Home » বড় গল্প » চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

চক্রবুহ্য (প্রথম পর্ব)

।। চার ।।

কয়েকদিন পরে শম্পা যখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল একদিন রতনকে দিয়ে কিছু জিনিষপত্র কিনিয়ে আনালো। নিজেই সারা দুপুরে ঘরটা সাজালো। তারপর রতনের জন্যে রান্না করা শুরু করল। এক রবিবারে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে শম্পা জিজ্ঞেস করল, রতন-দা তুমি এখানে কি করে এলে? ভীমপুরে কি আর যাও না? তোমার বাবা-মা কোথায় আছেন?

রতন বলল, তোর এসব জেনে কি হবে?

শম্পা বলল, কি হবে জানি না। তবে যার দয়ায় এত সুখে আছি তার সম্বন্ধে এইটুকু জানব না?

– সুখে আছিস? এইটুকু ঘরে তোর অসুবিধে হয় না?

– সুখ ব্যাপারটা বোঝার। যারা সেটা না-বুঝে বাইরে খুঁজতে যায় তারা কোনদিন সুখ পায় না।

রতন চুপ করে থাকল। শম্পা আবার জিজ্ঞেস করল, বল না?

রতন বলল, তুই চলে যাওয়ার কয়েক বছর পরে একবার উত্তরবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল। সারা উত্তরবঙ্গ ভেসে গিয়েছিল সে বছর। আমাদের বাড়ি বন্যার জলে ভেঙ্গে গেল। একটুও ফসল উঠল না সেবার। বন্যার সময় থেকে বাবার শরীর খারাপ হতে শুরু করল। একদিকে টাকার টানাটানি; এদিক ওদিকে ধার করে চলছে, তার উপর এমন অবস্থা হল যে বাবার চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় নিয়ে আসতে হল। অনেক টাকা খরচ হল। মাস দুয়েক পরে বাবা হাসপাতালেই মারা গেলেন। ডাক্তার কিছুই ধরতে পারল না। বলল, বন্যার জল থেকে শরীরে কিছু ঢুকেছিল। মাকে নিয়ে ভিমপুরে ফিরত গেলাম। দিন দিন টাকা শোধ দেবার চাপ বাড়তে লাগল। বাড়ীটা বিক্রি করে দিলাম। তাতে বাড়ির মায়া কাটানো ছাড়া আর কোন লাভ হল না। সব টাকা শোধও হল না।

কলকাতায় থাকার সময় কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছিল। মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। তারপর অনেক চেষ্টা করে নতুন একটা ধার নিয়ে আগের সবার সব ধার শোধ করে দিলাম। তবে ওই টাকা নেওয়ার একটা শর্ত ছিল। যতদিন ওই টাকা শোধ না-হচ্ছে আমাকে এই কারখানায় কাজ করতে হবে।

দুই বছর পরে মাও মারা গেলেন। যেভাবে বাবা মারা গেছিলেন, অনেকটা একই রকমভাবে। তখন থেকে সেই কারখানায় কাজ করে যাচ্ছি আর প্রতিমাসে একটু একটু করে ধার শোধ করছি।

শম্পা জিজ্ঞেস করল, কত টাকা ধার আছে এখনো? পুরোটা শোধ হয়ে গেলে তো তোমাকে ওখানে আর কাজ করতে হবে না।

রতন বলল, তা ঠিক। তবে সে করতে অনেক বছর লেগে যাবে।

শম্পা এবার রতনের কাছে এগিয়ে এসে গলার স্বরটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কত টাকা ধার আছে, বল না?

রতন বলল, তা জেনে তোর কি হবে?

শম্পা বলল, আমি যদি ওই টাকাটা তোমাকে দেই, আর তুমি  সেটা দিয়ে তোমার ধার শোধ করে দাও।

রতন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ওই একই হল। তারপর আমাকে তোর কেনা গোলাম হয়ে থাকতে হবে। কি কি কাজ করতে হবে তোর হয়ে আগে থেকে বলে দে।

শম্পা আর কোন কথা না-বলে, বিছানায় গিয়ে দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। আর রতন নিজের জায়গাতেই বসে থাকল।

অকারণ খোঁচা দেওয়াটা ঠিক হয়নি বুঝে, রতন শম্পার পাশে গিয়ে বসল। এতদিন শম্পাকে অসুস্থ-পিরিত একজন রোগী হিসেবেই দেখে এসেছে, যতটা পেরেছে সেবা শুশ্রূষা করেছে। আজ ওর পাশে বসে ওকে ছুঁতে গিয়ে একটু বাধ-বাধ লাগল। সঙ্কোচে হাতটা এগিয়েও থেমে গেল। ওকে না-ছুঁয়েই রতন ডাক দিল, তুই কিছু মনে করিস না। উঠে বস।

কিছুক্ষণ পরে শম্পা চোখ মুছে যখন উঠে বসল, রতন জিজ্ঞেস করল, তোর যদি অতো টাকা থাকে তাহলে তুই এই ছোট ঘরে আমার কাছে পরে আছিস কেন?

শম্পা বলল, সেটা যখন এখনো বোঝ নি তবে আর বুঝবেও না।

রতনের মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন খেলে গেল, তবে কোনটাই দানা বাঁধল না। চিন্তাটা যেখানে এসে থামল, তা হল, সেই রাতে শম্পাকে ওখানে কে ফেলে রেখে গিয়েছিল? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও রতন থেমে গেল। কিছুদিন আগেই যা শুনেছে সেটা মনে পরাতেই লোকগুলোর উপর ভীষণ রাগ হল। নিজের গা বমি বমি করতে লাগল।

রতন চুপ করে আছে দেখে শম্পা ভাবল, ‘বুঝবে না’ বলাতে রতন রাগ করেছে। অবস্থাটা হাল্কা করার জন্যে বলল, এখানে একটু শান্তিতে থাকতে পারি তাই আছি। তারপরে একটু থেমে বলল, তোমার বাড়িতে থাকার মত যোগ্যতা আমার নেই। সেদিন কিছুটা বাধ্য হয়ে আর কিছুটা জোর করে এখানে এসেছিলাম। তোমাকে যে কোনদিন আবার দেখতে পাব তাই ভাবিনি। যখন পেলাম আর জানলাম তুমি একাই থাক তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না। যদি বল তো আজই আমি চলে যাব।

রতনের চোখের সামনে দিয়ে অনেকগুলো দুঃখের দৃশ্য ভেসে গেল। বলল, তোকে কি আমি সে কথা বলেছি?

– না বললেও বুঝতে পারি যে তোমার অসুবিধে হয়। তাছাড়া কয়েকদিন থাকব এই বলেই তো এসেছিলাম। একদিন তো যেতেই হবে। সেটা আজ নয় কেন?

রতন কিছু একটা ভাবছিল। রতনকে অন্যমনস্ক দেখে শম্পা জিজ্ঞেস করল, আমি এখানে আছি বলে তোমাকে কেউ কিছু বলে নি তো?

রতন বলল, কে আবার কি বলবে? এটা আমাদের ভীমপুরের গ্রাম নয়। এখানে কেউ কারুর ব্যাপারে নাক গলায় না। তাছাড়া এখানে অনেকেরই এই রকম কেউ আছে। কথাটা বলেই রতন নিজের ভুল বুঝতে পেরে অজান্তেই একটুখানি জিব কেটে শম্পার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকল – ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে।

গোটা ব্যাপারটাই শম্পা দেখেছে। শম্পা বলল, তুমি খারাপ কিছু বল নি; যা সত্যি, তাই বলেছ। এতে আমার কাছে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি থাকার জন্যে তোমার সম্বন্ধে কেউ বাজে কিছু ভাববে – সেটা আমিও চাই না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শম্পা বলল, আজ যেতে বললে আমি সত্যি বিপদে পড়ব। আর দুটো দিন সময় দাও। আমি একটা বাড়ি খুঁজে চলে যাব। একলা মেয়েকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। আমার ফ্ল্যাটেও আর যেতে চাই না আমি।

রতন এই কথাটা আগেও শুনেছে। শম্পার কাছে বাকি আর যা যা শুনেছে তার থেকে রতন নিজের মত করে কিছু একটা ভেবে নিয়েছে। এবার কৌতূহল চেপে না-রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করল, তোর ফ্ল্যাট কি ভাড়া করা, না নিজের?

শম্পা একটু মুচকি হেসে বলল, লিজে নেওয়া। অন্যের নামে, তবে ভাড়া আমি দেই।

একটুক্ষণ আগে বেফাঁস কথা বলে ফেলার ধকল মন থেকে তখনো যায় নি, তাই এনিয়ে আর কথা বাড়াল না রতন।

শম্পা শাড়ির আঁচলের খুটটা নিয়ে কিছুক্ষণ পাকাতে থাকল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুমি কাউকে ভালোবাসো?

এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন রতন একটু আশ্চর্য হল। জিজ্ঞেস করল, কেন?

– এমনি জিজ্ঞেস করলাম। একা থাকো, বয়েস হয়েছে, তাই। এই এলাকায় যে কেউ নেই, তা বুঝেছি। তবে তোমার কাজের জায়গায়? কাউকে…

রতন বলল, না। সেরকম কিছু হয় নি।

– হয় নি? সে কি তোমাকে ভালোবাসে?

রতন বলল, তুই কিচ্ছু বুঝিস নি। আমার যা অবস্থা তা তো তুই নিজেই দেখছিস। এই টাকায় ওসব ভাবা যায় না।

– সাহস থাকলে তাও হয়। ইচ্ছেটা যদি প্রবল হয় সাহসটা আপনি চলে আসে।

– তুই কি ইচ্ছে করলে…, বলেই বলল, না থাক, ওসব কথা। তোর খারাপ লাগবে।

– বলতে যখন শুরু করেছিলে বলেই ফেল। আমার খারাপ লাগবে না।

রতন চুপ করে বসে থাকল। শম্পা রতনের মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে দেখে রতন অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে নিল।

শম্পা বলল, ইচ্ছে করে আমি আমার এই অবস্থায় আসি নি। কেউ জোর করে আমার এই অবস্থা করে দিয়েছে। তবে ইচ্ছে ছিল বলেই আমি অন্তত সেই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। কষ্ট হয়েছে। গাড্ডায় পড়েছি। আবার উঠেছি। এই কয়দিন বসে বসে এইখান থেকে বের হওয়ার একটা প্ল্যান করেছি। শুধু তোমার একটু সাহায্য পেলেই করে ফেলতে পারব।

রতনের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কি করতে হবে? বল।

– আপাতত দুইদিন থাকতে দিতে হবে। আর একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেটা তো তুমি বাঁকাভাবে নিলে। তাই কাজটা আমার কঠিন হয়ে পড়ল।

কিসের কথা বলছে বুঝতে না-পেরে রতন হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। শম্পা কখন, কি বলেছে সেটাই ভাবতে থাকল। শম্পা উঠে গেল চা বানাতে।

রতন কিছু মনে না করতে পেরে শুধু বলল, তোর যতদিন দরকার থাক। তোকে কি আমি চলে যেতে বলেছি?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8