সেদিন বুঝতে ঠিকই পেরেছিলে। শুধু ইচ্ছেটা সেরকম ছিল না।

শুনে রতন শম্পার হাতটা আলগা করে দিতেই শম্পা আস্তে করে হাতটা টেনে নিল। তারপরে বলল, পুরানো দিনের কথা টেনে লাভ নেই। আমি সেদিনও তোমাকে কোন দোষ দেই নি, আজও দেই না। মাঝে মাঝে ভাবি, তোমার সাথে দেখা না-হলেই ভালো হত। মানুষের লোভটা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়।

রতন জিজ্ঞেস করল, তোর সাথে কোন ভালো লোকের আলাপ হয় নি এতদিনে? তুই কাউকে ভালোবাসিস নি?

এবার শম্পা একটু শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, হবে না কেন? সেরকম একজনের সাথেই তো এখন কথা বলে যাচ্ছি।

রতন এই বিদ্রুপে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এত রাতে আমি তোর সাথে ইয়ার্কি মারছি না। আমার কথা বলছি না। অন্য কেউ।

শম্পা আবার ফিক ফিক করে একটু হেসে বলল, আমিও এত রাতে তোমার সাথে ইয়ার্কি মারছি না। তুমি বিয়ে করো নি। একা একা থাকো। তোমার পুরানো প্রেমিকা তোমার সাথে একসাথে একঘরে আছে, একদিনও তো জড়িয়েও ধরলে না। অন্য কেউ হলে কত কি করত। এর চেয়ে ভালো লোক আর কোথায় খুজব? তারপরে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আমাকে যে কাজ করতে হয়, অন্য কারো কাছে হলে সে নিয়ে অনেক কথাই বলতে পারতাম। তোমার কাছে বলতে কেন জানি লজ্জা করে।

– তোর বিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছে করে না?

– ওই যে বললাম, তোমার সাথে দেখা না-হলেই ভালো হত। লোভ বেড়ে যায়।

রতন কোন ভুমিকা না-করেই দুম করে বলল, আমি যদি তোকে বিয়ে করি এখন।

শম্পা জিজ্ঞেস করল, কেন করবে?

রতন কোন জুতসই উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, তোকে আমি ভালবাসি, তাই।

– সে তুমি এমনি ভালবাসতে পারো। তার জন্যে আমাকে বিয়ে করতে হবে না। বলে রতনের কোলে মাথাটা রেখে শুয়ে পড়ল।

তারপর দুজনেই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে রতনের কিছু একটা একটু ভেজা ভেজা মনে হতে শম্পাকে টেনে তুলে দেখে, ও কাঁদছে। বুঝল, অনেকখন ধরে কাঁদছে। শম্পা উঠে একটা তোয়ালা টেনে চোখ মুখ মুছে বলল, সে আর হয় না। অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও, শুয়ে পরো। কাল সকালে কাজে যেতে হবে। এই বলে রতনের কথার অপেক্ষা না করে নিজের বালিশটা ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ল। রতনও অগত্যা নিজের বিছানায় গিয়ে এটা-সেটা চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8